পরিবেশ ও প্রাণচক্র

সংক্ষিপ্ত সমুদ্র‘দর্শন’

শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী June 8, 2021 at 8:29 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

না না, লজ্জার ব্যাপার নয়। বলুনই না, আপনিই কি সে, আষাঢ়ের মেঘ ঘনালে যার তাজপুরের নির্জন, মেঘলা সমুদ্রতট মনে পড়ে? আপনিই কি পুরী গেলে লাইটহাউজের দিকের হোটেলে উঠতে চান, কারণ ‘স্বর্গদ্বারের দিকটা বড় নোংরা’? আপনিই কি মেরিনা বিচে উড়ন্ত প্যাকেট দেখে কংগ্রেস/ বিজেপি সরকারকে দুষে কন্যাকুমারীর দিকে এগিয়ে গেছেন? আপনি কি এই মতেও বিশ্বাসী যে গুগল ক্যালেন্ডার বস্তুটি ফোনে না থাকলে কোনোকালেই আপনার ৮ই জুন সমুদ্রকে মনে পড়তো না?

তাহলে এই লেখা আপনার জন্যই। সিঁটিয়ে যাবেন না, আপনাকেই কালপ্রিট ঠাওরাচ্ছে না কেউ। আমি-আপনি তত শতাংশ জনসংখ্যায় পড়ি, যত শতাংশ আমাদের স্থলভাগের দান এই সমুদ্রদূষণে – ৮০%। কাজেই, সংখ্যাগুরুর আবার দোষ কী! কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র, এবং গুরুতর – এ হেন পরিস্থিতিতে, এই ক’ছত্র পাঠ করে আজ বিশ্ব সমুদ্র দিবসে কি আপনার একটু হলেও মনে হচ্ছে, এই ৮০%-এ নিজের নামটা না দেখতে পেলেই ভালো হতো? মনে হচ্ছে কি, সরকারকে চাবকানোর বাইরে আমার আপনারও কিছু জানার বা জানানোর ছিল এই বিষয়ে? যদি এখনও মনে না হয়, তাহলে বাকি লেখাটা আর না পড়লেও চলে। কিন্তু, মনে হয়ে থাকলে, আসুন, আর কিছু পথ এগোনো যাক।

দেখুন, অনেকে বলবেন, এসব নিয়ে আলোচনা এরকম একটা দিনের ব্যাপার না, একজীবনের প্রয়াস। ডেভিড অ্যাটেনবরো বা স্টিভ আরউইন কি ৮ই জুন সমুদ্র দেখে ‘হে কৃষ্ণ হে কৃষ্ণ’ করে ছুটে যেতেন? সুন্দরলাল বহুগুণা কি শুধু ৫ই জুনই ‘অব কি বার পরিবেশ দরকার’ বলে গর্জে উঠতেন? মোটেই না; সমুদ্র, পরিবেশের সঙ্গে তাঁদের সখ্য ছিল নিরন্তর। কিন্তু একইসঙ্গে এটাও বুঝতে হবে, বহুগুণা তো দূরস্থান, আমি-আপনি এখন ‘কোনও গুণ নাই তার, কপালে আগুন' স্তরে পড়ি। তাই, লক্ষ্যে পৌঁছনোর উদ্দেশ্যে যে কোনও উপলক্ষেই শুরু করা আমাদের পক্ষে শ্রেয়।

২০২১-এর বিশ্ব সমুদ্র দিবসের থিমটি কিন্তু বেশ – ‘জীবন ও জীবিকা’; দেখুন, কেমন কাউকেই সম্পূর্ণ বাদ না দিয়ে একটা বাস্তুতান্ত্রিক সাম্যের আভাস আছে। জীবন বলতে যেমন বোঝায় সমুদ্রে বসবাসকারী ফ্লোরা ও ফনার জীবন (সহজ কথায় আমরা যাকে ocean life বলি), আবার জীবিকার মধ্যে পড়ে যায় সমুদ্র-নির্ভর জীবন যাঁদের, তাঁদের কথা। সরল হিসেব – যা’ই করা, একটা ভারসাম্য বজায় রেখে করা। বিরাট বড় বড় প্রজেক্ট বা অস্বচ্ছ ‘সমুদ্রের উপকার করব’-গোত্রীয় ধারণা সরিয়ে রেখে তাই আমরা বরং দেখে নিই, হাতের কাছে সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলো কী কী - 

