ফিচার

পূজাবার্ষিকীর রকমসকম

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য Oct 9, 2021 at 4:07 am ফিচার

কতই বা বয়স হবে তখন, পাঁচ কি ছয় বছর। বই পড়া তখনও ছবিতে রামায়ণ মহাভারত, চাচা চৌধরী, হি-ম্যান আর অরণ‍্যদেবে সীমাবদ্ধ। এমন সময় বাবা হঠাৎ একদিন এক ইয়া মোটকা বই এনে হাতে দিয়ে বলল, এটা পড়। আমি তো থতোমতো, ওরেববাবা, এ তো বিশাল বই! প্রচ্ছদে বড় বড় করে দেখি লেখা আছে, আনন্দমেলা। খানিক ভয়ে ভয়ে খুলে পাতা ওলটাতে দেখলাম, বেশ রংচঙে ছবির সঙ্গে একটা গল্প (তখনও উপন্যাস শব্দের মানে জানি না, স্বাভাবিকভাবেই), নাম দেওয়া ‘আলোর আকাশে ঈগল’, লেখক শৈলেন ঘোষ। পড়তে গিয়ে দেখি ওমা, এ যে আমার মতোই একটা বাচ্চা ছেলের জবানিতে লেখা! শিজুমন বলে এক ছেলেমানুষের গল্প, ঠিক সেই সময়, যখন নিওলিথিক এজ পেরিয়ে মানুষ ধাতুর ব্যবহার শিখতে শুরু করেছে, ঈশ্বরের কল্পনায় প্রাকৃতিক শক্তির পাশাপাশি জায়গা পাচ্ছে বিমূর্ত ধারণা। শিজুমন ছিল এক খোদাইকর, সুতরাং সেই অর্থে ধাতুর নিয়মিত ব্যবহারকারী হিসেবে তাকে নবীন যুগের ধারক বলা যেতেই পারে। পড়তে পড়তে বুঁদ হয়ে গেলাম, শিজুমন তখন আক্ষরিক অর্থেই আমার শয়নে স্বপনে। শুরু হল বাংলা পূজাবার্ষিকীর সঙ্গে আমার গভীর সখ্য।

আনন্দমেলা পূজাসংখ্যা তখন প্রকৃতপক্ষেই চাঁদের হাট। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, মতি নন্দী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শৈলেন ঘোষ- কে নেই! অলংকরণে বিমল দাস, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়, সুব্রত চৌধুরী এবং অবশ্যই দেবাশীষ দেব। খবরের কাগজে প্রথম বিজ্ঞাপন বেরোনোর পর থেকে প্রায় নাওয়াখাওয়া শিকেয় তুলে শুরু হত রুদ্ধশ্বাস প্রতীক্ষা- কবে হাতে পাব! শিশুমনের কাছে নতুন অভিজ্ঞতার হাতছানি বরাবরই আকর্ষণীয়, কারণ বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মন অনেক খোলা, নতুনকে তারা অনেক সহজে গ্রহণ করতে পারে, করতে চায়। তাই তো দুর্গম উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে উপেন্দ্রকিশোরের কলকাতার বাড়িতে এসেও সুন্দর মানিয়ে নিতে পারেন বালিকা লীলা মজুমদার, ইংল্যান্ড থেকে গ্রিসের করফু দ্বীপে এসে পরিবারের বাকিরা নানা অভিযোগ জানালেও ছোট্ট জেরাল্ড দুরেল মেতে ওঠেন নিত্যনতুন অভিজ্ঞতার রসাস্বাদনে। আনন্দমেলার চরিত্ররাও তাই বেরিয়ে পড়ত বিভিন্ন জায়গায়, আর পুজোর ছুটিতে কাকাবাবু, পাণ্ডব গোয়েন্দা বা মিতিনমাসির সেই ভ্রমণে সঙ্গী হতাম আমরাও। এ ছাড়া শীর্ষেন্দুর উপন্যাসের গাঁ-গঞ্জ, সমরেশ মজুমদারের উত্তরবঙ্গ, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মফস্সলের বর্ণনা, শৈলেন ঘোষের রাজস্থানের মরুভূমি, তিব্বতের পাহাড় থেকে সুন্দরবনের জঙ্গল প্রভৃতি নিত্যনতুন পটভূমিকা- এও তো ভ্রমণ বইকি! আমরা ছিলাম অর্থনৈতিক উদারীকরণের পরবর্তী প্রজন্ম, কেবল টিভির হাত ধরে বিদেশি সংস্কৃতি তখন ঢুকে পড়েছে আমাদের ঘরে ঘরে। উঠে আসছে ‘বিশ্বায়ন’ বলে একটা নতুন শব্দ। যুগের সঙ্গে তাল রেখেই তাই প্রচ্ছদ তৈরি করত আনন্দমেলা, কখনও সেখানে ফেলুদা শঙ্কু কাকাবাবুর পাশে হাজির টিনটিন অ্যাস্টেরিক্স হ্যারি পটার, কখনও সাইবর্গরূপিণী মা দুর্গা ফ্লেম থ্রোয়ার দিয়ে মহিষাসুর বধ করছেন, কখনও আবার কার্তিকের হাতে শোভা পাচ্ছে সেলফোন। মনে পড়ে দুলেন্দ্র ভৌমিকের বড়গল্প ‘হুলো ডাকাতের আখড়া’, খাস কলকাতা থেকে বিজন নামে একটি ছেলের মেদিনীপুরের গ্রামে চাকরি করতে যাবার সরস আখ্যান। পরবর্তীকালে কর্মসূত্রে মেদিনীপুরে গিয়ে কতবার যে সেই গল্পের বর্ণনার যথার্থতা উপলব্ধি করেছি! 


