সি.ভি. রামন ও কমলা সোহনি : দ্বন্দ্বমূলক এক আখ্যান
বোম্বে থেকে বিএসসি পাশ করে বড় আশা নিয়ে বছর বাইশের মেয়েটি এসেছিলেন ব্যাঙ্গালোর শহরে। মনে তাঁর স্বপ্ন, এবার হয়তো পড়বার সুযোগ পাবেন এখানকার বিখ্যাত বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠানে। আর কেনই বা পাবেন না, তিনি তো বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর সে স্বপ্ন হঠাৎ আটকে গেল প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টরের বাধায়। তাঁকে ভর্তি না করবার পিছনে যুক্তি দিলেন, তিনি মেয়ে। এটাই একমাত্র কারণ।
কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে বড় হওয়া সেই মেয়েটি, যাঁর নাম কমলা ভাগবত, সত্যিই কি এরপরে ভর্তি হতে পেরেছিলেন বিজ্ঞান-প্রতিষ্ঠানটিতে? সে কথা বলার আগে আমরা একটু দেখে নিই, তিনি যাঁর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামতে যাচ্ছিলেন, কে সেই ডিরেক্টর!
উনিশ শতকের শেষ দিকে কলকাতার বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’-এর বউবাজারের পুরনো ভবনে দীর্ঘ দিন গবেষণা করে দক্ষিণ ভারতের এক তরুণ ব্রাহ্মণ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন কলকাতার শিক্ষা জগতের উঁচু স্থানে থাকা স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের, এবং তাঁরই বদান্যতায় তিনি যোগ দেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য স্থাপিত বিজ্ঞান কলেজের অধ্যাপক হিসেবে। বছর কয়েক পরে সম্পূর্ণ নতুন একটি বিষয়ে গবেষণা করে সাফল্য পেলেন সরকারের অর্থ দপ্তরের প্রাক্তন ওই অফিসার, এবং সে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে লাভ করলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। পদার্থবিদ্যায় নোবেল পদক ভারতবর্ষে প্রথমবার এল তাঁরই হাত ধরে।
এরপর চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, যিনি সকলের কাছে স্যার সিভি রামন নামেই পরিচিত তখন থেকেই, হয়ে ওঠেন কলকাতা তথা ভারতের বিজ্ঞান-মানচিত্রের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এরপরে আর বেশিদিন অধ্যাপনা করেননি, এখানে অধ্যাপক হিসেবে যে মাইনে পেতেন, ঠিক তার দ্বিগুণ মাইনের চাকরিতে রামন চলে গেলেন ব্যাঙ্গালোরে টাটা গোষ্ঠীর স্থাপন করা ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স’-এ, ডিরেক্টর হিসেবে। ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বমানের এই শিক্ষাকেন্দ্রের তিনিই প্রথম ভারতীয় ডিরেক্টর।
আইআইএসসি-তে পনেরো বছর কাটাবার পর ১৯৪৮ সালে রামন তাঁরই নামে ব্যাঙ্গালোর শহরেই তৈরি করেন রামন রিসার্চ ইনস্টিটিউট, যেখানে কাটাবেন জীবনের শেষ বাইশ বছর। স্বাধীন ভারতের প্রথম জাতীয় অধ্যাপক হয়েছিলেন তিনিই। পরে ভারতরত্নও লাভ করেছিলেন। সব মিলিয়ে সিভি রামন সারা জীবন কাটিয়ে গিয়েছেন একের পর এক সাফল্য এবং স্বীকৃতির চূড়া জয় করার মুহূর্ত উপভোগ করতে করতেই। যদিও তাঁর প্রতিভা বা প্রথম জীবনের সংগ্রামের কথা আমরা বিস্মৃত হচ্ছি না মোটেই।