প্লাস্টিক-দূষণ

প্লাস্টিক সর্বত্র ও সর্বশক্তিমান। ওয়ান-টাইম-ইউজেবল প্লাস্টিকের প্যাকেট, পাউচ, বোতল, খাবার প্যাক করার বাক্স, কাপ/গেলাস, স্ট্র – এই সবকিছু আমরা ছড়িয়ে থাকতে দেখছি সমুদ্রতটে, এবং স্বাভাবিক ভাবেই হাওয়ায়, জলের টানে এসব গিয়ে জমা হচ্ছে সমুদ্রগর্ভে। কল্পনাতীতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক জীবন। এই ধরনের ডিসপোজেবল প্লাস্টিক-সামগ্রীর রিসাইক্লিং পরিবেশ রক্ষার্থে সবচেয়ে সহজ উপায়। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন? আজও পৃথিবীতে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের ৯০% পুনঃব্যবহৃত হয় না, এবং তার একটি বিরাট পরিমাণ শেষ অব্দি জমা হয় সমুদ্রের পেটে। 

অতিরিক্ত মাছ ধরার সমস্যা

এটুকু বললেই লোকজন হাঁই-হাঁই করে তেড়ে আসেন, তবে কি মাছ ধরাই যাঁদের জীবিকা, তাঁরা না খেয়ে মরবেন? নাহ্‌, ব্যাপারটা তেমন নয় ঠিক। মাছ ধরা আর ‘অতিরিক্ত’ মাছ ধরায় পার্থক্য শুধু একটি শব্দের নয়, অনেক বেশি। অতিরিক্ত মাছ ধরার অর্থই হলো, প্রজনন প্রক্রিয়ায় যে মাছের ন্যূনতম যেটুকু সময় প্রয়োজন, সেটুকু সময় না দিয়েই তাদের ধরা হচ্ছে; এবং এই কারণে পৃথিবীর ৭০%-এর বেশি মাছের প্রজাতি এরইমধ্যে হ্রাস পেয়েছে সাঙ্ঘাতিকভাবে। বিঘ্নিত হয়েছে বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য – অতিরিক্ত মাছ ধরা প্রত্যক্ষভাবে যে এক-একটি প্রজাতিকে নিশ্চিহ্ন করার পথে এগোচ্ছে, তা-ই নয়, পরোক্ষে তা নিশ্চিহ্ন করছে সেই সব সামুদ্রিক প্রাণীদের যারা জীবনধারণের জন্য নির্ভরশীল ওই বিশেষ প্রজাতির মাছের উপর। এছাড়াও মৎস্যজীবীদের পক্ষে সুবিধাজনক ‘বটম ট্রলিং’ প্রক্রিয়া সমুদ্রপৃষ্ঠ, পৃষ্ঠে উপস্থিত কোরাল রীফ, বা সামুদ্রিক কচ্ছপ বা হাঙরের স্বাভাবিক জীবনধারণে যে কী ক্ষতি করছে, তা তো বলাই বাহুল্য! 

ডেড জোন

সমুদ্রের এক একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলকে আমরা আজ ‘ডেড জোন’ বলে জানি। কাকে বলবো ‘ডেড জোন’? যে অঞ্চলে সমুদ্রপৃষ্ঠে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ যৎসামান্য থেকে একেবারে শূন্যের মধ্যে ঘোরাঘুরি করে, তাকে সমুদ্র-চর্চার ভাষায় এই নামে ডাকা হয়। বিশেষ করে বড় বড় নদীর মোহনায় ‘ডেড জোন’ সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। এর কারণ কী? মূলত কৃষিতে ব্যবহৃত রাসায়নিক সার আর শিল্পবর্জ্য, যা নদীস্রোতে বাহিত হয়ে এসে জমা হচ্ছে এই সঙ্গমে। অক্সিজেনের পরিমাণ এখানে এতটাই কম যে সামুদ্রিক প্রাণপ্রবাহ সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়। পৃথিবীজুড়ে এই ‘ডেড জোন’-এর সংখ্যা এখন চারশো’রও বেশি, এবং ক্রমবর্ধমান। এরকম চলতে থাকলে এই শতাব্দী পেরনোর আগে নিজের স্বাভাবিক বৃদ্ধির ৫০% বেশি হারে বেড়ে উঠবে ‘ডেড জোন’।