নারায়ণ দেবনাথের হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট নিয়মিত হাজির হত শারদীয়া শুকতারায়, সঙ্গে ছিল শক্তিপদ রাজগুরুর মজাদার পটলা অ্যান্ড কোং। আজকাল বাচ্চারা ‘ভাইকিংস’ বা ‘দ্য লাস্ট কিংডম’ সিরিজগুলির সুবাদে অল্প বয়স থেকেই ভাইকিং সংস্কৃতি সম্বন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা পায়, আমাদের সময় সেই ধারণা পাওয়ার সম্বল ছিল শুকতারায় অনিল ভৌমিকের ফ্রান্সিসের গল্প, মাঝেমধ্যে আবার তাঁকে আনন্দমেলাতেও পেয়েছি। এ ছাড়াও ছিল কিশোর ভারতী, আর রায় পরিবারের দুষ্প্রাপ্য নানা সুলুকসন্ধান নিয়ে ‘সন্দেশ’।

আরও পড়ুন : দুয়ারে দুর্গা / অধীর পাঠক 

তবে স্কুলজীবনে লুকিয়েচুরিয়ে বড়দের পূজাবার্ষিকীও পড়েছি নিয়মিত। শুধু পড়েছি না বলে বোধহয় ‘দেখেছি’ শব্দটাও যোগ করা উচিত- আনন্দলোক পূজাবার্ষিকীতে রগরগে বর্ণনাসংবলিত নায়ক-নায়িকাদের পাতাজোড়া পোস্টার দেখতে আমাদের প্রজন্মে হুড়োহুড়ি পড়ে যেত, আজকাল ইনস্টাগ্রাম আর পিন্টারেস্টের দাপটে আর ওইসব বাসি ছবি পাত্তা পায় না। স্বল্প পরিসরে খুবই মানসম্মত উপন্যাস বের হত ‘পত্রিকা’-র শারদীয়া সংখ্যায়। রূপক সাহার যৌনপল্লি সম্বন্ধে উপন্যাস ‘লাল রঙের পৃথিবী’, জৈব সন্ত্রাস নিয়ে লেখা ‘জীবাণু’, বন্ধ চটকল নিয়ে সুকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘আদিম জনপদ’ (এটি সে বছর পূজাবার্ষিকীতে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ লেখার পুরস্কার পায়) বা বাঘমুন্দির ঘটনা নিয়ে লেখা বাণী বসুর ‘ট্রেকার্স’ পড়েছি পত্রিকাতেই। স্কুলজীবনের মাঝামাঝি আত্মপ্রকাশ করল ‘উনিশ কুড়ি’, কলেজ জীবন নাগাদ তার শারদীয়া সংখ্যা মোটামুটি অবশ্যপাঠ্য হয়ে দাঁড়াল। এই পত্রিকার হাত ধরেই এক নতুন ধরনের যুবকেন্দ্রিক লেখা উঠে এল, যার বিষয়বস্তু এই নব্যধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় অভ্যস্ত শপিং মল-মাল্টিপ্লেক্সগামী এক প্রজন্ম। এখন স্মরণজিৎ চক্রবর্তীকে গালাগাল দেওয়া একটা ফ্যাশনে দাঁড়িয়ে গেছে, যার জন্য তাঁর লেখার একঘেয়েমি অনেকটাই দায়ী, কিন্তু দক্ষিণ কলকাতার রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি আমার মতো অনেক ছেলেমেয়েকে প্রথম হাত ধরে ঘুরিয়েছে ‘পাখিদের শহরে যেমন’ বা ‘ক্রিসক্রস’ প্রভৃতি স্মরণজিতের উপন্যাসগুলোই। এ ছাড়াও নিম্নমধ্যবিত্তদের নিয়ে সৌরভ মুখোপাধ্যায়ের ‘সাপলুডো’ বা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন নিয়ে দেবতোষ দাশের ‘হলুদ কোকাবুরা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। শারদীয় দেশ অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ, তবে পাক্ষিক দেশের মননশীল প্রবন্ধগুলির অভাব সেখানে বড় বেশি স্পষ্ট। উপন্যাস এবং গল্পের জন্য যেখানে পূজাবার্ষিকী আনন্দবাজার পত্রিকা আছেই, সেখানে দেশের পূজাসংখ্যায় কি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ আরেকটু বেশি জায়গা দাবি করতে পারে না? সম্পাদকেরা প্রসঙ্গটি ভেবে দেখলে মন্দ হয় না।

