একটি ডিসেকশন টেবল ও একজোড়া উইলিয়াম
সাল ১৮৩২। স্থান স্কটল্যান্ড। The anatomy act, 1832 – নতুন আইন আনল সরকার। দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-শিরা-উপশিরা-স্নায়ু-হাড়-পেশি এইসবের শারীরস্থানগত যে জ্ঞান, সেইটেই পড়ানো হয় অ্যানাটমিতে, আজও। সে বিষয়েই আইন। বলা হল, মেডিক্যাল পড়ুয়া, অ্যানাটমির শিক্ষক, লাইসেন্স-প্রাপ্ত ডাক্তাররা এইরকম শিক্ষার জন্য কেবল দান করা দেহই ব্যবহার করতে পারবেন।
এই অঙ্গ-প্রতিস্থাপনের যুগে বসে আপনি ভাবছেন, দান করা দেহ কাটাছেঁড়া (dissection) করেই তো আজ অ্যানাটমির শিক্ষা দেওয়া হয়, দেহদানের জন্য এত সচেতনতা তৈরি, অঙ্গদানের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে আমাদের এত পরিশ্রম, সেখানে প্রায় ২০০ বছর আগে কী এমন হয়েছিল, যাতে আইন বলবৎ করে বলে দিতে হল, কেবল দান করা দেহই অ্যানাটমি শিক্ষার জন্য ব্যবহার করো বাপু, অন্য কিছু নয়!
আসলে, এই Anatomy act আসার আগে যে আইনটি ছিল, তার নাম Murder act 1752। তাতে বলা ছিল, শুধুমাত্র খুন, আত্মঘাতী হওয়া অথবা বেওয়ারিশ মৃতদেহকেই ব্যবহার করা যাবে অ্যানাটমি শিক্ষায়। ডাক্তারি বিদ্যার ক্রমবিকাশের সেই সময়ে অ্যানাটমি শিক্ষার সেরা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছিল এডিনবরা ইউনিভার্সিটি। এখানেই অ্যানাটমির শিক্ষা দিতেন প্রফেসর রবার্ট নক্স। তাঁর সম্বন্ধে বলা হয়, "...almost single-handedly raised the profile of the study of anatomy in Britain." তার সঙ্গে নক্স এক অভিনব কাণ্ড করেছিলেন। তিনি আজকের যুগের বিজ্ঞাপনের মতো করে প্রচার করেছিলেন যে, প্রতিটি ক্লাসে নতুন anatomical subject (অর্থাৎ, মৃতদেহ)-এর ওপরেই কাটাছেঁড়ার কাজ করা হবে। স্বভাবতই তাঁর দৈনিক দুবার ডেমনস্ট্রেশন ক্লাসে উপচে পড়ত ছাত্রের ভিড়। সহজেই অনুমেয়, মৃতদেহের চাহিদাও উত্তরোত্তর বাড়ছিল। চাহিদার সঙ্গে সাযুজ্য রাখতেই আইনের পথ ছেড়ে চোরাপথে দেহের জোগান বাড়তে থাকল। শুরু হল কবর থেকে মৃতদেহ সরিয়ে (exhumation) বিক্রির এক লাভজনক ব্যবসা। শীতকালে এই চাহিদা বাড়ত, কারণ দেহ পচতে সময় লাগত বেশি। এই কবর-চোরদের নাম দেওয়া হল resurrection men, আর সেই প্রেক্ষিতে ১৮২০-র দশক থেকেই এডিনবরায় শুরু হল প্রতিবাদ। কোনও কবরখানায় ওয়াচ-টাওয়ার তৈরি হল, কেউ আবার যতদিন পর্যন্ত দেহে পচন না ধরে, ততদিন সাময়িক ভাবে কবরের উপরে রেখে দিল এক ভারী পাথরস্তম্ভ, কেউ সেই সময়ের জন্য ভাড়া করল পাহারাদার, কোনও পরিবার আবার কবর ঘিরে তৈরি করে দিল লোহার খাঁচা– যাকে বলা হত mortsafe। এই বিশৃঙ্খলা যখন চলছে, তখনই আত্মপ্রকাশ ঘটে দুই উইলিয়ামের।