আমরা যেটা খেয়াল করি, প্রতিষ্ঠার বছর দুয়েক পর যখন এই প্রতিষ্ঠানের দরজা খুলে গেল ছাত্রদের ভর্তির জন্য, তখনও এখানে ব্রাত্য রয়ে গেল মেয়েরা। প্রতিষ্ঠানের আগল খুলতে তাঁদের অপেক্ষা করতে হবে আরও দশ-এগারো বছর। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম ছাত্রী কে, সেটা নিশ্চিত করে বলা না গেলেও ১৯২০ সালের রেকর্ডে দেখা যায় এক মিস এম এম মেহতা এবং ১৯২২-এর তালিকায় মিস আর কে ক্রিস্টি-র নাম। এরপর দীর্ঘ এগারো বছরের বিরতি, ১৯৩৩ সালে এসে আবার দেখি মিস কমলা ভাগবত নামটি। হ্যাঁ, ইনিই সে বছর বোম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে অনার্স পাশ করে এখানকার বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগে ভর্তি হতে এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর ভর্তির ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ালেন স্বয়ং ডিরেক্টর সাহেবই। যাঁর নাম স্যার চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন! বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী সেদিন এক ছাত্রীকে শুধুমাত্র নারী হওয়ার অপরাধে আটকে দিলেন ‘তাঁর’ প্রতিষ্ঠানের দ্বারপ্রান্তে। মেয়েরা আবার বিজ্ঞান-গবেষণা করতে পারে নাকি - এইরকম এক নাক-সিঁটকানো মনোভাবে আচ্ছন্ন ছিলেন রামন, যা প্রকাশ পেয়েছিল কমলাকে ভর্তি না করতে চাওয়ার মতো এক অবাক করা সিদ্ধান্তে।
কিন্তু ছেড়ে দেবার পাত্রী ছিলেন না কমলা। তিনি সরাসরি রামনের সঙ্গে দেখা করে দাবি করলেন, কেন তাঁকে ভর্তি হতে দেওয়া হবে না এটা যেন তিনি লিখিতভাবে জানান। সেই সঙ্গে জানালেন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, তিনি এখান থেকেই কৃতিত্বের সঙ্গেই পাশ করে দেখাবেন! আর কিছুটা গান্ধীবাদি ঢঙেই এরপর ধরনা দিতে বসলেন রামনের দপ্তরের সামনে।
চাপের সামনে পড়ে রামন নিমরাজি হলেন কমলাকে ভর্তি নিতে। আসলে ভর্তি না করবার কোনো যুক্তিগ্রাহ্য কারণই দেখানোর মতো ছিল না তাঁর সামনে। কিন্তু রাজি হয়েও চাপালেন বেশ কিছু শর্ত। যেমন, প্রথমত তাঁকে রেগুলার ছাত্রী হিসেবে গণ্য করা হবে না, প্রথমে এক বছর অস্থায়ীভাবে রাখা হবে তারপর তাঁর কাজের মান দেখে বিবেচনা করা হবে পরবর্তীতে রাখা হবে কি না সেই সিদ্ধান্ত; দ্বিতীয়ত, তাঁকে পরীক্ষাগারে গাইডের সঙ্গে আসতে হবে রাতের দিকে, দিনের বেলা এলে পাছে পুরুষ গবেষকদের ‘অসুবিধা’র সৃষ্টি হয়। আর তৃতীয়টি তো আরও অপমানজনক, তিনি কোনোভাবেই পরীক্ষাগারের পরিবেশকে নষ্ট করতে পারবেন না। এখানে বোঝানো হচ্ছে যে তিনি কোনোভাবে যেন ছাত্রদের মনোযোগ নষ্ট করবার কারণ হয়ে না দাঁড়ান।
যেন তাঁকে দয়া করে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে এমনই এক ইঙ্গিত ছিল এই শর্তগুলোর মধ্যে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর গবেষণা যেন সন্তুষ্ট করতে পারে স্বয়ং রামনকে, তবেই মিলবে ডিগ্রি।
বাইশ বছরের মেয়েটি রাজি হলেন সব শর্তে। শুরু করলেন এমএসসি কোর্সের পড়াশুনো। পাশাপাশি চলতে লাগল গবেষণা। আর এ ব্যাপারে তিনি পাশে পেয়েছিলেন সে আমলের শ্রেষ্ঠ একজন মাইক্রো-বায়োলজি গবেষককে। তাঁর নাম এম শ্রীনিবাস। খুবই কড়া গাইড, একইসঙ্গে ছাত্রদের জন্য নিবেদিতপ্রাণও। তাঁরই তত্ত্বাবধানে কমলা গবেষণা করলেন ডাল, দুধ এবং সিমের মধ্যে পাওয়া যায় এমন প্রোটিন-উপাদান নিয়ে। ১৯৩৬ সালে তিনি তাঁর গবেষণার ফল জমা দিলেন, এবং স্কলারশিপ পেলেন কেমব্রিজে পড়তে যাওয়ার। ইতিমধ্যে কমলা আরও একটি কাজ করেছিলেন। তিনি এবং আরও দুই ছাত্রী মিলে রামন এবং তাঁর স্ত্রী (লোকসুন্দরী আম্মাল তখন ছিলেন মেয়েদের হোস্টেলের ওয়ার্ডেন)-কে লিখলেন চিঠি, যাতে হোস্টেলের নিরাপত্তার দিকটা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা হয় এবং আরও বেশি করে মেয়েদের হোস্টেলে রাখবার বন্দোবস্ত করা হয়। হ্যাঁ, রামন বাধ্য হয়েছিলেন তাঁর এ দাবি মানতেও।
