নিবন্ধ

‘নতুন দিনের আলো’- বাজেয়াপ্ত বই

শ্রুতি গোস্বামী April 18, 2021 at 5:49 am নিবন্ধ

রাষ্ট্র কী? বা রাষ্ট্র কে? কটি মানুষের ভাবনাচিন্তার কিংবা ভাবনাচিন্তার অভাবের যোগফল। এই চিন্তাটা তখনই গোটাগুটি একটা চেহারা পায়, যখন তাতে রাষ্ট্র চালানোর কাজে যুক্ত না থাকা মানুষগুলোও কথা বলতে পারে, মতামত রাখতে পারে। সুস্থ রাষ্ট্র সংলাপে বিশ্বাসী। যে রাষ্ট্রে সংলাপ নেই, কেবল নাটুকে একোক্তি আছে, তার ভাঙন অনিবার্য। তবে একেবারে ভেঙে পড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত তা নানাভাবে নিজের একপেশে কথাকে যতটা সম্ভব চিৎকার করে বলতে চায়, ডেসিবেলসীমাকে ছাপিয়ে গিয়ে কানের ভেতর, চোখের ভেতর, মাথার ভেতর পুঁততে চায়। যে-কোনো প্রকারে খুন করতে চায় একটিও বিপরীত কথার সম্ভাবনাকে। বাজেয়াপ্ত করে, ব্যান করে নির্মূল করতে চায় দ্বিতীয় কোনো কথা।

ব্রিটিশ ভারতবর্ষ এমন বেশ কিছু ঘটনার সাক্ষী। নাট্যনিয়ন্ত্রণ আইনই হোক্‌ বা ভার্নাকুলার প্রেস আইন হোক্‌, উদ্দেশ্যটা একই ছিল শাসকের। ‘চারুলতা’-র অমল তার দাদা ভূপতির ১৮৭৯ সালের সেন্টিনেল কাগজের সম্পাদকীয় পড়ে “ওব্বাবা! সিডিশান! আমি ওর মইদ্যে নাই!” বলে পাশ কাটিয়ে বেঁচেছিল। কিন্তু পাশ কাটালেই সিডিশানের ট্র্যাডিশান তো বন্ধ হয় না। বিশ শতকেও তা চলতে থাকে। ‘পথের দাবী’-আমলে বাংলা সাহিত্যও বারবার এরকম রাজরোষের মুখে পড়েছে। তার মধ্যে একটিকে নিয়ে আজ দু-চারটি কথা বলব।

প্রায় নয় দশক আগে লেখা একটি বই, নাম ‘নতুন দিনের আলো’। প্রকাশ পায় ১৯৩৮ সালে, আর ১৮ দিনের মধ্যেই বাজেয়াপ্ত বইয়ের তালিকায় জুড়ে যায় তার নাম। লিখেছিলেন বিমলপ্রতিভা দেবী। শাসকবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার জন্যে যখন তিনি হিজলি কারাগারে বন্দি, সেই জেলের অন্ধকার থেকেই আলো খুঁজেছিলেন।

বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া বা BLPI-এর কর্মী ছিলেন বিমলপ্রতিভা। বেশ ছোট সংগঠন, তবে কার্যক্ষেত্র বিস্তৃতই ছিল। ১৯৩৩-৩৪ সালে ‘নতুন দিনের আলো’ লেখার সময় যদিও তিনি এই সংগঠনের সদস্য হননি। কিন্তু উপন্যাসের প্রোপাগান্ডার সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপ্রণালীর গভীর সাদৃশ্য পাওয়া যায়। ১৯২০-’২১ থেকে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে ধারাবাহিকভাবে যুক্ত থাকলেও কোনো দলের প্রতিই গোঁড়া আনুগত্য দেখাননি তিনি। চিত্তরঞ্জন দাশের বোন ঊর্মিলা দেবীর প্রতিষ্ঠিত ‘নারী কর্মমন্দির’-এ কাজ করেছেন, একই সময়ে ভগৎ সিং-অনুগামী ‘নওজোয়ান ভারত সভা’-র বাংলা শাখার সভানেত্রী হয়েছেন, আবার কিছুদিনের মধ্যেই সুভাষচন্দ্রের অনুসারী পথে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। ১৯৩০-এর আইন অমান্য আন্দোলন, ওই একই সময়ের চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান, ১৯৩১-এ ভগৎ সিং-সুখদেব-রাজগুরুর ফাঁসির প্রতিবাদ, বাংলার নানা জায়গায় জ্বলতে থাকা সশস্ত্র বিদ্রোহের প্রায় প্রতিটিতেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে থেকেছেন বিমলপ্রতিভা। এই বৈচিত্র্যকে রাজনৈতিক বহুচারিতা বলে চিহ্নিত করে দেবার আগে একবার ভাবা প্রয়োজন, বিমলপ্রতিভা কেন একইসঙ্গে এই বিবিধ পন্থাকে গ্রহণ করছেন। নেহাত শখে? খামখেয়ালে? নাকি এই পর্বে তিনি খোঁজ করছেন একটা সহজ উদার রীতিপদ্ধতির? ১৯৩১-এ উল্টোডাঙা ডাকাতি মামলা, ১৯৩২-এ কুমিল্লার ম্যাজিস্ট্রেট হত্যা মামলায় একাধিকবার গ্রেপ্তার হন বিমলপ্রতিভা। সেই সময়েই হিজলি জেলে বসে লেখেন ‘নতুন দিনের আলো’। এই উপন্যাসটি পড়লেই তাঁর ওই সন্ধানী রাজনৈতিক চোখের কিছুটা হদিশ পাওয়া যায়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত যে ঔপনিবেশিক ভারতের রাজনৈতিক চলাচলকেও অনেকটা প্রভাবিত করেছিল, তার ছাপ তাঁর চিন্তাতেও পড়ে। ১৯৩৯-এ সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তৈরি করেন ফরোয়ার্ড ব্লক। সুভাষপন্থী বিমলপ্রতিভা স্বভাবতই যোগ দেন তাতে। বামমনস্কতা তাঁর মধ্যে বহুদিন ধরেই বর্তমান ছিল, কংগ্রেসের মধ্যে থেকেও বারবার সশস্ত্র আন্দোলনগুলিকে সমর্থন জানিয়ে গেছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখতে পারেননি। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা নেন, এবং গ্রেপ্তার হন। ১৯৪৫-এ মুক্তি পাওয়ার পর তিনি যুক্ত হন BLPI সংগঠনের সঙ্গে। এই ছোট সমাজতন্ত্রী দলটি মুখ্যত ভারত-শ্রীলঙ্কা-মায়ানমারকে কেন্দ্র করে সংগঠন বিস্তার করতে চেয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাছাকাছি সময় থেকেই। ট্রটস্কির ফোর্থ ইন্টারন্যাশনালের এশীয় ধারা বলে গৃহীত ছিল এই দল। ১৯৪২ সালে বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অফ দ্য ইউনাইটেড প্রভিন্সেস অ্যান্ড বিহার এবং বলশেভিক মজদুর পার্টি অফ ইন্ডিয়া একযোগে শ্রীলঙ্কার লঙ্কা সমসমাজ পার্টির সঙ্গে মিলে তৈরি করে BLPI। ভারতে মূলত বাংলা-বিহার-মহারাষ্ট্র-মাদুরাই অঞ্চলে কাজ করতেন এঁরা। স্বাধীনতার পর প্রধানত শ্রমিক সংগঠনের কাজেই নিয়োজিত হয় এঁদের রাজনৈতিক আদর্শ। বাংলায় কমলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও অজিত রায় এই সংগঠন বিস্তারের দায়িত্বে ছিলেন। যদিও সদস্যসংখ্যা লক্ষণীয়ভাবে কম হওয়ার দরুন, এবং আদর্শগতভাবেও একটু কোণঠাসা হওয়ার দরুন স্বাধীন ভারতে খুব বেশিদিন এর অস্তিত্ব টেকেনি বলেই জানা যায়। ১৯৪৫-এ এই দলে যোগ দেবার পর থেকেই বিমলপ্রতিভা মূলত বাংলার শিল্পাঞ্চলগুলোতে কাজ করতে শুরু করেন। এরই কাজে কলকাতা ছেড়ে থাকতে শুরু করেন রানীগঞ্জে কয়লাখনিমজুরদের বস্তিতে। প্রথম জীবনে মূল কমিউনিস্ট পার্টিলাইনের বিরোধী হলেও পরে যোগ দেন এআইটিইউসি-তে।



