ফিচার

ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপুজো

তোড়ি সেন Oct 8, 2021 at 6:35 pm ফিচার

ঠাকুরবাড়ি বলতে আমরা সাধারণভাবে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িই বুঝি বটে, কিন্তু প্রথমেই মনে করে নেওয়া ভালো যে, আরও একটা ঠাকুরবাড়ি ছিল এই কলকাতাতেই। জোড়াসাঁকোয় বিত্তের সঙ্গে চিত্তের মেলবন্ধন ঘটেছিল, তবে পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির ধার-ভারও নিতান্ত কম ছিল না। দুই ভাই নীলমণি ঠাকুর আর দর্পনারায়ণ ঠাকুরের মধ্যে বিবাদের জেরে দুই বাড়ি আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এমনকি দুই বাড়ির পালকির ঘেরাটোপের রংও ছিল আলাদা। তবে বাড়ি আর হাঁড়ি আলাদা হলেও, পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল, আর ভেতরে ভেতরে ছিল ঠোকাঠুকি বা রেষারেষিও। বিশেষত ব্রাহ্ম জোড়াসাঁকোর চালচলন অনেকসময়ই বরদাস্ত করে উঠতে পারত না নিষ্ঠাবান হিন্দু পাথুরিয়াঘাটা। শোনা যায়, সত্যেন্দ্রনাথ জ্ঞানদানন্দিনীকে লাটসাহেবের পার্টিতে নিয়ে যাওয়ায় লজ্জায় আসর ছেড়েই চলে যান পাথুরিয়াঘাটার প্রসন্নকুমার ঠাকুর। কিন্তু ধর্মাচরণের প্রশ্নে যতই আলাদা হোক না কেন, একটি উৎসব পালন করত দুই বাড়িই। দুর্গাপূজা।

দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বাড়িতে ব্রাহ্ম ধর্মের প্রসার ঘটালেও, তার আগে হিন্দু রীতিরেওয়াজই বজায় ছিল জোড়াসাঁকোতে। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বরাদ্দ ছিল লক্ষ্মীজনার্দনের নিত্যসেবা। দ্বারকানাথের রমরমা বাণিজ্যের দৌলতে তখন সত্যিই সে বাড়িতে লক্ষ্মীর অচলা আসন। যদিও দুর্গাপুজো সে বাড়িতে শুরু হয়ে গিয়েছিল আগেই, সেই ১৭৮৪ সালে। প্রতিমা তৈরি হত জোড়াসাঁকোর নিজস্ব ঠাকুরদালানে। ঠাকুরবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নীলমণি ঠাকুরের হাতে সংকল্প হয়েছিল সে পুজোর। বৈষ্ণব বলে সে বাড়িতে হিংসার প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমনকি কুটনো কোটাকে বলা হত তরকারি বানানো, পাছে মনে হিংস্র ভাব জেগে ওঠে। সুতরাং পুজোতে পাঁঠাবলি নয়, বলি দেওয়া হত কুমড়ো। নীলমণির সচ্ছলতা ছিল, তবে ওড়ানোর মতো অঢেল টাকা ছিল না। তেমন বাড়তি টাকা এ বাড়িতে ঢোকে উদ্যোগী পুরুষ দ্বারকানাথের হাত ধরে। ঠাকুরদা পুজো শুরু করেছিলেন, নাতি তাতে এমন রং-রসান চড়ালেন, যে, কলকাতার নামকরা পুজোদের প্রথম সারিতে ঠাঁই করে নিল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজো। পাথুরিয়াঘাটার পুজোর খবর আগাম প্রকাশিত হত সেকালের খবরের কাগজে। কিন্তু দ্বারকানাথের আমলে জোড়াসাঁকোও পিছিয়ে রইল না। 

সেকালে বলা হত, বড়লোক হওয়ার চূড়ান্ত নিদর্শন হল পুজো করা, অর্থাৎ কিনা দুর্গাপুজো। পুরনো কলকাতার সব ধনী বাবুদের বাড়িতে তখন দুর্গাপুজোর চল। আর সেসব জাঁকের পুজো। কোন বাবু কত টাকা খরচ করলেন, কার পুজোতে কী নতুন চমক দেখা গেল, কার বাড়ির প্রতিমা আর কার বাড়ির ভোগ হারিয়ে দিয়েছে বাকি সবাইকে, পুজো শেষ হওয়ার পরেও এইসব গল্পই ঘুরত মানুষের মুখে মুখে। আর সেই তালে তাল মিলিয়ে বাবুদের মধ্যেও চলত একরকমের না-বলা প্রতিযোগিতা। এবার সে দলে নাম লেখালেন দ্বারকানাথ ঠাকুরও।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির কাছেই শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়ি। পুরনো কলকাতার প্রবাদ বলত, মা গয়না পরেন শিবকৃষ্ণ দাঁয়ের বাড়িতে, ভোজন করেন অভয় মিত্রের বাড়িতে, আর নাচ দেখেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে। আসলে অলংকারের ধারে আর ভারে বাকি বড়লোকদের পিছনে ফেলে দিয়েছিল দাঁ বাড়ি। কিন্তু প্রতিবেশীর কাছে হার মানবেন কেন দ্বারকানাথ! ইংরেজ মহল পর্যন্ত তখন  তাঁর অপ্রতিহত প্রতিপত্তি। বেলগাছিয়ার বাগানবাড়ি দেখে চোখ ট্যারা হয়ে যায় সাহেব মেমদের। খোদ সাহেবরা অবধি তখন টাকা ধার করতে আসেন তাঁরই কাছে। এহেন দ্বারকানাথকে টেক্কা দেবেন কে! সেবার প্যারিস থেকে আনা গয়নায় সেজে উঠলেন দেবী। আর সেই গয়না সুদ্ধুই সালংকারা প্রতিমার বিসর্জন হল দশমীর দিন!


বলা হত, দ্বারকানাথের স্ত্রী দিগম্বরীর মুখের আদলেই নাকি গড়া হত ঠাকুরবাড়ির দুর্গাপ্রতিমা। একবার ঠাকুরদালানে চালচিত্র ঢেকে রেখে গেছে পটুয়ারা, আঁকা শেষ। সেই দালানেই পড়তে বসে বাড়ির ছেলেমেয়েরাও। দেবেন্দ্রনাথের বড় মেয়ে সুকুমারী মনের খেয়ালখুশিতে দোয়াতের কালি দিয়ে সেই চালচিত্রের ওপর ইচ্ছেমতো আঁকিবুঁকি জুড়ে দিলেন। তাই দেখে বাড়িতে মহা হুলুস্থুল। পুজোর আর মোটে তিনদিন বাকি। আবার সেই পটুয়াদের ডেকে কোনোমতে কাজ সারা হল তখন।

ঠাকুরবাড়ির পুজোয় আগমনির আকাশে উড়িয়ে দেওয়া হত শঙ্খচিল। সে নাকি পথ দেখিয়ে নিয়ে আসবে দেবীকে। আর বিজয়ার দিন উড়ে যেত নীলকণ্ঠ পাখি, কৈলাসে মহাদেবের কাছে মায়ের যাত্রাসংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এই দশমীই ছিল বছরের মধ্যে মাত্র এক দিন, যে দিন খোলা ছাদে ওঠার অনুমতি মিলত বাড়ির মেয়েদের। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় মেয়ে সৌদামিনী দেবী জানিয়েছেন, দুর্গোৎসবের সময় প্রতিমার কাছে অঞ্জলি দিয়ে তবে জল খেতেন তাঁরা। তিনি লিখেছেন, "আমাদের বাড়িতে যখন দুর্গোৎসব ছিল ছেলেরা বিজয়ার দিনে নূতন পোশাক পরিয়া প্রতিমার সঙ্গে সঙ্গে চলিত- আমরা মেয়েরা সেই দিন তেতালার ছাদে উঠিয়া প্রতিমা বিসর্জন দেখিতাম।"

আরও পড়ুন : পুজোর বাড়ি, বাড়ির পুজো / শুভংকর ঘোষ রায়চৌধুরী

বোঝাই যায়, দুর্গোৎসব বন্ধ হয়ে যাওয়ার দুঃখ রয়ে গিয়েছিল ঠাকুরবাড়ির ছেলেমেয়েদের মনে। তবে দুর্গাপুজো না হলেও জোড়াসাঁকোর বকুলতলার বাড়ি, অর্থাৎ গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে  হত বিজয়া সম্মিলনী। আমোদপ্রমোদের আয়োজনে তাঁর জুড়ি ছিল না। বিজয়ার মস্ত জলসা, আর তারপর খাওয়াদাওয়া, মিষ্টিমুখ, আতর, পান, গোলাপজলের ছড়াছড়ির বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর ছেলে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবন ঠাকুর এ কথাও বলেছিলেন, “আমাদের বাড়িতে পুজো না থাকলেও পুজোর আবহাওয়া এসে লাগত আমাদের বাড়িতে। ষষ্ঠীর আগেই নেমন্তন্ন আসত।” সে নিমন্ত্রণ ছোটকর্তা, অর্থাৎ দ্বারকানাথের ছোটভাই রমানাথ ঠাকুরের কয়লাহাটার বাড়ি থেকে। 

আরও পড়ুন : বাংলার পুজোয় প্রথম থিমের পরশ এনেছিলেন শিল্পী অশোক গুপ্ত / তিস্তা সামন্ত 

সেকালে বারোয়ারি পুজো শুরু হয়নি। বড় বাড়ির পুজোর নিমন্ত্রণপত্র যেত কলকাতার বড়লোকদের কাছে। ঠাকুরবাড়ির নিমন্ত্রণপত্রে নাম থাকত দ্বারকানাথের বাবা রামমণি ঠাকুরের। রাজা রামমোহন রায়ের কাছে পত্র যেতে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন, হয়তো খুশিও হননি। রাজা ততদিনে ব্রাহ্ম ধর্মের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করে ফেলেছেন। তবে নিমন্ত্রণ অবহেলা করেননি। ছেলে রমাপ্রসাদ বিশ্বাসী ছিলেন হিন্দু মতেই, তিনিই নিমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। পরবর্তী কালে দেবেন্দ্রনাথও হাঁটলেন রামমোহনের পথে। ব্রাহ্মধর্ম নিলেন সপরিবারে। ঠাকুরবাড়িতে নিষিদ্ধ হল মূর্তিপূজা। দুর্গাপুজো বন্ধ করতে পারেননি বলে পুজোর সময় চলে যেতেন পাহাড়ে। তবুও তাঁর ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথ ঠাকুর যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন পুজো চলেছিল। তাঁর মৃত্যুর পর কলকাতার বনেদি বাড়ির দুর্গাপুজোর তালিকা থেকে বরাবরের মতোই মুছে যায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাম।

.......................................... 

[পোস্টার : অর্পণ দাস] 

#পুজোর রোয়াক #ফিচার #ঠাকুরবাড়ি #তোড়ি সেন #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #পোর্টাল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

3

Unique Visitors

219597