নিউটনকে বিখ্যাত করেছিলেন ভলতেয়ারের জিনিয়াস প্রেমিকা এমিলি দু শেটেলে
আড়াইশো বছরেরও আগে পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিতেন যে ফরাসি রমণী, তাঁর গুণের তালিকা করতে বসলে শেষ হবে না— গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ, রাজনৈতিক, গৃহকর্ত্রী, দার্শনিক, অনুবাদক এবং দারুণ সুন্দরী, আবার ভলতেয়ারের বহুদিনের প্রেমিকাও। তবে এসব ছাপিয়ে তাঁর যে পরিচয়টা সবচেয়ে বেশি মনে রেখেছে আজকের মানুষ, তা হল মহাকর্ষ তত্ত্বের আকরগ্রন্থ ‘প্রিন্সিপিয়া’ বইটির তিনিই প্রথম ফরাসী ভাষার অনুবাদক। আঠেরো শতকের আলোকিত ইউরোপের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এমিলি দু শেটেলে একাধিক উচ্চমানের বই লিখেও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি থেকে রয়ে গিয়েছিলেন ব্রাত্য, শুধুমাত্র তাঁর লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্যই। আর তাঁর কাজ অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছে দুজন বিখ্যাত ব্যক্তির প্রখর ছায়ায়, ভলতেয়ার এবং নিউটন
তাঁর পুরো নাম যদিও অনেকটাই বড়, গ্যাব্রিয়েল-এমিলি লে টনিলে দে ব্রেটুইল মারকুইস দু শেটেলে, তবে সব জায়গায় এমিলি দু শেটেলে-ই লেখা হয়। তিনশো বছরেরও বেশি আগে ১৭০৬ সালের ১৭ ডিসেম্বর জন্ম তাঁর, এক অভিজাত ফরাসি পরিবারে। বাবা লুই নিকোলাস ছিলেন রাজা চতুর্দশ লুই-এর সভার একজন উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী। এই কারণে তাঁদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল সে আমলের বিশিষ্ট সব অভিজাত জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের, যাঁদের মধ্যে ছিলেন বিজ্ঞান জগতের চাঁইরাও। ছোটবেলায় বাড়িতেই তাঁর পড়াশুনো চলতে থাকে, বারো বছর বয়স হওয়ার আগেই শিখে ফেলেন বেশ কয়েকটি ভাষা— জার্মান, ল্যাটিন, ইতালীয়, গ্রিক ইত্যাদি। তাঁর বাবা অন্তত এই ব্যাপারে ছেলে-মেয়ে প্রভেদ করেননি। ভাষার পাশাপাশি এমিলি শেখেন পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট করা কিছু বিদ্যাও, যেমন ঘোড়ায় চড়া বা অসিবিদ্যা; তবে তাঁর সবচেয়ে পছন্দের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় গণিত আর বিজ্ঞান। সে আমলে এই ধরনের জ্ঞানচর্চাও ছিল মেয়েদের জন্য এক নিষিদ্ধ এলাকা। এমিলির মা তাঁর এই জ্ঞানচর্চাকে একেবারেই পছন্দ করতেন না, তিনি প্রায়ই মেয়েকে কনভেন্টে পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতেন। তবে তাঁর বাবা মেয়ের মধ্যে প্রতিভা আর জ্ঞানের জন্য খিদেটাকে অনুভব করতে পেরেছিলেন। মেয়ে যাতে জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জন করতে পারে, এজন্য তিনি সে আমলের বিশিষ্ট কয়েকজন জ্যোতির্বিদের সঙ্গে মেয়ের সাক্ষাতের ব্যবস্থাও করে দিয়েছিলেন। আবার অন্যদিকে সেই মেয়ে নিজের গণিতের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে মেতেছেন জুয়া খেলাতেও, জুয়ায় জিতে পাওয়া অর্থ খরচ করে কিনেছেন বই আর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি।
আঠেরো বছর বয়সে এমিলির বিয়ে হয়ে যায় বয়সে বেশ কিছুটা বড় এক মিলিটারি ভদ্রলোকের সঙ্গে, নাম ফ্লোরেন্ট ক্লড মারকুইস দু শেটেলে-লেমন্ট। তিন সন্তানসহ তাঁদের সংসার জীবন সুখেই কেটেছিল। এটা স্বীকার করতেই হয়, পারিবারিকভাবে এমিলি দু শেটেলে পেয়েছিলেন জ্ঞানচর্চার একটা সুখী পরিবেশ, যা সে আমলে পেতেন না অধিকাংশ মহিলাই। তাঁদের জন্য কোনও প্রথাগত শিক্ষার ব্যবস্থা তো ছিলই না, তাঁরা নিজেদের ইচ্ছেমতো পেশাকেও বেছে নিতে পারতেন না। এমনকি, পুরুষদের মধ্যেও যাঁরা বিজ্ঞান নিয়ে পড়তেন, তাঁদের জন্যেও ছিল না কোনও