কেমব্রিজে আসবার পর কমলা গাইড হিসেবে পেলেন ডেরেক রিখটার নামে এক জীবরসায়নবিজ্ঞানীকে। সেখানকার বায়োকেমিক্যাল এবং ফিজিওলজিক্যাল পরীক্ষাগারে শুরু হল গবেষণা। পরে অবশ্য রিখটার অন্যত্র চলে যাওয়ায় কমলা গাইড হিসেবে পান রবার্ট হিল নামের বিখ্যাত জীবরসায়নবিদকে। কমলা সেখানকার সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর মেধা আর প্রতিভার জোরে। তাঁকে এমনকি এমন প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল যে তিনি চাইলে নোবেলজয়ী ফ্রেডরিক গৌল্যান্ড হপকিন্স-এর গবেষণাগারেও কাজ করতে পারেন।
কমলা হপকিন্সের কাছে কাজে যোগ দেন ১৯৩৯ সালে। আর এরপরেই শুরু হয় তাঁর আর এক সাফল্যের কাহিনি। মাত্র ষোল মাস গবেষণার পর তিনি জমা দিলেন তাঁর গবেষণাপত্র, আর সেটাও আবার টাইপ করা মাত্র চল্লিশ পাতার। ওইটুকু গবেষণাত্রেই মুগ্ধ হলেন পরীক্ষকেরা, কমলা পেলেন পিএইচডি ডিগ্রি। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা, যিনি কেমব্রিজ থেকে ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন।
পরবর্তীকালে কমলা সোহনি ভারতবর্ষের একাধিক বিশিষ্ট প্রতিষ্ঠানে দক্ষতার সঙ্গে প্রশাসনিক এবং অ্যাকাডেমিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। ১৯৯৮ সালে সাতাত্তর বছর বয়সে তাঁর প্রয়াণ ঘটে।
মূলত তাঁরই জন্য রামন আইআইএসসির দরজা এরপর খুলে দেন মেয়েদের জন্য, ১৯৩৭-’৩৮ থেকে এখানে ভর্তি হতে শুরু করেন মেয়েরাও। রামন নিজেও এরপরে তাঁর অধীনে গবেষণার জন্য ছেলেদের পাশাপাশি গ্রহণ করেছিলেন অন্তত তিনজন মেয়েকে, যাঁদের মধ্যে আন্না মানি অন্যতম।
আরও পড়ুন : জ্ঞানের আলো ছড়ানোয় খুন হতে হয়েছিল হাইপেশিয়াকে / অর্পণ পাল
কিন্তু কমলা কোনোদিন ভুলতে পারেননি তাঁর সঙ্গে হওয়া অবিচারের কথা। যা প্রকাশ পেয়েছিল অনেক বছর পরে; ইন্ডিয়ান ওমেন সায়েন্টিস্ট’স অ্যাসোসিয়েশন-এর সভায় তিনি তো বলেই দেন, “Though Raman was a great scientist, he was very narrow-minded. I can never forget the way he treated me just because I was a woman. This was a great insult for me. The bias against women was so bad at that time. What can one expect if even a Nobel laureate behaves in such a manner?”
আরও পড়ুন : নিউটনকে বিখ্যাত করেছিলেন ভলতেয়ারের জিনিয়াস প্রেমিকা এমিলি দু শেটেলে / অর্পণ পাল
এমনভাবে স্পষ্টভাবে সত্য কথা খুব কম মানুষই বলতে পারেন। ভারতবর্ষের বিজ্ঞান-শিক্ষাক্ষেত্রে সিভি রামন অবশ্যই এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, কিন্তু তাঁর বিপ্রতীপে লড়াই করে সাফল্য ছিনিয়ে নেওয়া কমলা সোহনির জীবনের এই ঘটনাকেও সহজে ভুলে গেলে চলবে না।
..........................................
#সিভি রামন #কমলা সোহনি #বিজ্ঞান #নারী গবেষক #উচ্চশিক্ষা #বঞ্চনা #সিলি পয়েন্ট #ফিচার #অর্পণ পাল #IISC #অয়েবজিন #বাংলা পোর্টাল #web portal