উইলিয়াম হেয়ার আর উইলিয়াম বার্ক।
দুই উইলিয়ামের জন্মস্থান এবং পূর্ব পেশা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকলেও ভাগ্য তাদের এনে ফেলেছিল এডিনবরায়। উইলিয়াম হেয়ার ১৮২০-র দশকের মাঝামাঝি এসে পড়েছিল এডিনবরার ওয়েস্ট পোর্ট এলাকার Tanner's Close-এ। সেখানে তার বাড়ির মালিক মারা গেলে, সে মালকিন মার্গারেট-কে বিয়ে করে বাড়ির দখল নেয়। দুজনেই সুরাবিলাসী, অশ্লীলভাষী, উচ্ছৃঙ্খল ছিল কিনা, তাই মিলে যেতে সময় লাগেনি! অন্যদিকে, উইলিয়াম বার্ক তার দ্বিতীয় স্ত্রী নেলি-কে নিয়ে ১৮২৭-এর দিকে চলে আসে Tanner's Close-এ। প্রাথমিকভাবে হকার কিংবা মুচির কাজ করেই দিন কাটাত বার্ক। তারপর আলাপ হল হেয়ারের সঙ্গে। এবং গলাগলি বন্ধুত্ব।
১৮২৭ সালের ২৯শে নভেম্বর, হেয়ারের এক ভাড়াটে মারা গেল চার পাউন্ড ভাড়া বাকি রেখেই। হেয়ার তার আর্থিক ক্ষতির কথাই বলছিল বার্ক-কে, হঠাৎই যুগলে আবিষ্কার করল– আচ্ছা, এই মৃতদেহটি স্থানীয় কোনও অ্যানাটমিস্ট-এর কাছে বেচে দিলে কেমন হয়? তখনকার দিনে এমন তাজা মৃতদেহের দাম প্রায় দশ পাউন্ড! যেমন কথা তেমনই কাজ। প্রথমেই এক কাঠের মিস্ত্রির কাছে গিয়ে কফিন বানানো হল। তারপর আসল মৃতদেহ লুকিয়ে কফিনে ভরে দেওয়া হল কাঠের মোটা গুঁড়ি। কবর দেওয়ার পালা চুকিয়ে, রাতের অন্ধকারে দেহ নিয়ে তারা হাজির হল এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রদের সঙ্গে দরদাম করার মাঝেই প্রফেসর নক্স এসে রফা করলেন সাত পাউন্ডে। সাড়ে চার পাউন্ড গেল হেয়ারের পকেটে, বাকিটা বার্কের।
পরের বছরের জানুয়ারি। জোসেফ বলে হেয়ারের এক ভাড়াটের বারবার জ্বর এল। সঙ্গে ভুল বকা। হেয়ার দম্পতি ভয় পেল, এমন রোগগ্রস্ত ভাড়াটে থাকলে অন্য কেউ আর এ বাসায় থাকতে চাইবে না। অতএব হেয়ার আর বার্ক মিলে জোসেফকে হুইস্কি খাইয়ে আরও নেশাতুর করে তুলল, এবং শেষে বার্ক চড়ে বসল জোসেফের বুকে, আর হেয়ার চেপে ধরল মুখ। অবশেষে মৃত্যু। টুঁ-শব্দটি করার জো পায়নি জোসেফ। এবার দশ পাউন্ডের বিনিময়ে দেহটি বিক্রি হল প্রফেসর নক্সের কাছে।
এরপরের শিকার, সিম্পসন নামের এক মহিলা। ১২ই ফেব্রুয়ারি, ১৮২৮। হেয়ারের ঘরে ডেকে নিয়ে আকন্ঠ মদ্যপান করানো হয় তাকে। বাড়ি আর ফিরতে পারবেন না, এই অজুহাতে রাত্রিবাসের প্রস্তাব হয়। আবারও সেই একই পদ্ধতিতে খুন। দেহ, সেই রাতেই বেচে দেওয়া হয় নক্সের কাছে। নক্স-ও বেশ বিস্মিত হয়েছিলেন এত তরতাজা এক মৃতদেহ দেখে, কিন্তু তিনিও একটি প্রশ্নও করেননি। মোহের সঙ্গে বোধের বেশ শত্রুতা, কাজেই মোহকে বাসা দিতে বোধকে লোপ পেতেই হয়।
আরও পড়ুন : বিজ্ঞান ও ফ্যাশন – এক অন্যধারার রূপকথা / সায়নদীপ গুপ্ত
এপ্রিলের শুরুর দিকে বার্কের সঙ্গে পরিচয় হয় মেরি প্যাটারসন আর জ্যানেট ব্রাউন নামে দুই তরুণীর। তাদের প্রাতরাশের জন্য আহ্বান জানায় বার্ক। দেদার মদ্যপানে প্যাটারসন বেহুঁশ হয়ে পড়ে। ব্রাউনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছিল বার্ক, এমনই সময়ে নেলি এসে পড়ে। সেই প্রেমালাপ দেখে তার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, চিৎকার করে বার্ককে দুষতে থাকে সে। বদমেজাজি বার্কও কম যায় নাকি? সামনে থাকা হুইস্কির বোতল ছুড়ে দেয় নেলির দিকে। অন্যদিকে ব্রাউনের ধারণাতেই ছিল না যে বার্ক বিবাহিত। আহত হয়ে সে প্যাটারসনকে ফেলেই সেই স্থান ছেড়ে দ্রুত চলে যায়। মাথা খানিক শান্ত হলে, বার্ক তার বন্ধু হেয়ারকে ডেকে আনে। উভয়ের স্ত্রীকেই অন্য ঘরে রেখে, এই ঘরে চলে মারণখেলা। নক্সের টেবিলে যখন দেহটি পৌঁছয় তিনি দেখেন, সেই দেহ তখনও শীতল হয়নি। ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে, দেহটিকে তখনই dissect না করে প্রায় তিনমাস ফর্মালিনে রেখে দিয়েছিলেন নক্স।
আরেক রাত্রে, এক পুলিশ অফিসার মদ্যপ এক মহিলাকে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছিলেন। নজরে পড়ে বার্কের। মাথায় চলতে থাকে সেই সিক্যুয়েন্স। বিনয়ী হয়ে, সে নিজেই মহিলাকে পৌঁছে দিতে চায়। বাকিটা বলাই বাহুল্য।
এভাবেই এক এক করে খুন হন মিসেস হ্যালডেন, তাঁর মেয়ে, এক অজ্ঞাতবয়স্ক মহিলা, এফি নামের এক কাগজকুড়ানি, এক বৃদ্ধা এবং তাঁর মানসিকভাবে অপরিণত নাতি... পদ্ধতি সেই একই। মদ্যপান এবং বিচিত্রভাবে শ্বাসরোধ। এর মধ্যে ওই নাতিটির মৃত্যু বার্ককে খানিক বেশিই অস্বস্তিতে ফেলেছিল। বেদনায় বীভৎস হয়ে ওঠা মুখখানি ভুলতে সময় লেগেছিল তার। তবে তাতে খেলায় ভাটা পড়েনি। আকণ্ঠ পান করে, অস্বস্তি ভুলে শিকার খোঁজার পালা শুরু হয়েছিল অচিরেই।
সেবছর জুন মাসে, বার্ক আর নেলি, নেলির বাবাকে দেখতে কদিনের জন্য Tanner's Close ছেড়ে ফালকার্ক গেছিল। ফিরে এসে লক্ষ করল হেয়ারের বেশভূষায় বেশ দেখার মতো বদল এসেছে। সন্দিগ্ধ বার্ক জানতে চাইল, এর মধ্যে কোনও দেহ হেয়ার, নক্সের কাছে বিক্রি করেছে কি না। তার নেতিবাচক উত্তরে দমে না গিয়ে বার্ক সরাসরি নক্সের কাছে খবর নিতে গেল। যা ভেবেছিল, তাই! বদরাগি বার্ক হেয়ারের সঙ্গে প্রায় খণ্ডযুদ্ধ লাগিয়ে ফেলে আর কি! শেষমেশ হেয়ারের সান্নিধ্য ছেড়ে সে তার অন্য এক আত্মীয়ের বাসায় সস্ত্রীক গিয়ে উঠল। কিন্তু ততদিনে এ প্রায় নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন্ধ করব বললেই, করা যায়? আমরা পারি?