যখন জেলে বসে উপন্যাস লিখছেন তিনি, তখন থেকেই BLPI-এর মতাদর্শের ও কর্মপন্থার একটা স্পষ্ট অবয়ব দেখতে পাওয়া যায়, বাংলা-বিহার-মহারাষ্ট্র-দক্ষিণের পটভূমি, খনিশ্রমিক-মিলশ্রমিক-কৃষকদের ভিতর কাজ, ট্রটস্কির চিন্তাপথের প্রতি সরাসরি আস্থাপ্রকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে। উপন্যাসটি শুরু হয় নৃপেশ নামের এক যুবককে দিয়ে। সে নদিয়া জেলার ইস্ট ইন্ডিয়ান জুট মিল হাসপাতালের ডাক্তার। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগ না থাকলেও মনে জাতীয়তাবোধের স্পর্শ আছে। কিন্তু বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয়তাবাদকে ঠিক কীভাবে প্রকাশ করা যায় তা নিয়ে কিঞ্চিৎ বিভ্রান্ত সে। চিন্তাসূত্রে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো এসে পড়ে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র সুরূপা, নৃপেশের দাদা ধীরেশের স্ত্রী। সুরূপাই বিমলপ্রতিভার মুখপাত্র। বিবাহের কয়েকদিন পরেই ধীরেশ ও নৃপেশ একসঙ্গে বেশ বড় সময়ের জন্যে জার্মানি চলে গিয়েছিলেন উচ্চতর পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। সুরূপা থেকে যান গ্রামে। এক দীর্ঘ সময় জুড়ে নিজেকে একটু একটু করে প্রস্তুত করেন বৃহত্তর কাজের খাতিরে। দাদার বন্ধু রমেন নামক এক শ্রমিক নেতার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে, গভীর বন্ধুত্ব ও মানসিক সখ্য ঘটে। আর যথারীতি, গ্রামে তা নিয়ে অজস্র কুৎসা চলতে থাকে। লক্ষণীয় এটাই যে, বিমলপ্রতিভা এই পল্লীসামাজিক কেচ্ছা-কেলেঙ্কারি নিয়ে সুরূপার বা তার পরিবারের সংকটের পিছনে একটুও অতিরিক্ত শব্দব্যয় না করে কাহিনিকে চালিত করে দেন একেবারে ভিন্ন রাস্তায়। অবৈধ প্রেম অথবা প্রোষিতভর্তৃকার কান্নাকাটি, কোনোটিই আর তাঁর কাছে উপন্যাসের বিষয় হয়ে ওঠেনি।


