বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

যিনি চিনিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে

অর্পণ পাল Oct 6, 2020 at 7:08 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

১৯০৫-এ সুইৎজারল্যান্ডের বার্ন শহরের পেটেন্ট অফিসে ছাব্বিশ বছরের এক অখ্যাত তৃতীয় শ্রেণির টেকনিক্যাল এক্সপার্টের চার-চারটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হল জার্মানির এক বিখ্যাত জার্নালে, মাত্র ছ’মাসের মধ্যে। লেখাগুলির যে কোনও একটাই একজন উচ্চ অ্যাকাডেমিক অবস্থানে থাকা বিজ্ঞানীর কলার তুলে ঘুরে বেড়াবার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, সেখানে চার-চারটি পেপার! ওই বছরটা পরে নির্দিষ্ট করা হল তাঁর জীবনের ‘অ্যানাস মিরাবিলিস’ হিসেবে, সত্যিকারের এক বিস্ময়বর্ষ। একশো বছর পরে ২০০৫ সালটিকে এই ঘটনারই শতবর্ষপূর্তি হিসেবে রাষ্ট্রপুঞ্জ ঘোষণা করেছিল ‘আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বর্ষ’ হিসেবে।

যে মানুষটিকে প্রায় কেউই চিনতেন না, তিনি পদার্থবিদ্যার জগতে প্রায় নিঃশব্দেই এক যুগান্তর এনে দিলেন। আলোক-তড়িৎ ক্রিয়া, ব্রাউনীয় গতি, ভর-শক্তির তুল্যতা (যে সমীকরণটি আমরা সকলেই চিনি, সেই E= mc2), এবং তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত সেই আপেক্ষিকতাবাদ – এই চারটি বিষয়ের ওপর লেখা চারটি পেপার অবশ্য তখনই তাঁকে প্রত্যাশিত খ্যাতি এনে দেয়নি, সেটা পেতে তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও অন্তত পনেরো বছর। বার্ন শহরের ওই অফিসে এর পরে আরও চার বছর ওই চাকরিটিই করতেন তিনি, পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থায়ীভাবে পড়াবার ডাক পান। অ্যাকাডেমিক জীবনে পুরোপুরি প্রবেশ ঘটে তাঁর।

এতক্ষণ যে আমরা আলবার্ট আইনস্টাইনের কথা বলছি, আশা করি সেটা বুঝতে বাকি নেই কারও। ১৯০৫-এর বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদ, আর এর বছর দশেক পরে প্রকাশিত হওয়া সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ (যে তত্ত্ব নির্মাণে আটটা বছর ব্যয় করেছিলেন তিনি) – এই দুই-ই বলতে গেলে তাঁর কীর্তিসৌধের মধ্যে উঁচু হয়ে থাকা সবচেয়ে বড় দুটি স্তম্ভ। অথচ ১৯১৫-এ সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব প্রকাশের পরেও আইনস্টাইনের নাম জার্মানির বাইরে ইউরোপের বৃহত্তর জনসমাজে খুব যে প্রচারিত হয়ে গিয়েছিল তাও কিন্তু নয়। সেটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও পাঁচ বছর, অন্তত যতদিন না এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানীর কাজ সংবাদমাধ্যমের প্রথম পাতায় উঠল।

