নিবন্ধ

কোনান ডয়েলের গল্প ও ক্রীতদাসের প্রতিশোধ

বিপ্রনারায়ণ ভট্টাচার্য্য May 22, 2021 at 7:29 am নিবন্ধ

স্যর আর্থার কোনান ডয়েলের নাম বেশিরভাগ লোকের কাছেই পরিচিত বিপুল জনপ্রিয় গোয়েন্দা শার্লক হোমসের স্রষ্টা হিসেবে। অনেকেই জানেন না, ডয়েল গোয়েন্দাকাহিনি ছাড়াও নিয়মিত ঐতিহাসিক, অলৌকিক ও কল্পবিজ্ঞান নির্ভর সাহিত্যেও হাতমকশো করতেন। তাঁর কল্পবিজ্ঞান কাহিনির কেন্দ্রীয় চরিত্র প্রফেসর চ্যালেঞ্জার বা ঐতিহাসিক কাহিনির নায়ক ব্রিগেডিয়ার জেরার্ড অন্ততপক্ষে উনিশ শতকের শেষে যথেষ্ট জনপ্রিয় ছিল। শার্লক হোমসের প্রথম গল্প ‘দ্য স্ট্র্যান্ড’ পত্রিকায় ছেপে বেরোনোর আগে, ফাঁকা চেম্বারে বসে স্টেথোস্কোপ গলায় ঝুলিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে বিরক্ত ডয়েল যখন ভাবছেন ডাক্তারি ছেড়ে শেষমেষ চিরকালের শখ লেখালেখিটাই জমিয়ে আরম্ভ করে দেবেন কিনা, তখন তিনি হাত পাকাতেন নানা রকম গল্প লিখে, এবং বেনামে পাঠিয়ে দিতেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকার অফিসে। কপালজোরে গোটাকয়েক ছাপাও হয়ে যেত, আর প্রত্যেক বারেই আরও একটু উৎসাহ পেয়ে যেতেন ডয়েল।

 একেবারে প্রথম দিকের এমন একটি গল্প হল ১৮৮৪ সালের জানুয়ারি মাসে’কর্নহিল’ পত্রিকায় বেনামে প্রকাশিত ‘জে হাবাকুক জেফসন’স স্টেটমেন্ট’। এ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র মার্কিন গৃহযুদ্ধের প্রাক্তন সৈনিক জে হাবাকুক জেফসন। শরীর সারানোর উদ্দেশ্যে হাওয়া বদলের জন্য সে যাত্রা করে ‘মেরি সেলেস্তে’ নামের এক জাহাজে, এবং অচিরেই সে জাহাজ আফ্রিকার এক অজানা উপকূলে পরিত্যক্ত অবস্থায় গিয়ে আটকায়। এইখানে বলে রাখা ভালো, মেরি সেলেস্তে নামের একটি জাহাজ ১৮৭২ সালে সত্যিই অতলান্তিক সমুদ্রে পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। আফ্রিকার দ্বীপে গিয়ে জেফসন জানতে পারে, এই জাহাজ দুর্ঘটনার নেপথ্যে আসল নায়ক হল জনৈক বর্ণসঙ্কর যাত্রী সেপ্টিমাস গোরিং, তার হাতেই মৃত্যু ঘটেছে জাহাজের শ্বেতাঙ্গ ক্যাপ্টেন ও তার পরিবারের। শ্বেতাঙ্গদের প্রবল বর্ণবিদ্বেষ এবং কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের প্রতি অমানবিক আচরণের জন্য তাদের চূড়ান্ত ঘৃণা করে গোরিং। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকার সময় একাধিক শ্বেতাঙ্গকে খুন করে সে রীতিমতো একজন সিরিয়াল কিলারে পরিণত হয়েছে। বলে রাখা দরকার, জেফসন নিজে কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি যথেষ্ট সমব্যথী। তার ছোটবেলার নিগ্রো আয়ার সঙ্গে সে এতটাই ঘনিষ্ঠ যে আয়া তাকে সমুদ্রযাত্রার সময় সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে একটা ভাঙা পাথরের টুকরো সঙ্গে দিয়ে দেয়। ভাগ্য সত্যিই সহায় হয় জেফসনের, সে আবিষ্কার করে ওই টুকরো আসলে আফ্রিকার এই উপকূলের আদিবাসীদের আরাধ্য দেবতার মূর্তির ভাঙা কানের অংশবিশেষ (এখানে মনে পড়বেই টিনটিনের ‘কানভাঙা মূর্তি’ বইটির কথা)। ভাঙা টুকরো ফেরত পেয়ে জেফসনকে দেবতা বলে পুজো করতে শুরু করে আদিবাসীরা, বেগতিক দেখে তাকে আফ্রিকা থেকে বিদায় দেবার ব্যবস্থা করে গোরিং। আদিবাসীদের মধ্যে তার প্রাধান্যে জেফসন ভাগ বসাতে শুরু করেছে যে! ‘ডেই গ্রাশিয়া’ জাহাজে করে আমেরিকা ফিরে আসে জেফসন।