ধীরেশ ও সুরূপাকে লেখক স্থাপন করেছেন বাংলার বাইরে পশ্চিম প্রদেশে, সম্ভবত মুম্বইতে। নদিয়া থেকে সেখানে বেড়াতে গিয়ে নৃপেশ প্রথম ঠিকমত পরিচিত হন সুরূপার সঙ্গে। জানতে পারেন, সুরূপা এক সাম্যবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। কৃষ্ণা বাঈ, শান্তনু, মোহনরাওজী, এমনকি রমেনকেও সে অঞ্চলে থাকতে দেখা যায়। ভারতের নানা প্রদেশে গুপ্তভাবে কাজ হয় তাঁদের, মুখ্যত মেহনতি মানুষদের নিয়ে। প্রচারের কাজ, সংগঠনকে তাত্ত্বিকভাবে মজবুত করার জন্যে পাঠচক্র, সামরিক শিক্ষাদান ও গ্রহণ, শ্রমিকবস্তি বা কৃষকগ্রামে গিয়ে তাদের মধ্যে থেকে কাজ, অত্যাচারের মাত্রাগুলিকে চিহ্নিত করে দেওয়া, সমস্যা থেকে উত্তরণের পথগুলিকে দেখিয়ে দেওয়া ইত্যাদি তাঁদের বিস্তারিত কর্মসূচির রূপরেখা। তাঁরা প্রত্যেকেই ঘুরে বেড়ান পৃথিবী জুড়ে। কখনো লন্ডন, কখনো বার্লিন, কখনো মস্কো। কখনো শহরের বিলাসী বাংলো, কখনো প্রত্যন্ত গ্রাম। বিপদ অজস্র, বিপদ মাথায় নিয়েই এঁদের ছুটে বেড়ানো। ধরা পড়ে যাওয়া, আহত হওয়া, বন্দি হওয়া, আবার আবর্তে ঢুকে পড়া। গ্লানি নেই, কষ্টও নেই। সবেতেই বড় স্বচ্ছন্দ তাঁরা। এজন্যেই মাঝে মাঝে সংশয় হয়, অভাব বা দারিদ্র্যের কোনো প্রশ্নও যেন নেই এঁদের সামনে। যখন যেমন দরকার, বড় সহজে আয়ত্ত হয়ে যাচ্ছে। নেহাত প্রয়োজন বলে এঁরা মাঝে মাঝে চাকরি করেন, দরকারমতো নিমেষের মধ্যে প্রচুর অলংকার পরে গাড়ি হাঁকিয়ে বেরিয়ে যান, আবার দিনের পর দিন গ্রামে কুঁড়েঘরে বসবাস করেন। গাড়ি, বাংলো, ফুলের বাগান, চাকরি, সব এত সহজলভ্য? মধ্যবিত্ত জীবনধারায় অভ্যস্ত মানুষের পক্ষে আচমকা অস্বাস্থ্যকর গ্রামে গিয়ে পরম সুখে বাস করা সত্যিই কি স্বাভাবিক? প্রশ্ন নৃপেশের মনেও জাগে। উত্তরে সুরূপা বলেন-

“আমরা ধনীও নই বুর্জ্জোয়াও নই, আমরা কোন শ্রেণীতে পড়ি না—সমশ্রেণী মানি।”

কেবল এই আদর্শগত অবস্থানটি দিয়েই সবকিছুর মীমাংসা হয়ে যায় কি না, তা নিয়ে অবশ্য সংশয়ের অবকাশ থাকে।


কিন্তু সুরূপা যে কথাগুলো বলতে চান, তা থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট বোঝা যায়। গোঁড়া সাম্যবাদীরা যে ভ্রান্তভাবে দেশের প্রাণধর্মকে, শ্রী-সৌন্দর্যকে অস্বীকার করছেন, সুকুমার বৃত্তিকে গ্রহণ করছেন না, শিল্পের শিল্পত্বকে মূল্য দিতে চাইছেন না, স্বাধীনতা আন্দোলনকে খাটো করছেন, এগুলো শোধরাতে চান সুরূপা সমালোচকের ভঙ্গিতে, সমস্ত মতপথের ভিতর একটা সেতুর মতো কাজ করে। সাম্যবাদকে সুরূপা মনেপ্রাণে স্বীকৃতি দেন, কিন্তু সোভিয়েতের তৎকালীন সাম্যবাদচর্চার গোঁড়ামি, জোসেফ স্তালিনের এককাট্টা স্বৈরাচার যে আসলে ক্ষতিকারক, তা ধীরেশরা না মানলেও সুরূপা মানেন। লিয়ঁ ট্রটস্কির উদারপন্থী স্বাতন্ত্র্য বরং তাঁকে আকৃষ্ট করে। অমল-বিনয়-ধীরেশ-রমেন সকলের কাছেই তাঁর অনুরোধ ছিল একত্রে কাজ করার, বিপ্লবী কর্মপ্রেরণাকে বিভিন্ন পথে চালিত না করে মতপার্থক্যকে একটিই রাস্তায় মিলিত করার। সেই রাস্তা খুঁজতে অসুবিধে হয়নি বিমলপ্রতিভার, কারণ তা তত্ত্বের জটিল পথ নয়, মানবতার পথ। নিজের জীবনের আশ্চর্য রোমাঞ্চকর যাত্রাপথ সুধা নামের একটি চরিত্রের মাধ্যমে দেখিয়েছেন তিনি, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী হিসেবে বনেদি বাড়ির বউ-এর মুখোশের আড়ালে তাঁর অস্বস্তি আর মুক্তির খোঁজই ধরা পড়ে সুধার মধ্যে। আর সুরূপাকে তিনি আইডিয়ালাইজ করে তোলেন তাঁর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রকাশক হিসেবে। “সুরূপার মূলে আছে তাঁর দরদী মন, স্নেহপ্রীতিভরা প্রাণ...সেই ঐশ্বর্য নিয়ে তিনি সকল যোগ্যতাই অর্জ্জন করেছেন। তাঁর বৈশিষ্ট্য আর বুদ্ধিমত্তার সবটা প্রতিফলিত হচ্ছে মানুষের প্রতি তাঁর মানুষের মতো ভালোবাসা এবং দরদ-মমতা থাকার জন্য।” নৃপেশ যখন এ কথা ভাবে, তখন কেমন করে পাড়াগেঁয়ে বউদি এত রুচিসম্পন্ন রাজনীতিবোদ্ধা হয়ে উঠলেন এই প্রশ্ন তার মনে আর জাগে না। ইন্টেলেকচুয়াল নৃপেশ ভাবালুতাকে বহুকাল এড়িয়েই এসেছিল। কিন্তু সুরূপার সংস্পর্শে সে আন্তরিকভাবে স্বীকার করে, “সমস্ত বিশ্বমানবের ঐক্য-সংযোজন এবং চরিতার্থতার উপায় এই হৃদয়-বৃত্তি”।


আরও পড়ুন

বর্তমান সময়ে সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন



এই কথাগুলোকে চারটি গালভরা বক্তৃতা না ভেবে বরং একটু অন্যভাবে দেখা যাক। খেয়াল করে দেখুন, সুরূপা-প্রসঙ্গে বারবার ব্যবহৃত হচ্ছে ‘দরদ’ ‘দয়া’ ‘মমতা’ ‘হৃদয়-বৃত্তি’ ইত্যাদি গুণের কথা, যে গুণগুলি ‘নারীসুলভ’ বলে জনধারণায় গৃহীত। বিমলপ্রতিভা মনে করেছেন, রাজনীতির কাজ হল মানবতার কাজ। আর নারীর হৃদয়বৃত্তিকে মানবতার বৃহৎ কাজের সঙ্গে মেলাতে পেরেছেন তিনি। এই প্রসঙ্গে নারীবাদের দ্বিতীয় তরঙ্গের সাংস্কৃতিক নারীবাদের কথা উল্লেখ করা যায়। নারী-পুরুষের ভিন্নতাকে স্বীকার করে নিয়ে এই ধারা বলতে চায় যে, নারী-বৈশিষ্ট্য বা ‘নারীসুলভ’ গুণ সদর্থে সমাজ ও রাষ্ট্রের পক্ষে প্রয়োজনীয়। এই নারী-বৈশিষ্ট্য (femininity) বলতে মার্গারেট ফুলার, জেন অ্যাডাম্‌স্‌, বা পার্কিন্স গিলম্যানের মত নারীবাদী তাত্ত্বিকেরা ভালবাসা, সহযোগিতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি মূল্যবোধের কথা বুঝিয়েছিলেন। এবং এই বিষয়গুলিকে পারিবারিক প্রয়োজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সমাজের বাইরের পরিসর (outer domain)-এর মধ্যে প্রয়োগ করার কথা বলেছিলেন তাঁরা। এর ফলে পুরুষকেন্দ্রিক শুধু নয়, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ-সংস্কৃতি-অর্থনীতির সামগ্রিক ব্যবস্থাটির ক্রমবদল ঘটবে, সংস্কৃতির নারীত্বকরণ (feminization of culture) ঘটবে। এই নারীত্বকরণ একটি আধুনিক বহুবিক্ষিপ্ত সমাজ-রাষ্ট্রে নিতান্ত আবশ্যক বলেই তাঁরা রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যা করেছিলেন। বিমলপ্রতিভার প্রস্তাবিত বক্তব্যের সঙ্গে এই মতবাদের প্রভূত সাদৃশ্য আছে। বিমলপ্রতিভাও রাজনীতি, মানবিকতা ও স্বাধীনতার একটি সর্বসাম্য কল্পনা করছেন। খেয়াল করা ভালো, উনিশ শতকের সামাজিক জাতীয়তাবাদের ঠিক বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে এই ভাবনা। নারীবিষয়ক প্রশ্নে ইতোপূর্বে যে বিশেষ অবস্থান বাঙালি সমাজে গৃহীত, তাতে নারীর হৃদয়প্রবণতা, দায়িত্ববোধ সবই স্বীকৃত হয়েছে, কিন্তু তার মাপক সবসময় ঘর। মেয়েরা সুস্থ থাকবে, যাতে সন্তানরা সুস্থ হয়; মেয়েরা শিক্ষিত হবে, পরিবারকে উন্নত করার খাতিরে; মেয়েরা ঘরের কাজ করবে, যাতে পরিবারের বাঁধন দৃঢ় থাকে। মেয়েদের নিজস্ব বুদ্ধিপ্রয়োগ করে সমাজের কথা ভাবার কোনো প্রয়োজনই নেই, তাদের স্বতঃস্ফূর্ত হৃদ্‌জগতকে ঘরের কাজে সমর্পণ করলেই সব ঠিক থাকবে। আশ্চর্যভাবে, মেয়েদের নিজস্ব ব্যক্তি-অস্তিত্ব সেখানে স্বীকৃত নয় কোথাও। বিমলপ্রতিভা বলতে চাইছেন অন্য কথা। চাইছেন, শুধু ঘরের নির্ধারিত কাজ নয়, মেয়েদের ‘হৃদয়’ প্রকাশ পাক পথেও। পথ, যা নাকি ‘নিরাপদ’ নয়, সেখানে স্বচ্ছন্দ জীবন খুঁজে নিক তারা।


রাজনীতি শুধু মিছিল আর প্রচারপত্র নয়, তা আসলে প্রতিদিনের মানুষী বাঁচার অঙ্গ, এই বৃহত্তর অর্থে বিশ্বাস রেখেছিল ‘নতুন দিনের আলো’-র সুরূপা। “মনুষ্যত্বের বিকাশ হলেই মনুষ্য সমাজের জন্য মানুষ ভাববে। যে-সমাজে মানুষ সহজ ভাবেই মানুষের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হবে, সেইটাই সত্যিকারের মনুষ্য সমাজ।”

এই ‘মনুষ্যত্বের বিকাশ’ ঘটার জন্যে সমাজের দীর্ঘচলিত সংস্কারগুলিকে অতিক্রম করতেই হয়। বাঁধা নিয়ম টপকে যেতে হয়। উপন্যাসের চরিত্রগুলোর মধ্যে এইজন্যেই স্বচ্ছতা অনেক বেশি। মানসিকভাবে তারা অত্যন্ত উদার, অগ্রগামী, প্রগতিবান। সাধারণ পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে তাদের আদান-প্রদান ঋজু। বিবাহ-সম্বন্ধের ভেতর অনুগত থেকেও সুরূপা-রমেনের সম্পর্কের প্রগাঢ়তাকে নির্দ্বিধভাবে গ্রহণ করেন ধীরেশ, নৃপেশ ও কৃষ্ণা প্রচলিত বিবাহ-প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে। তারা বলে– “জীবনের নিয়মকে খাঁটি বলেই মানি, তাই এই বিকৃত সমাজের নিয়মকে পূজা করতে চাই না। জীবনের সেই নিয়মের দাবিতেই ভাবী-দিনের সমাজের নিয়ম গড়ে উঠবে।”

