পরিবেশ ও প্রাণচক্র

নিকাশি বর্জ্য থেকে তৈরি হবে এরোপ্লেনের জ্বালানি – বিকল্প না কল্পবিজ্ঞান?

অলর্ক বড়াল Mar 31, 2021 at 11:41 am পরিবেশ ও প্রাণচক্র

মানুষের ব্যবহার্য যানবাহনের প্রায় সবকিছুই চলে ফুয়েল বা তৈলজাতীয় পদার্থের সাহায্যে। পৃথিবীর বুকে কয়লা, খনিজ তেল প্রভৃতি অপুনর্ভব শক্তিগুলির ভাণ্ডার যে ক্রমাগত ফুরিয়ে আসছে সে ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই সচেতন, তাই তাঁরা প্রতিনিয়ত গবেষণা চালাচ্ছেন বিকল্প শক্তি-উৎস ও শক্তি-উৎপাদন প্রক্রিয়ার সন্ধানে, যা একদিকে যেমন পুনরুৎপাদনযোগ্য হবে, পাশাপাশি হবে পরিবেশগতভাবে ‘সাস্টেইনেবল্‌’। উড়োজাহাজ আজকের দিনে সর্বাধিক ব্যবহৃত যানবাহনের মধ্যে একটি ও এতে জ্বালানিরূপে ব্যবহৃত ‘জেট ফুয়েল’-এর চাহিদাও ক্রমবর্ধমান; শুধুমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই বার্ষিক ২১ বিলিয়ন গ্যালন জেট ফুয়েল ব্যবহৃত হয় এবং আশঙ্কা করা হচ্ছে যে এই চাহিদা ২০৫০ সালে দ্বিগুণ হবে। পাশাপাশি চেষ্টা চলছে ‘সাস্টেইনেবল্‌ এভিয়েশন ফুয়েল’ (SAF) এর উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির। তাই বিজ্ঞানীরা বিকল্প উপায়ে জেট ফুয়েল উৎপাদনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি মার্কিন গবেষকদের একটি দল এক আশ্চর্য সম্ভাবনার দাবি করেছেন – নিকাশির বর্জ্যপদার্থ থেকে প্রস্তুত হবে জেট ফুয়েল।

গবেষকরা খাদ্যবর্জ্য, প্রাণীজ বর্জ্য, নিকাশি-ব্যবস্থার বর্জ্য প্রভৃতি ‘ওয়েট ওয়েস্ট’-কে নিয়ে গবেষণা চালিয়েছেন। তাঁদের দাবি, এইসমস্ত বর্জ্য মানব-পরিবেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয়, এবং তাঁদের অঙ্কের হিসাবে বার্ষিক উৎপাদিত এইধরনের বর্জ্যপদার্থে সন্নিহিত শক্তির পরিমাণ প্রায় ১০ বিলিয়ন গ্যালন জেট ফুয়েলে সন্নিহিত শক্তিক্ষমতার সমান। রাসায়নিক দিক থেকে এই বর্জ্যকে রূপান্তরকরণের ফল দারুণ আশাব্যঞ্জক কারণ বর্জ্য থেকে প্রাপ্ত পদার্থটির সঙ্গে সামান্য পরিমাণ জেট ফুয়েলের মিশ্রণেই পাওয়া যাবে নিয়ন্ত্রক গুণমানসম্পন্ন উড়োজাহাজের উপযোগী জ্বালানী। যেহেতু এইরকম বর্জ্যে জলের পরিমাণ বেশি এবং সেই জল পরিত্যাজ্য, তাই এটি অত্যন্ত শক্তি-নিবিড় এবং একে প্রায় যে কোনোধরনের তৈলজাতীয় পদার্থে রূপান্তর করা সক্ষম। 

