ভারতে গণহত্যা চালাতে চেয়েছিলেন চার্লস ডিকেন্স
শিউরে উঠলেন তো? ভাবছেন নিশ্চয়ই কে এই মানুষ, ভারতীয়দের ওপর যাঁর এত রাগ? সিপাহি বিদ্রোহের সময়কার কুখ্যাত সেনাপ্রধান জেনারেল নীল, জালিয়ানওয়ালাবাগের খলনায়ক জেনারেল ডায়ার নাকি অত্যাচারী অফিসার চার্লস টেগার্ট? হল না, হল না, ফেল। ওপরের অংশটির লেখকের নাম চার্লস ডিকেন্স, ঊনবিংশ শতাব্দীর কিংবদন্তি ইংরেজ সাহিত্যিক। ১৮৫৭ সালের অক্টোবর মাসে বান্ধবী অ্যাঞ্জেলা বার্ডেট কুটসকে পাঠানো এক চিঠিতে ঠিক এই কথাগুলি লিখেছিলেন তিনি।
চমকে উঠলেন নাকি? ভাবছেন চিরকাল যাঁকে দরদি লেখক হিসেবে জেনে এসেছেন, যাঁর লেখায় একটা পয়সার লোভে অলিভার টুইস্টের কুকুরের মত দৌড়, মাঠের ধারে খড়ের গাদায় ডেভিডের রাত্রিযাপন, বা পুঁচকে ঝাড়ুদার জো-র হাড়ভাঙা খাটুনির বিবরণ পড়ে অজান্তেই আপনার চোখ জলে ভরে উঠেছে, সেই মরমি শিল্পীর এ কী পৈশাচিক রূপ! একটা কথা ভুলে যাবেন না, অলিভার ডেভিড জো - এরা সবাই শ্বেতাঙ্গ, ডিকেন্সের চোখে কখনোই বাদামি ভারতীয় বা আফ্রিকার কালো মানুষরা এদের সমগোত্রীয় নয়। ‘হাউজহোল্ড ওয়ার্ডস’ বলে যে পত্রিকাটি ডিকেন্স সম্পাদনা করতেন, তার ১৮৫৭-৫৮ সালের সংখ্যাগুলোয় সিপাহি বিদ্রোহ সম্বন্ধে একরাশ প্রবন্ধ বেরোয়, এবং ডিকেন্স সেগুলো পড়ে ভারতীয় প্রজাদের উপর ভয়ঙ্কর চটে যান। অনেকেই জানেন না, ইংরেজি ভাষায় সিপাহি বিদ্রোহ অবলম্বনে লেখা সর্বপ্রথম কাহিনিগুলির একটি লিখেছিলেন চার্লস ডিকেন্স এবং উইলকি কলিন্স মিলে। হাউজহোল্ড ওয়ার্ডস’ পত্রিকার ১৮৫৭ সালের বড়দিন সংখ্যায় প্রকাশিত সেই গল্পের নাম ছিল ‘দ্য পেরিলস অফ সার্টন ইংলিশ প্রিজনার্স’। গল্পের পটভূমি মধ্য আমেরিকায় অবস্থিত ‘মসকুইটো’ নামক কাল্পনিক উপকূলে ‘সিলভার স্টোর’ নামক একটি জায়গা হলেও পাঠকের বুঝতে বাকি থাকে না, এখানে ঘুরিয়ে ভারতবর্ষের কথাই বলা হচ্ছে। নায়ক জিল ডেভিস রয়াল মেরিন্সের তরুণ সদস্য। খনি সমৃদ্ধ ব্রিটিশ উপনিবেশটির সুরক্ষার জন্য তাকে সিলভার স্টোরে পাঠানো হয়েছে। কাহিনিতে প্রবেশ ঘটে ক্রিশ্চান জর্জ কিং নামক আধা নিগ্রো আধা আমেরিকান একটি বর্ণসঙ্কর চরিত্রের, এবং তাকে দেখামাত্র ডেভিস বলে ওঠে, ‘কেন জানি না, আমার ব্যাটাকে দেখেই পিছনে এক লাথি কষিয়ে জাহাজ থেকে ফেলে দিতে ইচ্ছে করছিল।’ ডেভিসের সন্দেহকে সত্যি প্রমাণ করে ব্রিটিশ প্রভুদের সঙ্গে বেইমানি করে ক্রিশ্চান জর্জ কিং। মজার ব্যাপার, স্থানীয় প্রজারা বিদ্রোহ করে বসলে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন কার্টনের মুখে শোনা যায় ডিকেন্সের চিঠির প্রতিধ্বনি- ‘ঈশ্বরের আশীর্বাদে এই শয়তানগুলোকে আমি পৃথিবী থেকে একেবারে সাফ করে ছাড়ব।’
আফ্রিকানদের প্রতি ডিকেন্সের অন্যান্য লেখায় যে মনোভাব ফুটে উঠেছে, তাও রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো। আমেরিকান নোটস বইতে তিনি সরাসরি বলেছেন, “আফ্রিকার কালো মানুষ অশিক্ষিত, নিচু জাত।” ‘মার্টিন চাজলউইট’ উপন্যাসে এক আফ্রিকান চরিত্রকে তিনি রীতিমতো ব্যঙ্গ করেছেন। ১৮৪৮ সালে নাইজার অভিযান নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধে খোলাখুলি বলেছেন, আফ্রিকার লোকেদের কোনোরকম শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রভৃতি শেখানোর চেষ্টা পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছুই নয়, এরা পুরোপুরি অন্ধকারে ডুবে থাকা একটা গোষ্ঠী। ‘ব্লিক হাউজ’ উপন্যাসে শ্রীমতী জেলিবাইকে নাইজার নদীর ধারে অবস্থিত বরিওবুলা-ঘা অঞ্চলের মানুষদের অর্থসাহায্য করতে দেখিয়ে ডিকেন্স স্পষ্ট ইঙ্গিত করেছেন, এসব উল্টোপাল্টা জিনিসে টাকা না উড়িয়ে বরং ওই টাকায় লন্ডনের অনাথ শিশুদের সেবা করলে কাজে দিত।
আরও পড়ুন : টমাস হার্ডি, রাজস্থান ও এক আশাভঙ্গের কাহিনি / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
ডিকেন্সের এহেন মনোভাবে বিরাট অবাক হবার কিছু নেই, ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ মনোভাবের নিরিখে এরকম ধ্যানধারণা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। ১৮১৫ সালে সম্রাট নেপোলিয়ন যুদ্ধে পরাস্ত হবার পরে উপনিবেশ স্থাপনের প্রতিযোগিতায় ইংরেজদের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো আর তেমন কেউ অবশিষ্ট ছিল না। জলে স্থলে একচ্ছত্র আধিপত্য ক্রমশ ব্রিটিশদের মধ্যে ঔদ্ধত্যের জন্ম দেয়। তারা বলতে শুরু করে যে ব্রিটিশ জাতি সবার চাইতে সেরা বলেই আজ সে সারা পৃথিবীর মাথার উপরে, এশিয়া আফ্রিকার অনুন্নত জাতিগুলোকে শাসন করা তাদের অধিকার, তাদের কর্তব্য। এই ধারণার প্রতি আবার সেই সময়ে ইংল্যান্ডের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মনোভাব ছিল দুরকম। লিবারাল বা উদারপন্থীরা বিশ্বাস করত যে খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তন ও শিক্ষাদানের ফলে এই জাতিদের ক্রমশ উন্নত করা সম্ভব। অন্যদিকে কনজারভেটিভ বা সংরক্ষণপন্থীদের ছিল সোজা হিসেব -- ওসব উন্নতি টুন্নতি অসম্ভব, নেটিভ মানেই আধা-জন্তু, অতএব এদের একমাত্র ওষুধ দাবড়ানি। মনে রাখা ভালো, ডিকেন্স প্রচণ্ড ভক্ত ছিলেন ব্রিটিশ লেখক টমাস কার্লাইলের, যে কার্লাইল তাঁর হিরোজ অ্যান্ড হিরো ওয়ারশিপ, ল্যাটার ডে প্যাম্ফলেটস প্রভৃতি একাধিক রচনায় ক্রমাগত উদারপন্থী সরকারের অতিরিক্ত গণতন্ত্রপ্রিয়তার মতো নানা মনোভাবের সমালোচনা করে গিয়েছেন। যেমন হিরোজ বইটিতে তিনি বলছেন, ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে সমাজ কোনোদিন সমস্ত মানুষকে উন্নত করার মাধ্যমে অগ্রসর হয়নি, যুগে যুগে মুষ্টিমেয় কিছু অসাধারণ মানুষের জন্যই তা সম্ভব হয়েছে। আফ্রিকানদের সম্বন্ধে বলতে গিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধে মন্তব্য করে বসেন যে দাসপ্রথা ভালো জিনিস, ওতে নাকি সমাজে শৃঙ্খলা বজায় থাকে। কার্লাইলের ফরাসি বিপ্লব সম্বন্ধে লেখাপত্র পড়েই ডিকেন্স ‘আ টেল অফ টু সিটিজ’ উপন্যাসটি লেখেন, হার্ড টাইমস উপন্যাসে ঠিক কার্লাইলের রাস্তা ধরেই তিনি হিতবাদ প্রভৃতি নানা উদারপন্থী মতবাদের কড়া সমালোচনা করেন। এহেন ডিকেন্স যে নিগ্রোদের নিরেট গণ্ডমূর্খ মনে করবেন, এবং ভারতীয়রা বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাদের পুরো জাতটাকেই ধরে নিকেশ করে দিতে চাইবেন, এতে খুব আশ্চর্যের কিছু আছে কি?
আরও পড়ুন : কোনান ডয়েলের গল্প ও ক্রীতদাসের প্রতিশোধ / বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য
..............................