আরও পড়ুন : ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো / তোড়ি সেন

আজকাল অনেক মানুষকেই হতাশা প্রকাশ করতে শুনি পূজাবার্ষিকী নিয়ে। তাঁদের অভিযোগ বিভিন্ন রকমের- পাঠকেরা বলেন পূজাবার্ষিকীর মান পড়ে যাচ্ছে, লেখকেরা বলেন মানুষ আর বইপত্র পড়তে আগের মতো উৎসাহী নয়, প্রকাশকেরা মাঝেমধ্যে বিক্রি কমে যাচ্ছে বলে পিডিএফ বানানোর প্রযুক্তির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেন। অতি সম্প্রতি এক প্রথম সারির পূজাবার্ষিকীর লেখিকা তাঁর ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে পাঠকদের উদ্দেশে রীতিমতো আক্রমণাত্মক কথাবার্তা বলে অনেকের বিরাগভাজন হলেন। আসলে ভাববার বিষয় একটা নয়, একাধিক। সংস্কৃতির ধারক ও বাহকেরা শুনলে যতই রেগে কাঁই হয়ে যান না কেন, এ কথা মানতেই হবে যে বর্তমান বাজারসর্বস্ব দুনিয়ায় শাড়ি জামা ফুলদানি বা ফিশ ফ্রাইয়ের মতো পূজাবার্ষিকীও একটা প্রোডাক্ট। ফি বছর পুজোর সময় ছোট বড় সেজ মেজ হরেক পত্রিকা যে স্থূলকায় পূজাসংখ্যা প্রকাশ করবার হিড়িকে গা ভাসায়, তা কিন্তু উৎসবের সময় মানুষের কেনাকাটার অভ্যেসের সুযোগ নিয়ে ব্যবসা খানিক বাড়িয়ে নেবার জন্যই। সুতরাং পাঠক এখানে ক্রেতাবিশেষ, সংস্কৃতির পাদপদ্মে কোনোরকম দাসখত তিনি লিখে আসেননি। জুতো পছন্দ না হলে পাশের দোকানে যাওয়ার মতোই পূজাবার্ষিকীর মান পছন্দ না হলে তাঁর না কেনার অধিকার রয়েছে একশবার।   ইন্টারনেট বিপ্লবের পর এখন বিশ্বসংস্কৃতি আক্ষরিক অর্থেই প্রত্যেক মানুষের পকেটে, তাই পছন্দ করবার ক্ষেত্রটাও এখন অনেকটাই বেশি প্রসারিত। পূজাবার্ষিকীর নতুন রহস্য গল্প পড়ে এখনকার কিশোররা খালি ফেলুদার সঙ্গে তুলনা টানে না, তাদের মাথায় ঘোরে স্টিফেন কিং, ডিসি মারভেল বা স্ট্রেঞ্জার থিংস। উনিশ কুড়ি ঘিরে সেই উন্মাদনার ছিটেফোঁটাও আর অবশিষ্ট নেই, টিন এজাররা এখন মনের রসদ পেয়ে যায় দ্য হাঙ্গার গেমস, এন্ড অফ দ্য ফাকিং ওয়ার্ল্ড বা সেক্স এডুকেশন দেখে। ওয়েব সংস্কৃতির বাড়বাড়ন্ত এবং ইবুকের সহজলভ্যতার এই যুগে বই কিনে পড়া যে ভালোরকম চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে? এ ছাড়াও মোবাইল ফোনের সর্বগ্রাসী প্রাধান্যে বইপড়ার