নিশ্চিন্ত চাকরি, অধ্যাপনা বা শিক্ষকতা ছাড়া। সাতাশ বছর বয়সে তৃতীয় সন্তানের জন্মের পরেই এমিলি আবার ফিরে আসেন বিজ্ঞান আর গণিতের জগতে। ফিরে আসেন প্যারিসেও। এখানে এসে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হল বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ পিয়ের লুই মোরিউ দে মপারচুইস-এর সঙ্গে। এই সময় থেকেই এমিলি দু শেটেলে আস্তে আস্তে এক পদার্থবিদ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে থাকেন। ভলতেয়ারের তখন খুব খারাপ অবস্থা। তাঁর রাজনৈতিক মনোভাবের জন্য তখন তিনি পড়েছেন রাজরোষে। এমিলি তাঁকে লুকিয়ে রাখলেন নিজেদের পারিবারিক এস্টেটে।
সে আমলের ফ্রান্সের প্রধানতম দার্শনিক এবং লেখকদের মধ্যে একজন ফ্রাঁসোয়া-মারি ভলতেয়ার। দু শেটেলের সঙ্গে তাঁর দারুণ প্রেম শুরু হয় ওই এস্টেটের বাড়িতে লুকিয়ে থাকবার সময়। ভলতেয়ারই বলেছিলেন যে দু শেটেলে ‘was a great man whose only fault was being a woman’। তাঁর মধ্যে ভলতেয়ার দেখতে পেয়েছিলেন এক অসাধারণ নারীকে, যাঁকে তিনি ডাকতেন ‘ডিভাইন এমিলি’ নামে। দুজনে মিলে ওই এস্টেটে বিরাট বড় পারিবারিক বাড়িটাকে নবরূপে সজ্জিত করে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে তৈরি করে নিয়েছিলেন। সে বাড়ির একাধিক ঘর সাজানো হয়েছিল হরেক রকমের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রাদি দিয়ে, আর এখানেই তাঁরা গড়ে তোলেন এক লাইব্রেরি যেখানে রাখা হয়েছিল একুশ হাজার বই। সে আমলের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও এত বই থাকত না। এই প্রাসাদে তাঁরা একত্রে কাটিয়েছিলেন প্রায় পনেরো বছর। এখানে থাকাকালীনই এমিলি নিউটনের অধিকাংশ তত্ত্বকে হাতেকলমে পরীক্ষার মাধ্যমে আয়ত্ত্ব করে ফেলেন। সে আমলে ফ্রান্সে তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি শিখেছিলেন ক্যালকুলাসবিদ্যাও। পাশাপাশি এমিলি অনুবাদ করেছিলেন গ্রিক কবিতা, বাইবেল বা নীতিবিদ্যার বইও।
ভলতেয়ার খুব সহজেই বুঝতে পেরেছিলেন এমিলির জিনিয়াস-সত্তা, যে জন্য তিনি তাঁকে কাজে উৎসাহ দিতে কসুর করেননি। তাঁরা দু’জনে ১৭৩৮ সালে একত্রে লিখেছিলেন একটি বই, ‘Elements of Newton’s Philosophy’। এই বইটা পড়ে ফ্রান্সের বিদ্বান ব্যক্তিরা প্রথমবার বুঝতে পারেন নিউটনের আকাশছোঁয়া প্রতিভার প্রকাশ আর তাঁর কাজের গুরুত্বকে। যদিও এই বইয়ের টাইটেল পাতায় ছাপা হয়েছিল শুধু ভলতেয়ারের নাম। তবে বইয়ের ফ্রন্টপিসের ছবিতে ছিল এমিলির কাজের স্বীকৃতি, যিনি নিউটনের জ্ঞানকে আলো হিসেবে এনে ফেলছেন ভলতেয়ারের টেবিলে। কিন্তু শুধুমাত্র নারী হওয়ার সুবাদেই, এমিলি ডাক পেতেন না কোনও বৈজ্ঞানিক সভাসমিতি বা প্রতিষ্ঠানে। তাঁর যা কিছু কাজ বা সুধীজনসঙ্গলাভ, সবই বাড়ির অন্দরে। অবশ্য একত্রিশ বছর বয়সে একবার এক প্রতিযোগিতায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ফরাসি আকাদেমি অব সায়েন্স-এর আয়োজনে সেই রচনা-প্রতিযোগিতায় দু শেটেলে একটি লেখা জমা দেন আলোর চরিত্র-বিষয়ে। তবে পুরস্কার না পেলেও, তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট বিদ্বজ্জনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিল।
আরও পড়ুন : হেডি ল্যামার: একই অঙ্গে ‘মাদার অফ ওয়াই-ফাই’ আর ‘বম্বশেল’ অভিনেত্রী / অর্পণ পাল
সংসার-সন্তান সামলেও এমিলি নিজেকে প্রায় সারাক্ষণই ব্যস্ত রাখতেন বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন অভ্যাসে। এতটাই ব্যস্ত যে রাতে খুব অল্প সময় পান ঘুমানোর। এইরকমই এক সময়, বেয়াল্লিশ বছর বয়সে, এমিলি হাত দিলেন তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় মাপের কাজ, নিউটনের ‘প্রিন্সিপিয়া’র ফরাসি অনুবাদে। এরও ষাট বছর আগে ১৬৮৭ সালে প্রকাশিত হওয়া আইজ্যাক নিউটনের ‘ফিলজফি ন্যাচুরালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথেমেটিকা’ বইটি লিখিত হয়েছিল মূলত এডমন্ড হ্যালির উৎসাহ আর প্রচেষ্টার ফল হিসেবে। এই বইয়ে ধরা ছিল নিউটনের গতিবিদ্যা আর মহাকর্ষ বল সম্বন্ধে মোটামুটি সবটুকু বক্তব্য। পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে এই বইয়ের গুরুত্ব আজও সবচেয়ে বেশি। কিন্তু সেই আঠেরো শতকের ইউরোপে অধিকাংশ মানুষের কাছে এই বইটি প্রায় অপাঠ্যই ছিল, কারণ এর ভাষা প্রাচীন ল্যাটিন। প্রথম প্রকাশের বেশ কয়েক বছর পর ১৭২৬ সালে নিউটনের মৃত্যুর বছরখানেক আগে যখন এই বইটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়, তখনই প্রথমবার ইংরেজিতে অনূদিত হয় প্রিন্সিপিয়া। আর ফরাসিভাষী মানুষদের কাছে বইটিকে সহজপাঠ্য হিসেবে উপস্থাপিত করবার দায়িত্ব নিয়েছিলেন দু শেটেলে। আর এই কাজ কিছুটা এগোতে না এগোতেই জানতে পারলেন তিনি ফের অন্তঃসত্ত্বা! সন্তানধারণের পক্ষে সেই বয়স যথেষ্টই বিপজ্জনক, বিশেষত ওই সময়ের সাপেক্ষে। যদিও ভলতেয়ার এই সন্তানের বাবা কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে, তবে ভলতেয়ার নিজে এমিলির স্বামীর কাছে গিয়ে তাঁকে আসন্ন সন্তানের পিতৃপরিচয় সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত করবার চেষ্টা করেছিলেন। আর ওইরকম মানসিক অবস্থার মধ্যেই এমিলি মনস্থির করলেন তিনি সন্তান জন্ম দেওয়ার আগে অনুবাদের কাজটা শেষ করবেনই।
আরও পড়ুন : জিনিয়াস এক গণিতজ্ঞ এবং... / অর্পণ পাল
বলতে গেলে সেটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে কষ্ট আর পরিশ্রমের সময়। নিজেই জানেন যে তাঁর আয়ু হয়তো আর বেশি নেই; এইরকম অবস্থার মধ্যেই তিনি চালিয়ে গেলেন প্রিন্সিপিয়া-র অনুবাদের কাজ। দিনে আঠেরো ঘণ্টা অবধিও কাজটা নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, এমনকি এও শোনা যায় যে রাতে ঘুম পেলে তিনি বরফ-ঠাণ্ডা জলে হাত ডুবিয়ে রাখতেন যাতে ঘুম ছেড়ে যায়। বইয়ের অজস্র জায়গায় নিজস্ব টীকা, ব্যাখ্যা আর উদাহরণ দিয়ে সাজিয়ে সম্পূর্ণ নতুনভাবে বইটিকে ফরাসী ভাষায় উপস্থাপন করেন তিনি। নিউটনের গতিবিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে নিজস্ব জ্ঞানের উপলব্ধিতে প্রাঞ্জলভাবে ব্যাখ্যা করেন, যাতে সাধারণ পাঠকের কাছে অনেক বেশি বোধগম্য হয়ে ওঠে; সেইসঙ্গে লেখার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সাম্প্রতিক কাজের হদিসও। আর সম্পূর্ণ কাজটা শেষ করতে সময় নিয়েছিলেন অবিশ্বাস্য রকমের কম, মাত্র বছর দেড়েক! ১৭৪৯ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর সন্তানের জন্ম হয়, আর তার দিন ছয়েক বাদে ফুসফুসের সংক্রমণে তাঁর মৃত্যু; মৃত্যুর মাত্র দিন কয়েক আগেই সম্পূর্ণ হয় এই অনুবাদকর্ম। যদিও বইটি প্রকাশিত হয়েছিল আরও দশ বছর বাদে ১৭৫৯ সালে, যে বছর হ্যালির ধূমকেতুকে আবার আকাশে দেখা গেল। নিউটনের তত্ত্ব ইউরোপের বিস্তীর্ণ এক এলাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব দু শেটেলে ভালোভাবেই পালন করেছিলেন; এক সমকালীন সমালোচকের কথায়, তাঁর এই অনুবাদ ‘offers us Newton made accessible to everyone’। অথচ সে আমলের সাধারণ মানুষদের কথা বাদ দিলেও বিশিষ্টজনেদের একাংশও বিদ্বান মেয়েদের কী চোখে দেখতেন তা বোঝা যায় জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট-এর এই বাঁকা কথা থেকেই: ‘a woman who conducts learned controversies on mechanics like the Marquise de Chatelet might as well have a beard.’
…………………………………………