কাজেই আবারও... সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে হেয়ারের বাড়িতে প্রায়ই আসা ধোপাটিকে মেরে ফেলল দুজন। এরপর ফালকার্ক থেকে বেড়াতে আসা নেলির এক আত্মীয়কেও মদ্যপানের আসর জমিয়ে মেরে ফেলা হল। এই সময়ে মার্গারেট চেয়েছিল, নেলিকেও মেরে ফেলতে! কে জানে, কোথায় কী বলে দেবে! স্কটিশদের বিশ্বাস করা যায়? যাই হোক, বার্কের আপত্তিতে সেই খুনটি আর হয়নি।
কিন্তু হেয়ার বা বার্ক, দুজনেই শয়তান হলেও নিশ্চয়ই মানুষ ছিল, নইলে কি আর ভুল হয়?
হ্যাঁ, লোভে তো ভুল হয়েই থাকে। ওদেরও হল।
দুবার।
এডিনবরার রাস্তার এক পরিচিত মুখ ছিল জেমস উইলসন। আঠেরো বছরের এক খোঁড়া, মানসিক ভারসাম্যহীন ভিক্ষুক। নভেম্বর মাসের এক দিনে, হেয়ার এই উইলসনকে মদের লোভ দেখিয়ে নিয়ে এল ঘরে। পরদিন, নক্সের ক্লাসে এই দেহটি দেখে অনেকেই চিনতে পেরেছিল। কিন্তু নক্স সেসব যুক্তিতে কান দেননি। দু-একদিনের মধ্যেই রটে যায়, উইলসন নিখোঁজ। তখন নক্স সেই মৃতদেহকে, অন্যান্য দেহ কাটাছেঁড়ার আগেই, স্টোরেজ থেকে বের করে মাথা এবং খোঁড়া পা-দুটো বাদ দিয়ে দিলেন। তা ছাড়া, একবার ব্যবচ্ছেদ শুরু হলে, সে দেহ এমনিতেই শতচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে আর উপায় রইল না, উইলসনের দেহ শনাক্ত করার।
অবশেষে এল ৩১ শে অক্টোবর, ১৮২৮। দ্বিতীয় এবং শেষ ভুলটি হল ওইদিন।
মার্গারেট ডকার্টি। মধ্যবয়স্ক আইরিশ মহিলা। বার্ক তাঁকে লোভ দেখিয়ে নিয়ে এল ব্রোগ্যানের অতিথিশালায়। সেখানে আরও দুই ভাড়াটে ছিলেন, অ্যান এবং জেমস গ্রে। তাঁদের বলা হল, ডকার্টি ওদের আত্মীয়, সে রাত্রে ওখানে থাকবেন। তাই এক রাতের জন্য ওঁদের দুজনকে কাছেই হেয়ারের বাসস্থানে পাঠানো হল, উপযুক্ত অর্থ সহযোগে। আপদ বিদায় করে শুরু হল তুমুল মদ্যপান। সে রাতে একবার গ্রে দম্পতি কিছু প্রয়োজনে এসে দেখেছিলেন, ডকার্টি-সহ পাঁচজনই নেশাতুর হয়ে নেচেই চলেছে। পরদিন, স্বাভাবিকভাবেই যখন গ্রে দম্পতি ফিরে আসেন, ডকার্টি সেখানে ছিল না। এবং অদ্ভুতভাবে একটি বিশেষ বিছানার দিকে বার্ক তাঁদের কিছুতেই যেতে দিচ্ছিল না। সেদিন সন্ধের দিকে যখন সে বাড়িতে কেউ ছিল না, তখন ওঁরা ওই বিছানার তলায় সদ্য রাখা খড়-বিচালি সরিয়ে দেখেন, ডকার্টির মুখ! সে মুখ দিয়ে তখনও রক্ত, লালারস গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে।
আরও পড়ুন : যিনি চিনিয়েছিলেন আইনস্টাইনকে / অর্পণ পাল
সম্ভবত এই প্রথমবার উইলিয়ামদ্বয় মৃতদেহকে সেদিনই বিক্রি না করে এমনভাবে রেখে দিয়েছিল বিছানার নিচে। হয়তো ভোরের আলো ফুটে উঠেছিল, কিংবা ক্লান্তি।
