পরিবেশকর্মী কিঙ্করী দেবী: দুন উপত্যকার ‘ঝাঁসি কি রানি’
....................
কিঙ্করী দেবী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী থেকে “ঝাঁসি কি রানি লক্ষ্মীবাঈ স্ত্রী শক্তি” পুরস্কারে সম্মানিত এক নারীর নাম। এই নারীর জন্ম হিমাচল প্রদেশের ঘাতন গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার আলো পৌঁছয় না এইরকম পরিবারে, তাই স্বভাবতই পুঁথিগত বিদ্যা আয়ত্ত হয়নি তাঁর; প্রয়োজনের তাগিদে সইটুকুই শিখে নিয়েছেন কেবল। অল্প বয়সে বিয়ে এবং মাত্র ২২ বছর বয়সেই বৈধব্য – এক দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের নারীর ছকে বাঁধা জীবন। কিন্তু জীবনের শুরুটা চেনা ছকে আঁকা হলেও, সেই ক্যানভাসে ছকভাঙা রং মিশিয়েছিলেন কিঙ্করী দেবী।
বৈধব্য-পরবর্তী জীবন চরম দারিদ্র্যের মধ্যে কাটলেও সে দুঃখকে তিনি জয় করে নিচ্ছিলেন নিজের পথেই। সামাজিক বিদ্যালয়ের পাঠ তাঁর কাছে না পৌছালেও পরিবেশের পাঠ গ্রহণে ছেলেবেলা থেকেই প্রকৃতির কাছে আগ্রহী ছিলেন তিনি। স্বামীকে হারানোর পর পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে রাস্তাঘাট পরিষ্কার করে পরিবেশ-প্রকৃতিকে আগলে রাখার দায়িত্ব তুলে নেন তিনি নিজের কাঁধে। পরিবেশই প্রকৃত বন্ধু। সকলে মিলে সেই বন্ধুকে সুস্থ রাখার স্বপ্ন দেখতেন কিঙ্করী দেবী।
কিন্তু বাস্তব তাঁর সামনে নিয়ে এল এক ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন। হিমাচল প্রদেশের দুন উপত্যকাটির চুনাপাথরের জন্য বেশ খ্যাতি ছিল। আর সেই নাম-ডাক-খ্যাতিই হয়ে উঠল এই অঞ্চলের কাল। এমন জিনিস তো শুধু শুধু ফেলে রাখা যায় না! একে উপযুক্তভাবে ব্যবসায় লাগাতে পারলে লাভ হবে বিপুল। আর তাই সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবসায়ীদের ভিড় জমতে থাকে উপত্যকা জুড়ে। ১৯৮৫ সালে ব্যবসার পথ সুগম করতে শুরু হল খনি থেকে চুনাপাথর তুলে আনার কাজ। চলতে লাগল খননকার্য আর ব্যবসা বিস্তার লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার কুপ্রভাব এলাকাবাসীর চোখে পড়তে থাকল। হিমাচল প্রদেশের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বয়ে চলা জলপ্রবাহের স্বাভাবিকতার উপর প্রভাব ফেলতে থাকে এই খননকার্য। চুনাপাথর তুলে আনার খননকার্য চালানোর জন্য এই অঞ্চলের জলের স্রোত বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলত খুব দ্রুত এই অঞ্চলের জলের স্তর অনেক কমে যেতে থাকে এবং পর্যাপ্ত জল না পাওয়ার কারণে এই এলাকায় বিপুলভাবে চাষের ক্ষতি হতে শুরু করে,পরিবেশ প্রকৃতি প্রায় শুকিয়ে যেতে থাকে।
কিঙ্করী দেবী স্পষ্টতই বুঝতে পারেন, প্রকৃতির এই শুকিয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ পর্যাপ্ত পরিমাণে জলের অভাব, যার উৎস চুনাপাথরের জন্য চালানো খননকার্য। এ বিষয়টি চোখের সামনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি এই সম্পর্কের স্থানীয় মানুষজনকে সচেতন করতে তৎপর হন, এবং সেই স্থানীয় মানুষজন ও একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে পাশে নিয়েই তিনি ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন খননকার্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন। এই আন্দোলনের দাবিতে তিনি ৪৮ জন খনি-মালিকের বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা করেন শিমলা হাইকোর্টে। কিন্তু শিমলা হাইকোর্টের রায় পক্ষে ছিল না কিঙ্করী দেবীদের। মামলায় হেরে গেলেও সেখানেই থেমে যাওয়ার মত মানুষ নন তিনি। অতএব শুরু হল তাঁর এক টানা প্রায় ১৯ দিনের অনশন। সমস্ত দেশ জুড়েই এর প্রভাব পড়তে থাকে। এই একাকী আন্দোলন তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করলে শিমলা হাইকোর্ট পুনরায় এই কেসটি নিয়ে ভাবনাচিন্তা শুরু করতে বাধ্য হয় এবং দ্বিতীয়বার এজলাশে এই কেস উঠলে, সেইবার আদালত বাধ্য হয় খননকার্যে আপাতভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে। পরবর্তীকালে সুপ্রিম কোর্টও রায় দেয় কিঙ্করী দেবীদের পক্ষেই।
আরও পড়ুন : বাঁধ এবং বাধা – মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা
এর পর থেকেই ধীরে ধীরে পরিবেশ রক্ষাকারী হিসাবে পরিচিতি পেতে থাকেন কিঙ্করী দেবী। ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে আন্তর্জাতিক মহিলা সম্মেলনে সম্মান প্রদানের জন্য কিঙ্করী দেবীকে বিশেষভাবে আহ্বান জানানো হয়। ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে ‘ঝাঁসি কি রানি লক্ষ্মীবাঈ স্ত্রী শক্তি’ পুরস্কারে পুরস্কৃত হন তিনি। মহীয়সী এই নারী ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে ৮২ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন।
জাতীয় সংবাদমাধ্যমের কাছে তিনি হয়ত সেইভাবে হেডলাইন হয়ে উঠতে পারেননি, পরিবেশ বাঁচাতে চেয়ে জেলে যাওয়ার যুগে তিনি এক বিস্মৃতপ্রায় অধ্যায়; তবু তাঁর জীবন আমাদের বুঝতে শেখায় কেতাবি শিক্ষার বাইরেও প্রকৃতিশিক্ষার বোধ থাকা জরুরি, সেই শিক্ষার অস্ত্রে এই নীলগ্রহ ভালো রাখার লড়াই চালিয়ে যাওয়া দরকার। কিঙ্করী দেবীর কাহিনি তাই আমরা ফিরে ফিরে দেখি। প্রতিবার।
...........................
#Kinkri Devi #environmentalist #Himachal Pradesh # illegal mining #Nature #পরিবেশ #পরিবেশকর্মী #প্রাণচক্র #কিঙ্করী দেবী #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট