ইটের বদলে ইলেকট্রিক?
সময় যত এগোচ্ছে, আশেপাশের সবকিছুই চটজলদি স্মার্ট হয়ে উঠছে, এসবের মাঝে আমরাই কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে চলেছি। স্মার্ট ফোন, স্মার্ট টিভি, স্মার্ট হোম এইসব পেরিয়ে এখন আমাদের হাতে আসতে চলেছে স্মার্ট ব্রিক।
ব্রিক? মানে ইট? ঠিকই পড়েছেন, আগুনে পোড়া লালমাটির থান ইট। সেই ইট যা দীর্ঘ পাঁচহাজার বছর ধরে যে কোনও রকম নির্মাণ কাজের গোড়ার কথা হয়ে থেকে গেছে। বাড়ি থেকে ব্রিজ, মেট্রো থেকে মনুমেন্ট সবকিছু তৈরিতেই লালমাটির ইটের মতো অতি সস্তা জিনিসটির সর্বাত্মক বাজার। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের এক ঘোষণা মিস্ত্রি-মজুরদের রুজিরুটির এই পাথেয়টিকে এক ধাক্কায় গবেষণার জগতে খানিক জাতে তুলে দিয়েছে। এতটাই, যে অদূর ভবিষ্যতে এর উপর ব্যবসায়িক লগ্নির আশীর্বাদও নেমে আসতে পারে।
খোলসা করে বলা যাক তবে? ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বিজ্ঞানী মিলে সাধারণ ইটের উপর বিদ্যুৎ-পরিবাহী এক ন্যানোফাইবার পলিমারের আস্তরণ দিয়ে দেখিয়েছেন, সেই ইট বেশ খানিকটা বিদ্যুৎ বেশ কিছু সময়ের জন্য সঞ্চয় করে রাখতে সমর্থ হচ্ছে। এমনকি চাইলে তাই দিয়ে দিব্যি আলো-পাখা জ্বালিয়ে নেওয়া যাবে। ইটের মধ্যে মূলত থাকে সিলিকা, অ্যালুমিনা এবং হেমাটাইট বা আয়রন অক্সাইড যৌগ। বিদ্যুতশক্তি সঞ্চয় করে রাখার আপৎকালীন মাধ্যম, যেমন মোবাইলের লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি, ইত্যাদির প্রস্তুতিতে হেমাটাইট এক অপরিহার্য বস্তু। ইট তৈরির প্রাথমিক পর্যায়ে ফার্নেসের তাপে এই হেমাটাইট অতিক্ষুদ্র ছিদ্রবিশিষ্ট এক কাঠামোর জন্ম দেয়। এমনিতে এই কাঠামো থাকার দরুণ ইট মাত্রেই জল ধরে রাখতে পারে, গাঁথনির কাজ পোক্ত হয়। বিজ্ঞানীরা এই ধর্মটিকে ব্যবহার করেই এর উপরে poly-ethylenedioxythiophene (সংক্ষেপে PEDOT) নামক পলিমারের ন্যানোফাইবার প্রলেপ লাগিয়েছেন। আদতে এই পলিমারটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন একটি তড়িৎ-সুপরিবাহী, যা কিনা হেমাটাইটের অমন অতিসূক্ষ্ম ছিদ্রে আটকা পড়ে সমগ্র ইটকে একটি উচ্চশক্তির তড়িৎ-ধারক বানিয়ে তোলে – সোজা বাংলায় বললে এর কাজ খানিকটা ব্যাটারির সঙ্গে তুলনীয়। উপযুক্ত পরিবেশে এইভাবে বিদ্যুৎশক্তি সঞ্চয় করে রাখা সম্ভব এবং যথাযথ মাধ্যমের উপস্থিতিতে সেই বিদ্যুৎ নিত্যপ্রয়োজনীয় সমস্ত কাজে ব্যবহার করাও সম্ভব। বিজ্ঞানীরা PEDOT-প্রলেপযুক্ত ইটকে একটি আয়ন-স্পঞ্জের সঙ্গে তুলনা করেছেন, যার কাজই হল ইলেকট্রনকে ফাঁদে ফেলে বিপুল পরিমাণ শক্তিকে কব্জা করা। হাতেকলমে পরীক্ষা করার সময় তাঁরা এমন ইটের মাধ্যমে একটি ডায়োড সংযুক্ত করে আলো জ্বালিয়েও দেখিয়েছেন, অন্য কোনোরকম বিদ্যুতের উৎস ছাড়াই!
আরও পড়ুন - যিনি চিনিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে / অর্পণ পাল
আপাতদৃষ্টিতে ম্যাজিক মনে হলেও এই আবিষ্কারের প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এলন মাস্কের দুনিয়া কাঁপানো কারখানা থেকে বেরনো প্রায় সমবৈশিষ্ট্যের জিনিস, Tesla Powerwall-এর তুলনায় এই PEDOT-প্রলেপযুক্ত ইটের শক্তিসঞ্চয়ের ক্ষমতা প্রায় আটগুণ কম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হল ৬ ইঞ্চি পুরু, ২৫০ পাউন্ডের Tesla Powerwall স্থাপন করতে খরচ পড়ে ১০,০০০ মার্কিন ডলার! সেখানে ইটের মতো সস্তা ও সহজলভ্য মাধ্যমের দাম সহজেই অনুমেয়। টেসলা-র ক্রেতাকুল যেখানে ধনকুবের গোষ্ঠী, সেই জায়গায় এই নতুন আবিষ্কারের বাজার আরও উন্মুক্ত, ব্যবসার ক্ষেত্র আরও প্রশস্ত। এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে সেই প্রসঙ্গে সুস্পষ্ট দিশা পেতে হলে প্রয়োজন আরও বেশ কিছু বছরের উদ্যমী গবেষণা আর যথোপযুক্ত অর্থের লগ্নি। কে বলতে পারে, হয়ত আগামী কিছু বছরেই আমরা মোবাইল ফোন দেওয়ালে ছুঁইয়ে রেখেই চার্জ দিতে পারব! বিজ্ঞান যেরকম অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে, একটা সময় নতুন প্রজন্মকে বলার মতো কোনও কল্পবিজ্ঞানের গল্পই বোধহয় আর বাকি থাকবে না।
..............................................
তথ্য ঋণ : Energy storing bricks for stationary PEDOT supercapacitors, Nature Communication, Julio M. D’Arcy
ছবি ঋণ : D'Arcy laboratory, Department of Chemistry, Washington University in St. Louis