পুলিশের কাছে যাওয়ার আগে গ্রে দম্পতি প্রথমে বার্কের স্ত্রী নেলিকে সমস্ত জানান। সে আবার ঘুষ নিয়ে কথা চেপে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করতে থাকে। যাক গে, অবশেষে পুলিশ সমস্ত জানতে পারে গ্রে দম্পতিরই সৌজন্যে। কিন্তু পুলিশ আসতে আসতে দেহ চলে যায় নক্সের ব্যবচ্ছেদ ঘরে। পরদিন সকাল-সকাল পুলিশ হানা দেয় সেখানে। জেমস গ্রে শনাক্ত করেন ডকার্টির দেহ। জিজ্ঞাসাবাদে একাধিক অসংগতি এবং পর্যাপ্ত প্রমাণ পেয়ে পুলিশ, হেয়ার ও বার্ক, উভয় দম্পতিকেই গ্রেপ্তার করে। যে অতিথিশালায় ঘটনাটি ঘটেছিল, সেই ব্রোগ্যান-কেও গ্রেপ্তার করা হয়, তবে শেষমেশ ছেড়েও দেওয়া হয়।
পড়ে রইল চারজন। শুরু হল ট্রায়াল। প্রত্যেকের আলাদা জবানবন্দি, দেহের ফরেনসিক পরীক্ষা– বাদ গেল না কিছুই। রবার্ট ক্রিস্টিসন ছিলেন ময়নাতদন্তকারী বিশেষজ্ঞদের একজন। তাঁরা বললেন, সম্ভবত শ্বাসরোধ করে খুন। এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়। এমনকি, সত্যিই শ্বাসরোধ করে খুন কি না, তা মেডিক্যালি প্রমাণ করাও সম্ভব নয়! তবে?
তবু ডাক্তারবাবুদের ওইটুকু উক্তির উপর ভরসা রেখেই বার্ক এবং হেয়ারের বিরুদ্ধে খুনের চার্জ আনা হল।
ক্রিস্টিসন নক্সের জবানবন্দিও নিয়েছিলেন। নক্স বলেছিলেন, আসলে হেয়ার আর বার্ক খুব দরিদ্র অতিথিশালাগুলো নজরে রাখত। সেখানে কারও মৃত্যু হলে, কেউ তাকে কবর দেওয়ার আগেই ওরা সেই দেহ সামান্য মূল্যে কিনে নক্সকে বেচে দিত। সেই মুহূর্তের জন্য ক্রিস্টিসন বলেছিলেন, নক্সের হৃদয় বা নীতিবোধ না থাকতে পারে, কিন্তু বেআইনি কাজ বোধহয় উনি করেননি।
এদিকে পুলিশের দৃঢ় প্রত্যয় হল, এই চারজনের মধ্যেই কেউ দোষী, এবং খুন সম্ভবত এই একটিই নয়। কিন্তু দেহ? দেহ তো গুণবান প্রফেসর নষ্ট করে দিয়েছেন! তবুও যেই একাধিক খুনের সম্ভাবনা প্রত্যাশা করা হল, অমনি খবরের কাগজে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে খবর বের হতে শুরু করল। সেই সূত্র ধরেই জ্যানেট ব্রাউনের মতো মানুষরা যোগাযোগ করতে শুরু করল, প্যাটারসনের মতো প্রিয়জনদের নিখোঁজ হওয়ার খবর নিয়ে। ফলে, এই একাধিক খুনের সঙ্গে এই যুগলের যোগাযোগ সন্দেহ করে, তাদের বিরুদ্ধে খুনের চার্জ আনা হল। কিন্তু যেহেতু corpus delicti নেই, দরকার ছিল স্বীকারোক্তির। আইনজীবী স্যার উইলিয়াম রেই, সে ব্যবস্থাও পাকা করলেন। এই চারজনের মধ্যে হেয়ারকে দেওয়া হল রাজসাক্ষী হওয়ার টোপ। বদলে, শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে তাকে। হেয়ার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিল সমস্ত খুনের। সব মিলিয়ে ১৩, ১৪, ১৫, ১৬... হ্যাঁ, ১৬টা খুন!
৪ঠা ডিসেম্বর সরকারি ভাবে, মেরি প্যাটারসন, জেমস উইলসন এবং মিসেস ডকার্টি– এই তিনটি খুনের বিরুদ্ধে চার্জ দাখিল হল বার্ক এবং তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে।
অন্যদিকে নক্সের বিরুদ্ধে কোনও চার্জ তৈরি হল না। কারণ বার্ক তার স্বীকারোক্তিতে বলেছিল, প্রফেসর নক্স, না তাকে খুন করতে শিখিয়েছেন, না মদত দিয়েছেন। যদিও সাধারণ মানুষের কাছে নক্স পেয়েছিলেন ধূর্ত রিংমাস্টার-এর তকমা, যিনি তাঁর অঙ্গুলিহেলনে প্রায় নাচিয়ে ছেড়েছিলেন বার্ক এবং হেয়ারকে। লেখা হয়েছিল কবিতাও...
“Up the close and doon the stair,
But and ben' wi' Burke and Hare.
Burke's the butcher, Hare's the thief,
Knox the boy that buys the beef.”
ফরেনসিক বিজ্ঞানে এক নতুন শব্দের সৃষ্টিও হল এর সঙ্গেই, ‘burking’। বুকের ওপর চড়ে বসে শ্বাসরোধ করার যে পদ্ধতিতে বার্ক এবং হেয়ার তাদের শিকারকে খুন করত, সেই পদ্ধতি। এভাবে মৃত্যু হলে তার রহস্যভেদ করা সে যুগের ফরেনসিক বিজ্ঞানে প্রায় অসম্ভব ছিল। আজও, এই ২০০ বছর বাদেও “burking” মেডিকেলের পাঠ্যে অন্তর্ভুক্ত।
এই বিখ্যাত কেসের শুনানি শুরু হয় ১৮২৮ সালের ২৪শে ডিসেম্বর সকাল দশটা থেকে, বিচারক ডেভিড বয়েলের এজলাসে। আর ক্রিস্টমাস ইভ পেরিয়ে ২৫শে ডিসেম্বর প্রায় সকাল সাড়ে নটার সময় শোনানো হয় ভার্ডিক্ট! ডিনারের জন্য বিরতি নিয়ে উঠে গেলেও বিচারপদ্ধতির মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে বলে, কেউ আসন ছেড়েও ওঠেননি সেদিন। প্রথমে ডকার্টির কেসটিই আলোচিত হয়, কারণ একমাত্র তার দেহই পাওয়া গিয়েছিল। সাক্ষ্য দিয়েছিল হেয়ার, তার স্ত্রী মার্গারেট, প্রফেসর নক্স এবং শেষে সেই ডাক্তার ক্রিস্টিসন-সহ আরও অনেকে। ২৫শে ডিসেম্বর সকালবেলা বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের মন্তব্য-প্রমাণ প্রত্যক্ষ করে, জুরি বোর্ড সর্বসম্মত ভাবে বার্ককে ঘোষণা করল “guilty” হিসাবে; আর তার স্ত্রী নেলি “not guilty”, কারণ তার বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বিচারক বয়েল তাঁর রায় ঘোষণায় বলেছিলেন, “তোমার দেহ জনসাধারণের সামনে ব্যবচ্ছেদ করা হবে। এবং আমার বিশ্বাস, যদি কখনও কঙ্কাল সংরক্ষণ করা প্রচলিত হয়, তবে ভাবীকালের মানুষদের স্মৃতিতে তোমার নৃশংসতাকে বাঁচিয়ে রাখতে, তোমার কঙ্কালও সংরক্ষিত হবে”।
বার্কের স্ত্রী ছাড়া পাওয়ার পরদিন বাজারে হুইস্কি কিনতে গিয়ে ক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে পড়ে যায়। দ্রুত পুলিশের সাহায্যে সে পালিয়ে যায় এডিনবরা ছেড়ে। যাওয়ার আগে একবার বার্ককে দেখতে চেয়েছিল বটে, কিন্তু অনুমতি মেলেনি। হেয়ারের স্ত্রীও ছাড়া পাওয়ার পর গ্লাসগো যাওয়ার সময় আক্রান্ত হয় ক্ষিপ্ত জনতার কাছে। পুলিশের সহায়তায় পালায় সেও। হেয়ার ছাড়া পায় ফেব্রুয়ারি মাসে। কিছুদিন তার নিজের সুরক্ষার জন্য কাস্টডিতে থাকার পর ছদ্মবেশে পালাতে চায় ডামফ্রিসে। কিন্তু এক সহযাত্রী চিনে ফেলায় ডামফ্রিসে পৌঁছে ক্ষোভে ফুটতে থাকা জনতার মাঝে পড়ে যায় হেয়ার। সেখানেও পুলিশ প্রাথমিকভাবে উদ্ধার করে তাকে সে শহরের জেলে ভরে দেয়। ক্ষিপ্ত জনতা সেখানেও ইট-পাটকেল ছুড়ে ভেঙে দিতে থাকে একাধিক সরকারি সম্পত্তি। শেষে কোনওক্রমে অবস্থা সামাল দিয়ে হেয়ারকে শহরের বাইরে বের করে দেওয়া হয়।
এই তিনজনেরই শেষ পরিণতির কোনও প্রামাণ্য নথি পাওয়া যায় না।
এরপর আসি নক্সের কথায়। হেয়ার আর বার্কের সঙ্গে তাঁর এই দেহের ব্যবসা নিয়ে নক্স কোনও প্রকাশ্য বক্তব্য রাখেননি। কিন্তু, এডিনবরা শহরে তাঁকে নিয়ে তৈরি হয় কার্টুন, তাঁর বাড়ির সামনে চলে বিক্ষোভ, কুশপুতুল পোড়ানো। আইনিভাবে নক্স নির্দোষ প্রমাণিত হলেও, একে একে তিনি তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি নেন, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সহকর্মীদের কৌশলী চালে বহিষ্কৃতও হন। কালে কালে লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জেনস, তাঁর ডাক্তারি লেকচার দেওয়ার লাইসেন্স-ও বাতিল করে। এডিনবরার রয়্যাল সোস্যাইটির ফেলো-র পদ থেকেও সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে, ১৮৪৮ সালে। বাকি জীবন কোনওক্রমে নিজস্ব প্র্যাকটিস করে কাটিয়ে দেন এক কালে ব্রিটেনের অ্যানাটমি শিক্ষার পথপ্রদর্শক ডাক্তার রবার্ট নক্স।
উইলিয়াম বার্ক?
২৮শে জানুয়ারি, ১৮২৯। এডিনবরার রাস্তায়, বার্কের ফাঁসি দেখার জন্য তিলধারণের জায়গা ছিল না। আশেপাশের বাড়ির জানলা, বারান্দার জায়গা, রীতিমতো ভাড়া দিয়ে মানুষ দখল করে নিচ্ছিল। ১লা ফেব্রুয়ারি, তার মৃতদেহটি জনসমক্ষে ব্যবচ্ছেদ করলেন প্রফেসর মনরো। সে দৃশ্য দেখতে গিয়ে জনসমাগম প্রায় দাঙ্গার চেহারা নিয়েছিল। শেষমেশ এক ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ব্যবস্থা করলেন, ব্যবচ্ছেদ সম্পূর্ণ হলে ৫০ জনের এক-একটা দল সেই ডিসেকশন রুমে ঢুকে বার্কের dissected দেহ দেখে বেরিয়ে আসবে। প্রায় দু-ঘণ্টা ধরে ব্যবচ্ছেদ শেষে, তাঁর পালক-কলম বার্কের রক্তে ভিজিয়ে মনরো লিখলেন, “This is written with the blood of Wm Burke, who was hanged at Edinburgh. This blood was taken from his head.” আইনের রক্ষাকর্তারা নড়েচড়ে বসলেন, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আটকাতে বদলে ফেললেন নিয়ম। দান করা দেহ ছাড়া আর কোনও দেহের উপর অ্যানাটমি শিক্ষার অধিকার রইল না।
ভাগ্যের কী পরিহাস! যে মানুষ একাধিক খুনের পর, সেই দেহকে অ্যানাটমির ডিসেকশন টেবলে পৌঁছে দিত, তারই দেহ দেশের সরকার জনসমক্ষে শুইয়ে দিল সেই টেবলে। তার রক্ত দিয়ে লেখা হল এক কলঙ্কিত ইতিহাস। আর তার কঙ্কাল?
বিচারক বয়েলের কথা মনে পড়ে?
হ্যাঁ, সত্যিই আজও বার্কের কঙ্কাল রাখা আছে এডিনবরা মেডিকেল স্কুলের অ্যানাটমিকাল মিউজিয়ামে।
[ছবি : ইন্টারনেট]