এই বর্জ্যকে অক্সিজেন-মুক্ত পরিবেশে রেখে ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে একে মিথেনেও রূপান্তরিত করা যায়। গবেষকদের কথায়, যদি সঠিক উপায়ে ব্যাকটেরিয়াগুলিকে নিয়োগ করা যায় সেক্ষেত্রে সেগুলি জটিল ফ্যাটজাতীয় পদার্থগুলিকে বিয়োজিত করবে না, উল্টে বিয়োজনের প্রক্রিয়াটিকে থামিয়ে দেবে ঠিক তখন, যখন সেই পদার্থগুলিতে কার্বনের অণুগুলি একটি বিশেষ সজ্জায় সজ্জিত। সাধারণভাবে এই কার্বন-শৃঙ্খলের একপ্রান্তে দুটি অক্সিজেন অণু যুক্ত থাকায় এটি ‘লঘু অ্যাসিড’-এ পরিণত হয়। রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় এই অণুগুলি থেকে দুটি ‘লঘু অ্যাসিড’-কে একটি অণুতে পরিবর্তন, পাশাপাশি জল ও এক অণু কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিত্যাগও করা যায়। এক্ষেত্রে প্রাপ্ত অণুটির আকার দ্বিগুণ হয়ে যায়, সেটি দুটি চার-অণুযুক্ত কার্বন মলিকিউল থেকে একটি সাত-অণুযুক্ত কার্বন মলিকিউলে পরিণত হয় যা বাস্তবে জেট ফুয়েলে উপস্থিত হাইড্রোকার্বনের আকারের খুব কাছাকাছি। এই অবস্থায় ঐ মলিকিউলে উপস্থিত অক্সিজেনকে সরানোর দুটি উপায় রয়েছে, প্রথমটি হল হাইড্রোজেন ও একটি ক্যাটালিস্টের মাধ্যমে এক সরল বিক্রিয়া, যেটিতে অক্সিজেন জলের আকারে নির্গত হয় এবং দ্বিতীয়টি হল পুনরায় একটি ‘লঘু অ্যাসিড’ অণুর গলন প্রক্রিয়া। গবেষকদের ব্যাখ্যায় উভয় প্রক্রিয়াই কার্যক্ষেত্রে সঠিক ও ফলাফলরূপে যে হাইড্রোকার্বন পাওয়া যায় তা জেট ফুয়েলের কার্বন-গঠনবৈশিষ্ট্যের সদৃশ। এককথায়, গোটা প্রক্রিয়াটির সারংক্ষেপ – বর্জ্যপদার্থের ব্যাকটেরিয়া-কর্তৃক বিয়োজন, ব্যাকটেরিয়াকে মিথেন প্রস্তুত করতে বাধাদান, ব্যাকটেরিয়া দ্বারা রূপান্তরিত ফ্যাটি-অ্যাসিডগুলির বিচ্ছিন্নকরণ ও সবশেষে সেটিকে একটি বিক্রিয়ার মাধ্যমে হাইড্রোকার্বনের এমন এক অবস্থায় রূপান্তরকরণ যা ফুয়েল-রূপে ব্যবহার করা সম্ভব।

বিমানচালন নিয়ামক সংস্থাগুলি সুরক্ষা ও অন-গ্রাউন্ড কার্যকলাপের জন্য জেট ফুয়েলের গুণমানের ক্ষেত্রে বেশকিছু বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন যাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল জেট ফুয়েলের স্ট্যান্ডার্ড ফ্ল্যাশ-পয়েন্ট ও ফ্রিজিং-পয়েন্ট যার ওপর নির্ভর করে উচ্চ ও নিম্ন তাপমাত্রায় জেট ফুয়েলের আচরণ। কিন্তু গবেষকদের তৈরি হাইড্রোকার্বন-ফুয়েলের এই বৈশিষ্ট্যগুলি জেট-ফুয়েলের সঙ্গে মেলে না। তবে, দুটি প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত হাইড্রোকার্বন-ফুয়েলের একটি উচ্চ ফ্ল্যাশ-পয়েন্ট যুক্ত ও অন্যটি নিম্ন ফ্ল্যাশ-পয়েন্ট যুক্ত হওয়ায় সমস্যা কমেছে। তাই, এ দুইয়ের মিশ্রণে যে জেট ফুয়েল পাওয়া যাবে তার ৭০ শতাংশের অধিক হবে বায়ো-ফুয়েল। পাশাপাশি যেহেতু প্রক্রিয়াকরণের নানা ধাপে এই ফুয়েলের মিশ্রণের শুদ্ধিকরণ হয়েছে তাই এটি সাধারণ জেট ফুয়েলের তুলনায় উচ্চ শক্তি-ঘনাঙ্ক সম্পন্ন। বিজ্ঞানীদের হিসাবে দৈনিক ২০০ টন খাদ্যবর্জ্য ও অন্যান্য বর্জ্যপদার্থ থেকে প্রাপ্ত বায়ো-ফুয়েলের মূল্য গ্যালন প্রতি আড়াই ডলার হতে পারে। তাঁদের এই গবেষণা কার্যক্ষেত্রে কতটা লাভজনক হয় সেটিই দেখার বিষয়। পরিবেশগতভাবে জেট-ফুয়েলের মত একটি জ্বালানি দ্রব্যের এমন এক ‘সাস্টেইনেবল্‌’ বিকল্পকে বিশ্বের নানাদেশের বিমান-চলাচল নিয়ামক সংস্থারা ও সংশ্লিস্ট দপ্তরগুলি কিভাবে গ্রহণ করবে সেটাই এখন প্রশ্ন, আর উত্তরটা বরাবরের মতোই সময়ের গর্ভে।




তথ্যসূত্র: 

Proceedings of the National Academy of Sciences Mar 2021, 118 (13) e2023008118; DOI: 10.1073/pnas.2023008118


#বাংলা #পরিবেশ #অলর্ক বড়াল

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

37

Unique Visitors

219180