      ডয়েলের এই কাহিনি একাধিক কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। প্রথমত, সিরিয়াল কিলার সেপ্টিমাস গোরিং যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের কুখ্যাত বর্ণবিদ্বেষী হত্যাকারী দল ‘কু ক্লুক্স ক্ল্যান’-এর প্রতিবিম্ব। শ্বেতাঙ্গদের পথেই শ্বেতাঙ্গদের জাতিবিদ্বেষের জবাব দিয়ে চলেছে সে, শাসিতের প্রতি শাসকের চরম এক প্রতিশোধ। আবার ডয়েলের নিজের দেশ ইংল্যান্ডের কথা যদি ভাবি, তবে মনে রাখা দরকার, ভিক্টোরিয় যুগের শেষ দিকে জার্মানি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক উত্থান, বিশ্বজুড়ে ব্রিটিশ পণ্যদ্রব্যের ক্রমহ্রাসমান চাহিদা, বুয়র যুদ্ধের হতাশাজনক ফলাফল, বিভিন্ন উপনিবেশে অশান্তি প্রভৃতি একাধিক কারণে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইংরেজ জাতির মনে দেখা দিয়েছিল এক গভীর অনিশ্চয়তা। রিচার্ড জেফ্রিসের ‘আফটার লন্ডন’, উইলিয়াম ডিলাইল হে রচিত ‘দ্য ডুম অফ দ্য গ্রেট সিটি’ প্রভৃতি বইতে আমরা পাই ইংরেজ জাতি ও সভ্যতার পতনের কথা, ধ্বংসের কথা। এরই সঙ্গে যোগ হয় আরেক ভয় - উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে যদি সুদূর উপনিবেশ থেকে কোনও ব্যক্তি ইংল্যান্ডে এসে আক্রমণ চালায়? শাসকজাতির উপর প্রতিশোধ নেওয়া শুরু করে? এ যেন অত্যাচারী সাম্রাজ্যবাদীর বিবেকদংশনের অনিবার্য ফলশ্রুতি হিসেবে জন্ম নেওয়া এক ভীষণ আতঙ্ক, যা দেখা যায় ব্রাম স্টোকারের ‘কাউন্ট ড্রাকুলা’, রিচার্ড মার্শের ‘দ্য বিটল’ প্রভৃতি প্রবল জনপ্রিয় উপন্যাসগুলোয়। ডয়েলের এই গল্পেও কিন্তু রয়েছে এমন আতঙ্কের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। সেপ্টিমাস গোরিং ইতিমধ্যেই খাস মার্কিন মুলুকে একাধিক সাদা চামড়ার লাশ ফেলে এসেছে। আদিবাসীদের ঠিকঠাক খেপিয়ে তুলতে পারলে তাদের সঙ্গে নিয়ে জুতসই একটা জাহাজ পাকড়াও করে সাহেব মারার উদ্দেশ্যে আমেরিকার পানে ভেসে পড়তে কতক্ষণ? পরবর্তীকালে ডয়েলের শার্লক হোমস নিয়ে লেখা একাধিক গল্পেও পাই এই রকম প্লট - উপনিবেশ থেকে কোনও ব্যক্তি বা বস্তু এসে গোলমাল পাকিয়ে তুলছে খাস ইংল্যান্ডে, মুশকিল আসান করতে ডাক পড়ছে শ্রীমান হোমসের। ‘দ্য সাইন অফ দ্য ফোর’ গল্পে গণ্ডগোলের মূলে আগ্রার দুর্গ থেকে লোপাট হয়ে যাওয়া ধনরত্ন, সঙ্গে যোগ হয়েছে টোঙ্গা নামে আন্দামানের এক খুনে আদিবাসী। ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য স্পেকলড ব্যান্ড’ গল্পে সেটা হয়ে গেছে ভারত থেকে আনা একটা বিষাক্ত সাপ, ‘বসকম্ব ভ্যালি মিস্ট্রি’ গল্পে অস্ট্রেলিয়ার ব্যালারাট থেকে লুটে আনা সম্পত্তি, ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডেভিলস ফুট’ গল্পে আফ্রিকার উবাঙ্গি প্রদেশের এক বিষাক্ত গুল্ম, ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ডাইং ডিটেকটিভ’ গল্পে সুমাত্রা থেকে বাহিত সংক্রামক রোগ, অথবা ‘অ্যাডভেঞ্চার অফ দ্য ক্রিপিং ম্যান’ গল্পে হিমালয়ের বানরের থেকে সংগৃহীত দেহরস। অতএব বলা যেতেই পারে, যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে যে বিষয়গুলোতে তিনি পরবর্তীকালের লেখায় বারবার ফিরে আসবেন, তার মূল সুর প্রথম থেকেই বেঁধে নেওয়া শুরু করে দিয়েছিলেন ডয়েল।  লেখক হিসেবে তিনি যে অচিরেই মারাত্মক জনপ্রিয় হবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কী!    




[ কভার ছবি : কর্নহিল পত্রিকায় প্রকাশিত আলোচ্য উইলিয়াম স্মলের অলঙ্করণ। ]

#বাংলা #নিবন্ধ #আর্থার কোনান ডয়েল #জে হাবাকুক জেফসন’স স্টেটমেন্ট

  • Mukherjee Angshuman
    May 22, 2023 at 12:10 pm

    Doyle এর একটি সম্পূর্ণ অজানা লেখা আলোয় আনলেন। সমৃদ্ধ হলাম।

  • Rupsa
    Feb 10, 2023 at 11:21 am

    খুব সুন্দর করে সহজে বলা। দারুন লাগলো পড়ে।

  • Dipanjan Kundu
    Dec 28, 2021 at 3:52 pm

    তথ্যসমৃদ্ধ। ঋদ্ধ হলাম।

  • Sayandeep
    May 25, 2021 at 8:05 am

    ডয়েলের অজানা দিকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ! খুব উপভোগ্য লেখা।

  • Annwoy Banerjee
    May 22, 2021 at 5:34 pm

    Khub shundor 👌

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

26

Unique Visitors

225522