রাচেল কারসন : পরিবেশ-আন্দোলনের জননী
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ের কথা। আধুনিকতার স্বাচ্ছন্দ্য আর সব সমস্যার চটজলদি সমাধান তখন মানবসভ্যতার অগ্রগতির একমাত্র মন্ত্র হয়ে উঠেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চাষবাসের ক্ষেত্রে কীটনাশক রাসায়নিক শিল্প দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। কৃষিজমির ফসল পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচাতে এবং সেইসঙ্গে মানুষকে মশা মাছির ইত্যাদি পোকামাকড়ের উপদ্রব এর হাত থেকে রক্ষা করতে মেড ইজি পন্থাই হল বিপুল পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রমরমা বাড়তে থাকে কীটনাশকের। এরই মধ্যে পোকামাকড়ের হাত থেকে রক্ষা পেতে ম্যাসাচুসেটসের ডাকসবেরি স্থানের কর্তৃপক্ষ ডিডিটি নামক এক ধরনের কীটনাশক বিমানের সহায়তায় শহর জুড়ে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। প্রাথমিক ভাবে এর গুণাগুণ মানুষের চোখে পড়লেও কীটনাশক বা ডিডিটি ব্যবহারের ফলে যে মারাত্মক বিষ ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশের মধ্যে, সে বিষয়ে একেবারেই অসচেতন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ। জনগণের টনক নড়ল, যখন দেখা গেল এই ডিডিটি স্প্রে করার ফলে সেই অঞ্চলের ওলগা ওয়েন্স হাকিন্সের পাখিশালার বেশ কিছু পাখি মারা যায়। হটাৎ করে একসঙ্গে এতগুলি পাখির মৃত্যু সচেতন কাউকে কাউকে বেশ ভাবিয়ে তুলল। এই আকস্মিক পাখি-মৃত্যুর কারণ খোঁজার দায়িত্ব নেন জলজীব-বিশারদ ও পরিবেশবিদ রাচেল কারসন।
রাচেলের জন্ম ১৯০৭ সালের ২৭ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া শহরে। ছেলেবেলা থেকেই পরিবেশ, প্রকৃতি ও বন্যজীবন সম্পর্কে বিশেষ ভাবে আগ্রহী ছিলেন তিনি। ওলগা ওয়েন্সের বন্ধুত্বের সঙ্গে সূত্রেই প্রাথমিকভাবে পাখি মৃত্যু বিষয়ে তদন্তের কাজে হাত দেন তিনি। সেই পরীক্ষা থেকেই জানা যায় সেই বিমানের সাহায্যে ডিডিটি ছড়িয়ে দেওয়ার তার বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থই পাখিদের মৃত্যুর কারণ। এটি জানার পরেই রাচেল কারসন ডিডিটি ব্যবহারের ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি এ বিষয়ে আরও গবেষণা চালাতে থাকেন। কেবলমাত্র পাখি নয়, সমগ্র জীবজগতের ক্ষতিসাধনে এই ডিডিটির জুড়ি মেলা ভার। বাহ্যিক দিক থেকে এর ব্যবহার আমাদের সাময়িক স্বস্তি দিলেও ডিডিটি ব্যবহারের ফলে এর মধ্যে থাকা বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের প্রয়োগে যে ক্যান্সারের মত মারণ রোগও হতে পারে সে বিষয়েও সচেতন করতে থাকেন তিনি। এই বিষয়ে ১৯৬২ সালে রাচেল প্রকাশ করেন তাঁর বই 'Silent Spring '। অবশ্য এর আগেই পরিবেশ ও প্রাণচক্র বিষয়ে রাচেলের বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছিল। The Sea Around Us, The Edge of the Sea, Chincoteague: A National Wildlife Refuge, Bear River: A National Wildlife Refuge" ইত্যাদি তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু ‘Silent Spring’-ই সবচেয়ে সাড়া ফেলেছিল। রাতারাতি রাচেলকে প্রচারের আলোয় নিয়ে এসেছিল এই বইটি। আধুনিক পৃথিবীতে পরিবেশ-সচেতনতার ক্ষেত্রে এই বইটিকে অগ্রদূত বলা যেতে পারে।
এই বইয়ের জনপ্রিয়তা কীটনাশক প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলিকেও বিপাকে ফেলেছিল। সুতরাং রাচেল কারসনের চলার পথ খুব সহজ ছিল না তা বলাই বাহুল্য। প্রভাবশালী কীটনাশক ব্যবসায়ী সংস্থা থেকে একের পর এক আসতে থাকে বাধা। এমনকি সরকারের পক্ষ থেকেও পাশে থাকার পরিবর্তে অসহযোগিতা এবং পরোক্ষ হুমকি আসতে থাকে তাঁর কাছে। শুরু হয় রাচেলের বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্ত। অবশ্য সৌভাগ্যক্রমে তদন্তের ফলাফলে তাঁর বক্তব্যই মান্যতা পায়।
আরও পড়ুন : বিপন্ন প্রজাতির তালিকায় পৃথিবীর ‘প্রাচীনতম’ ফুলের গাছ টাইটান আরুম
এরপর ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে রাচেল পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য রক্ষা নীতি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে কথা তোলেন। কেবলমাত্র ডিডিটি ব্যবহারের ফলে ঘটে চলা পরিবেশের ক্ষতি বিষয়েই নয়, মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজকর্মের ফলে পরিবেশের ক্রমাগত যে আরও নানাবিধ ক্ষতি হয়ে চলেছে, সেই দিকগুলিকে নির্দেশ করতে থাকেন। আধুনিক সময়ে যে পরিবেশ আন্দোলনের ধারা জন্ম নিয়েছে তা একান্তভাবেই রাচেলের কাছে ঋণী।
পরিবেশ বিষয়ে তাঁর এই অবদানের জন্য এবং পরিবেশ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য তাঁকে সম্মান জানিয়ে ' Mother of the environmental movement ' নামে অভিহিত করা হয়েছে। ১৯৬৪ সালের ১৪ই এপ্রিল তিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পরলোক গমন করেন। মৃত্যুর পরেও তাঁর কিছু উল্লেখযোগ্য লেখা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তাদের মধ্যে The Sense of Wonder, Lost Woods ইত্যাদি বই উল্লেখযোগ্য।
................................
#Rachel Carson #marine biologist #Environmental movement #conservationist #Silent Spring #পরিবেশ #প্রাণচক্র #DDT #কীটনাশক #পরিবেশবিদ #রাচেল কারসন #পরিবেশ আন্দোলন #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট