পরিবেশ ও প্রাণচক্র

বাঁধ এবং বাধা – মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা

টিম সিলি পয়েন্ট Feb 17, 2021 at 4:52 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

কেরালার বিখ্যাত পেরিয়ার অভয়ারণ্য সংলগ্ন অঞ্চলে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এক উঁচু অংশে অবস্থিত মুল্লাপেরিয়ার বাঁধটি। এ বছর ১২৬-এ পা দেওয়া এই বাঁধটি ব্রিটিশ প্রযুক্তিবিদদের নির্মাণ। এই বাঁধ তার ‘ডিজাইন লাইফ’-এর ৫০ বছর অতিক্রম তো করেছেই, উপরন্তু আরও দেড়গুণ বেশি সময় পেরিয়ে আজও অটুট। তবে সম্প্রতি একে ঘিরে অশনি সংকেত ঘনিয়ে এসেছে।

অশনি সংকেত অবশ্য আগে থেকেই ছিল। বাঁধটি যে অঞ্চলে অবস্থিত তা ভূমিকম্পপ্রবণ। বাঁধটির বয়সও যথেষ্ট। তাই কেরলের সাংসদ এন. কে. প্রেমচন্দ্রন পেরিয়ার নদীর ওপর ৫৩.৬ মিটার উচ্চতার এই বাঁধটিকে একটি ‘টিকিং টাইমবম্ব’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রেমচন্দ্রন কেরালার জলসম্পদ মন্ত্রী থাকাকালীন (২০০৬-২০১১) বাঁধটির সুরক্ষার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আইআইটি-রুরকি ও আইআইটি-দিল্লীকে অনুমোদন দেন। দুটি প্রতিষ্ঠানই জানায় যে অবিলম্বে বাঁধটিকে কর্মবিরতি দেওয়া দরকার। রাজনৈতিক আকচাআকচি ও আইনি জটিলতায় এই অতি জরুরি বিষয়টির দিকে তেমন কেউই নজর দেননি। 

এ বছর ২২শে জানুয়ারি ‘ইউএন ইউনিভার্সিটি – ইন্সটিটিউট ফর ওয়াটার, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হেলথ্’ কর্তৃক প্রকাশিত এক রিপোর্টে এই বিষয়টি আবার আলোচনায় উঠে এসেছে। এই রিপোর্টে বিশ্বের বৃহৎ যে বাঁধগুলির কর্মবিরতি আবশ্যক, তাদের একটি তালিকা এই রিপোর্টে পেশ করা হয়েছে এবং মুল্লাপেরিয়ার বাঁধকে এই তালিকায় রাখা হয়েছে। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে যে জননিরাপত্তা, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ, জলাধার পলিতকরণ, পরিবেশ পুনরুদ্ধার ইত্যাদি সমস্ত জরুরি বিষয়েই মুল্লাপেরিয়ার বাঁধের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া আশু প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন যে এই রিপোর্টটি মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ নিয়ে পুরনো আলোচনাটিকে নতুন করে উস্কে তুলবে এবং প্রশাসন ও সুপ্রিমকোর্ট বাঁধটির কর্মবিরতি প্রক্রিয়া নিয়ে তাড়াতাড়িই সিদ্ধান্ত নেবেন। জলসম্পদ ও জলবিপর্যয়-বিশেষজ্ঞ দুমিন্দা পেরেরা,  যিনি এই রিপোর্ট-কমিটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি বলেছেন যে, এই বাঁধটিকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় অবস্থিত কাঠামোগত ত্রুটিযুক্ত একটি পুরোনো অথচ ক্রিয়াশীল বাঁধের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে, যার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাজনৈতিক চাপানউতোর ও পরিবেশগত জটিলতা।

কাঠামোগতভাবে স্বাস্থ্যবান হওয়া সত্ত্বেও বড়ো বাঁধগুলিকে বিশেষজ্ঞরা সাধারণভাবে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বলেই গণ্য করেন, কারণ ছোট কোনও গণ্ডগোল ঘটলেই এরা জনজীবন ও সম্পদের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে। তবে তাঁদের মতে, কর্মবিরতি-বিষয়ক সিদ্ধান্ত অবশ্যই সুচিন্তিত ও সুগভীর পর্যালোচনার পরই নেওয়া উচিত কারণ একটি বাঁধের সঙ্গে সেই অঞ্চলের সমাজ ও অর্থনীতি অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। 

তামিলনাড়ু সরকার বাঁধটির কর্মবিরতি প্রসঙ্গে বরাবরই নেতিবাচক অবস্থান নিয়েছে এবং কঠোর বিরোধিতা করে এসেছে। কারণ তৎকালীন ত্রাভাঙ্কোর প্রিন্সলি স্টেট (বর্তমান কেরল) ও ব্রিটিশ সরকারের মধ্যে হওয়া চুক্তি অনুযায়ী তারা একটি লিজ্‌ পায় যার মাধ্যমে এই বাঁধটি পরিচালনা করে তারা বার্ষিক ৬৪০ মিলিয়ন কিউবিক মিটার জল নিজেদের রাজ্যে কৃষি এবং শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহার করে থাকে। তবে বাঁধটির সুরক্ষা বিষয়ে উপযুক্ত ব্যবস্থাগ্রহণেরও দাবি জোরালো হয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিগত কয়েক বছরে বিশ্বব্যাঙ্ক ভারতে বাঁধগুলির পুনর্বাসন ও উন্নয়নমূলক কর্মসূচিতে ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

বিশ্বের বড়ো বাঁধগুলির ৪০ শতাংশই চিনে। চিনে মোট ২৩,৮৪১ টি বড়ো বাঁধ রয়েছে। সরকারী নথি অনুযায়ী ভারতে বড়ো বাঁধের সংখ্যা ২০৯, যাদের প্রতিটিই শতবর্ষপ্রাচীন।  এগুলির নকশাপদ্ধতি ও সুরক্ষাপ্রণালী আজও স্বীকৃত মানের অনেক নীচে। কেরল সরকারের  নিয়োগ করা বিশেষজ্ঞ দলের সদস্য ভূতাত্ত্বিক সি.পি. রাজেন্দ্রন-এর মতে, ভারত ও চিন হিমালয়ের পরিবেশ ও ভূমিকম্প-সংক্রান্ত দুর্বলতা, আবহাওয়া পরিবর্তন ও বন্যা পরিস্থিতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বাঁধনির্মাণ অব্যাহত রাখায় সমস্যা আরও বেড়েছে। পরিবেশগতভাবে সংবেদনশীল স্থানে বাঁধ নির্মাণ ও পরিচালনা করার বিপদ যে কতখানি তা সপ্তাহখানেক আগে উত্তরাখন্ডে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকেই স্পষ্ট।

আরও পড়ুন : রাচেল কারসন : পরিবেশ-আন্দোলনের জননী / সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় 

আইআইটি রুরকি-র গবেষণা অনুযায়ী মুল্লাপেরিয়ার বাঁধে ৪১ মিটার জলতল থাকাকালীন যদি ৬.৫ মাত্রার ১৬ কিমি ব্যাসের ভূকম্পন হয় তবে বাঁধ কাজ করার ক্ষমতা হারাবে, ফলে কেরালার ৩.৫ মিলিয়ন মানুষের জীবনহানির আশঙ্কাও দেখা দেবে। এই অবস্থায় প্রশ্ন একটাই। প্রশাসন কি শীতঘুম ভেঙ্গে গবেষকদের দাবিকে প্রাধান্য দিয়ে মানবজীবন ও পরিবেশসম্পদের সুরক্ষার্থে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবে? নাকি ফের রাজনীতির অলিন্দে এসে আইনি জটাজালে জড়িয়ে ধামাচাপা পড়ে যাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি, যতদিন না কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটে যায়? উত্তরটা বরাবরের মতো সময়ের গর্ভেই। 

.......................................
#মুল্লাপেরিয়ার বাঁধ #kerala #Mullaperiyar Dam #Periyar River #Western Ghats #Environment #পরিবেশ #Sustainable Development #টিম সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

214991