অভ্যাস যে নতুন প্রজন্মের মধ্যে আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে, এ কথা অনস্বীকার্য। বাড়ছে মনঃসংযোগের অভাব, টানা বসে একটা গোটা উপন্যাস শেষ করে ফেলার রেওয়াজ ক্রমশ বিরল হয়ে উঠছে। পূজাবার্ষিকীকে এগোতে হবে এইসব পরিবর্তনের কথা মাথায় রেখেই। আজ যেখানে বিশ্বসাহিত্য জাতিভেদ, জলবায়ু পরিবর্তন, সভ্যতার ভবিষ্যৎ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনায় ব্যস্ত, লেখনীর প্রকরণ ও প্রকাশভঙ্গি নিয়ে হামেশাই চলেছে নানারকম পরীক্ষানিরীক্ষা, খোদ বাংলাতেই লেখা হচ্ছে মোমিনশাহি উপাখ্যান বা সুবর্ণরেণু সুবর্ণরেখা জাতীয় নতুন ধাঁচের উপন্যাস, সেখানে পূজাবার্ষিকীর লেখকেরা যদি আজও সেই একইরকমের মধ্যবিত্ত প্রেমের গল্প একইভাবে শুনিয়ে চলেন, তবে পাঠকের বিরক্তি আসতে বাধ্য। ছোটদের পূজাবার্ষিকীগুলিকেও বুঝতে হবে, পুরনো গল্পগুলোকে যেমন তেমন ভাবে কমিকস করে সস্তায় কিস্তিমাত করার রাস্তা চলবে না। আজকের কিশোর কিশোরীরা নিয়মিত ফ্রাঙ্ক মিলারের গ্রাফিক নভেল বা স্টুডিও ঘিবলির আনিমির স্বাদ পায়, ভালো মানের মৌলিক বাংলা কমিকস না পেলে তারা স্রেফ ছুড়ে ফেলে দেবে। ঘুরেফিরে সেই ফেলুদা ছকের ডিটেকটিভ গল্প না ফেঁদে নতুন ধরনের, আরও গতিময় থ্রিলার লেখা শিখতে হবে। এখনকার ধারা অনুযায়ী ইতিহাস, পুরাণ, বিজ্ঞান বা বিশ্ব রাজনীতির ইন্টারডিসিপ্লিনারি মিশেল দিয়ে বিষয়বস্তুকে অভিনব করে তুলতে হবে। লেখকদের যেমন আরও পরিশ্রম করতে হবে, পড়াশোনা করতে হবে, তেমনই অভিনবত্ব আনতে হবে প্রকাশনা এবং বিপণনের ক্ষেত্রেও। পরিবর্তন পৃথিবীর একমাত্র অপরিবর্তনীয় সত্য, তাই পূজাবার্ষিকী সেই নিয়মের ঊর্ধ্বে, এমনটা ভেবে নিয়ে একতরফা পাঠকদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দেওয়াটা কখনোই কোনও কাজের কথা হতে পারে না।                           

...........................

[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

#পুজোর রোয়াক #পূজাবার্ষিকী #দুর্গাপুজো #ফিচার #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #ওয়েব পোর্টাল #Web Portal #বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

31

Unique Visitors

219553