এই মানুষটির নাম আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন (১৮৮২-১৯৪৪)। আইনস্টাইনের চেয়ে বছর তিনেকের ছোট কেমব্রিজের এই জ্যোতির্বিদ্যার অধ্যাপক ১৯১৯ সালে পশ্চিম আফ্রিকার প্রিন্সিপে নামে এক দ্বীপে অভিযানে গিয়ে ২৯শে মে এক সূর্যগ্রহণ প্রত্যক্ষ করেন ও বিস্তর তথ্য জোগাড় করে এনে হিসেব-নিকেশ করে জানান যে হ্যাঁ, আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ বাস্তবে তাঁর করা পরীক্ষার ফলের সঙ্গে মিলে যাচ্ছেই। সূর্য যে তার পাশ দিয়ে আমাদের দিকে আসা তার পিছনের কোনও তারার আলোকে বাঁকিয়ে দিতে পারে তার প্রবল আকর্ষণের প্রভাবে – সেই বক্রতার পরিমাণটাই হিসেব করে দেখালেন তিনি। আর আলো বেঁকে আমাদের চোখে (বা টেলিস্কোপের মতো অন্য কোনও আলোকধারক যন্ত্রে) এসে পড়া মানেই ওই দূরের তারাটিকে আমরা দেখব কিছুটা পরিবর্তিত অবস্থানে, যে অবস্থানটাও, এডিংটন হিসেব করে দেখলেন, মিলে যাচ্ছে আইনস্টাইনের তত্ত্বে বলা হিসেবের সঙ্গে। আইজ্যাক নিউটনের মহাকর্ষ বল অনুসারে এই হিসেব ছিল কিছুটা আলাদা (নিউটন নিজেই ১৭০৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘অপটিক্স’ বইয়ে লিখেছিলেন বস্তুর আকর্ষণের প্রভাবে আলোর বেঁকে যাওয়ার সম্ভাব্যতার কথা। যদিও সেই হিসেব তিনি নিজে করেননি, প্রায় একশো বছর পরে জার্মান গণিতজ্ঞ যোহান জর্জ ফন সোল্ডনার তা প্রথম করেছিলেন), সুতরাং আইনস্টাইনের তত্ত্ব ঠিক প্রমাণিত হওয়া মানে নিউটনের তত্ত্বের ব্যর্থতা, আর সেখান থেকেই চলে আসে এই ধারণা যে আইনস্টাইন হারিয়ে দিয়েছেন নিউটনকে। ভিড়ে ঠাসা রয়্যাল সোসাইটির সভাঘরে যখন তাঁর এই পরীক্ষার ফলাফল ব্যাখ্যা করছেন এডিংটন, সাংবাদিকেরা অধীর আগ্রহ নিয়ে শুনছিলেন আর অপেক্ষা করছিলেন এটা জানতে, নিউটন আর আইনস্টাইনের মধ্যে শেষ অব্দি কে জিতলেন। ব্যাপারটার গুরুত্ব এতটাই, সোসাইটির প্রেসিডেন্ট জোসেফ জন থমসন এই ঘটনাকে বললেন, ‘one of the highest achievements in human thought’। পরেরদিন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় সবাই পড়ল এই আবিষ্কারের খবর, আর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন আইনস্টাইন। সেই খ্যাতির ভাগ পেয়েছিলেন এডিংটনও, বলাই বাহুল্য।

আইনস্টাইনের নিজেও এর আগে তাঁর তত্ত্বের বাস্তবতা প্রমাণের উদ্দেশ্যে এই ধরনের পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা করেছিলেন, পারেননি। তাঁর সেই কাজকে যেন সফল করার বাসনা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী এডিংটন। যাঁর কাজের ফলাফলই আইনস্টাইনের নাম পৌঁছে দিয়েছিল আপামর জনগণের গেরস্থালির অন্দরে। আইনস্টাইন হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃত অর্থেই এক আন্তর্জাতিক সেলেব্রিটি, যে তকমা তাঁকে বহন করতে হয়েছিল জীবনভর। কিন্তু এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না। আইনস্টাইনের তত্ত্বকে প্রমাণ করবার জন্য কেন জান লড়িয়ে দেবেন এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী? আইনস্টাইন জাতে ইহুদী-জার্মান; এডিংটন ব্রিটিশ, ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টান। ধর্মপরিচয়ে তাঁরা যেমন আলাদা, তেমনই ফারাক ছিল জাতিগত দিকেও। আর ওইরকম একটা সময়ে, যখন একটা রক্তক্ষয়ী বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আর ব্রিটেন লড়ে চলেছে যুযুধান দুই পক্ষে, তখন দেশগত শত্রুতার মুখোশে নিজেকে আটকে না রেখে শুধুমাত্র বিজ্ঞানের স্বার্থেই এডিংটন ওই সময়টায় মেতে উঠেছিলেন এক ‘শত্রু’ দেশের বিজ্ঞানীর তত্ত্বকে যাচাই করে সফল করে তোলার প্রচেষ্টায়! নিজে ১৯১৬ সাল থেকে শুরু করে দীর্ঘদিন ধরে চর্চা করেছিলেন আইনস্টাইনের তত্ত্বের। যার অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি তাঁর বইগুলি – ১৯১৮-য় লেখা ‘রিপোর্ট অন দ্য রিলেটিভিটি থিওরি অব গ্র্যাভিটেশন’, ১৯২০-র ‘স্পেস, টাইম অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশন’, আর ১৯২৩-এর ‘দ্য ম্যাথেমেটিক্যাল থিওরি অব রিলেটিভিটি’। এই শেষের বইটাকে স্বয়ং আইনস্টাইন বলেছিলেন তাঁর তত্ত্বের অন্য কোনও ভাষায় অনূদিত হওয়া সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা। আপেক্ষিকতাবাদ বিষয়টিতে এডিংটন যে নিঃসন্দেহে প্রধানতম দক্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন, এটা ততদিনে সকলেই মেনে নিয়েছেন।

এডিংটন যদি ব্রিটিশ না হতেন, পারতেন কি এই কাজটা সফলভাবে ঘটিয়ে তুলতে? কেমব্রিজের অধ্যাপনার পাশাপাশি, ভুললে চলবে না, তিনি ছিলেন কেমব্রিজের অবজারভেটরির নির্দেশক। সেই সুবাদে ঘনিষ্ঠতা ছিল ব্রিটেনের অ্যাস্ট্রোনোমার রয়্যাল ফ্র্যাংক ডাইসন-এর সঙ্গে। এঁরা দুজনেই যুদ্ধ চলাকালীন নিজেদের প্রভাব খাটিয়ে জোগাড় করতে পেরেছিলেন আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতাবাদ সংক্রান্ত পেপারটি, বুঝতে পেরেছিলেন এর গুরুত্ব। পরবর্তীকালে সূর্যগ্রহণ দেখতে যাওয়ার যে অভিযান, তার আর্থিক সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে এই ডাইসনই সবচেয়ে বেশি সহায় হয়েছিলেন এডিংটনের।

অবশ্য এর আগে এরকম অভিযান চালানো হয়েছে বহুবার। আগেই বলেছি, আইনস্টাইন নিজে উদ্যোগী হয়েছেন একাধিকবার, পাঠিয়েছেন চেনা-পরিচিত দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীদের, কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ সব প্রচেষ্টায় জল ঢেলে দিয়েছিল। জার্মান যে সব জ্যোতির্বিদ সূর্যগ্রহণ দেখতে গিয়েছিলেন রাশিয়ার ক্রিমিয়া দ্বীপে, তাঁদের কাউকে কাউকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দেশে, অথবা রাখা হয় আটক করে। এডিংটনও চেষ্টা করেছেন আগে, পারেননি। ১৯১৮ সালের নভেম্বরে যুদ্ধ শেষ হলে নেমে পড়লেন আবার এবং সেবারে সফল হলেন। পরে তিনি বলবেন, ‘I knew that Einstein’s theory had stood the test and the new outlook of scientific thought must prevail.’

এডিংটন ভাগ্যের সহায়তাও পেয়েছিলেন বৈকি। সেইসময় ওই দ্বীপের আবহাওয়া ছিল বেশ খারাপ, যে জন্য তিনি কাঙ্খিত সংখ্যক পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাননি; তাছাড়া স্টিমার কোম্পানির আসন্ন ধর্মঘটের জন্য তাঁকে একটু আগেভাগেই চলে আসতে হয়েছিল দ্বীপ ছেড়ে। পরে নানা কারণে এডিংটনের এই পরীক্ষার ফলাফলকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে অভিযোগ উঠেছে নানা মহল থেকে। তিনি নিজের ধারণা বা বিশ্বাসকেই পরীক্ষার সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত করার একটা অভিলাষ সবসময়েই মনের মধ্যে লালন করতেন, যে কারণে নাকি পরীক্ষার ফলাফলে কিঞ্চিৎ জল মিশিয়েছিলেন – এমনও অভিযোগ উঠেছে। ১৯৪৪ সালে এডিংটনের মৃত্যুর পর তাঁর সেই অভিযানের মূল ছবির প্লেটগুলো কোনওভাবে নষ্ট হয়ে যায়, সেসব দেখার কোনও সুযোগ মেলে না আর। এই বিতর্ক ফিরে ফিরে এসেছে একাধিক বইয়ের বিষয়বস্তু হিসেবে, যেগুলোর মধ্যে নাম করা চলে ম্যাথিউ স্ট্যানলি-র লেখা ‘আইনস্টাইন’স ওয়ার: হাউ রিলেটিভিটি কনকারড ন্যাশানালিজম অ্যান্ড শুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইটির। তবে এডিংটন তাঁর হিসেবে গোঁজামিল দিন বা না দিন, আইনস্টাইন তাঁর অবিসংবাদিত খ্যাতির চূড়ায় অটল থাকবেন আরও বহুদিন, এ নিঃসন্দেহে বলা চলে।

#বাংলা #বিজ্ঞান #আইনস্টাইন #পদার্থবিদ্যা #আপেক্ষিকতাবাদ #আন্তর্জাতিক পদার্থবিদ্যা বর্ষ #আর্থার স্ট্যানলি এডিংটন #রয়্যাল সোসাইটি #জোসেফ জন থমসন #রিপোর্ট অন দ্য রিলেটিভিটি থিওরি অব গ্র্যাভিটেশন #স্পেস # টাইম অ্যান্ড গ্র্যাভিটেশন #দ্য ম্যাথেমেটিক্যাল থিওরি অব রিলেটিভিটি # ফ্র্যাংক ডাইসন #আইনস্টাইন’স ওয়ার: হাউ রিলেটিভিটি কনকারড ন্যাশানালিজম অ্যান্ড শুক দ্য ওয়ার্ল্ড #Bengali #Science #Albert Einstein #Physics #Theory of Relativity #International year of Physics #Arthur Eddington #Royal Society #Joseph John Thompson #Report of the Relativity Theory of Gravitation #Space Time and Gravitation #The Mathematical Theory of Relativity #Frank Dyson #Einstein's War: How Relativity Conquered Nationalism and Shook the World

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

214990