এছাড়াও ‘গোস্ট ফিশিং’, পারদ-জনিত দূষণ, কোরাল-রীফ নষ্ট করা এবং সর্বোপরি ব্যাপক হারে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রের জলস্তরের বৃদ্ধি পাওয়া, এই সবই আজকের দিনে এক-একটি মূর্তিমান ত্রাস। সমুদ্র পরিবেশ-বহির্ভূত কোনও বিষয় নয়; পরিবেশের বিশেষ একটি সদস্য হওয়ার সুবাদে কিছু সমস্যা যেমন তার ক্ষেত্রে বিশেষ, তেমনই বৃহদর্থে পরিবেশ দূষণের অন্যান্য বহু নির্বিশেষ কারণও (যা আমরা ৫ই জুন স্মরণ করি) তার জন্য প্রযোজ্য।

 আরও পড়ুন : গাছের গায়ে যথেচ্ছ পেরেক আর ব্যানার : ক্ষত সারাচ্ছেন ওয়াহিদ সরদার / টিম সিলি পয়েন্ট

তাহলে এখন কথা হচ্ছে, এই আটশো শব্দের সংক্ষিপ্ত সমুদ্র‘দর্শন’ জেনে কী হলো আমার-আপনার? দূষণ নিয়ন্ত্রণের কাজ কি হচ্ছে না? আমাদেরই কি মাঠে নামতে হবে? বা আপনি কলকাতার বাড়ির দোতলার ঘরে, নিকটতম সমুদ্রের ঢেউ থেকে ১৭৫ কিমি দূরে বসে ঠিক কী করবেন এতকিছু জেনে? 

ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের চেষ্টায় নিয়ন্ত্রণের কাজ হচ্ছে অল্প-বিস্তর, আমাদের মাঠে নামার দরকার নেই। বরং ঐটিই কাজ, মাঠে নেমে আর সমস্যা না বাড়ানো। বৈজ্ঞানিকদের প্রয়াসের প্রত্যুত্তরে আমাদের অসচেতনতা, বা আরও বিপজ্জনক, ঔদাসীন্য কাজ করে বলেই আজ পরিবেশরক্ষা ২০% বনাম ৮০%-এর একটা অসম লড়াইতে পর্যবসিত হয়েছে। সেই শুরুর ৮০%, আমি-আপনি যার অংশ। তাই কাজে না আসি, শেষ অবধি এই অনুতাপ যেন না থাকে যে দূষণে আমরা সংখ্যাগুরু! কে বলতে পারে, পরেরবার গোপালপুরের বিচে চায়ের কাপটা উড়িয়ে দিতে গিয়েও আপনি হঠাৎই এই লেখার কথা স্মরণ করে নিজেকে সামলে নিলেন? হতেও তো পারে, আপনি অত্যন্ত সাহসী হয়ে পাশের মানুষের ফেলে যাওয়া ফাঁকা সিগারেটের প্যাকেটটা নিয়ে তার হাতে ধরিয়ে বললেন, “জায়গামতো ফেলুন। পৃথিবীতে সবকিছু ফেলারই নির্দিষ্ট জায়গা আছে!” এইভাবেই তো হয় বিন্দু থেকে সিন্ধু। আর আজকের কথা যখন সিন্ধু নিয়েই, আশা করতে দোষ কোথায়!

আরও পড়ুন : নিকাশি বর্জ্য থেকে তৈরি হবে এরোপ্লেনের জ্বালানি – বিকল্প না কল্পবিজ্ঞান? / অলর্ক বড়াল 

...........................



#সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল #World Ocean Day #পরিবেশ ও প্রাণচক্র #সচেতনতা #শুভংকর ঘোষ রায় চৌধুরী #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

0

Unique Visitors

183488