এই ‘ভাবী দিন’, ‘নতুন’ দিনের আলোই চেয়েছিলেন বিমলপ্রতিভা, আজ বা গতকাল বা গতপরশুর মতো পরিচিত অভ্যস্ত আলো নয়।


এই বইটি যে বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তা কি কেবল এতে একটি গুপ্ত রাজনৈতিক সংগঠনের হইহই কাণ্ডের কথা আছে বলে? না। আসলে শাসকের পক্ষে শুধু নয়, কোনো প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই এমন অচিন্ত্য বৈপ্লবিক কল্পনাগুলিকে সাদর গ্রহণ করা সম্ভব নয়। ‘নতুন দিনের আলো’-র অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা পেয়ে দ্বিতীয় উপন্যাস ‘আগুনের ফুল্‌কি’-তে একটি ছদ্মবেশ নেন বিমলপ্রতিভা। সে বই তো বাজেয়াপ্ত হয়নি, বিস্মৃত হয়েছে। কেন? আমার-আপনার মগজে যে ফ্যাসিস্টটি বসবাস করে, তার জন্যে। দেশ স্বাধীন হয়, নিষেধাজ্ঞাও উঠে যায়। কিন্তু বিমলপ্রতিভা সাহিত্য, রাজনীতি, সংস্কৃতির জগৎ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যান। এই বিস্মরণ কিন্তু সচেতনভাবে নির্মিত। সন্দীপ বন্দ্যোপাধ্যায়-লিখিত বিমলপ্রতিভার জীবনীর এক জায়গায় এসে বেশ আহত হয়েই পড়তে হয়, কীভাবে একসময়ের সহকর্মীরা বিমলপ্রতিভা সম্পর্কে কোনো কথা বলতে অস্বীকার করেন, তাঁর চরিত্র বিষয়ে কুমন্তব্য করেন। তাঁর দাম্পত্যসংকট, রানীগঞ্জ-অঞ্চলে থাকাকালীন এক শ্রমিকনেতার সঙ্গে সম্পর্ক, অভিজাত পরিবার ছেড়ে শ্রমিকবস্তিতে থাকা, আবার নির্দিষ্ট একটি দলীয় ঘেরাটোপে বেশিদিন থাকতে না পারা, এসব বিষয়ে আমাদের সামূহিক অবচেতনে গেড়ে বসে থাকা সংস্কারগুলিই ব্যবহৃত হল তাঁর জীবনকে সাধারণের মন থেকে মসৃণভাবে সরিয়ে দেওয়ার কাজে। এই উন্নাসিক ট্যাবুর তো কোনো লিখিত তথ্যায়ন ঘটেনি, কিন্তু ক্ষমতা যে কিছুতেই তার জমি ছেড়ে বেরোতে পারে না, এ তারই প্রমাণ। অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার এই ইতিহাসের আরও একটি প্রমাণ, শিশির করের ‘ব্রিটিশ শাসনে বাজেয়াপ্ত বাংলা বই’-এর তালিকাতেও ‘নতুন দিনের আলো’-র উল্লেখ নেই।


[ লেখার মধ্যে ব্যবহৃত ছবিটিতে প্রখ্যাত কার্টুনিস্ট ডেভিড লো-র একটি কার্টুন নেওয়া হয়েছে ] 


[ কভার পোস্টার: অর্পণ দাস ] 

#বাংলা #নিবন্ধ #শ্রুতি গোস্বামী #নতুন দিনের আলো #বাজেয়াপ্ত বাংলা বই #নিষিদ্ধ বই #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ আইন #নাট্যাভিন্নয় নিয়ন্ত্রণ আইন #সিডিশান #চারুলতা #পথের দাবী #বিমলপ্রতিভা দেবী #বলশেভিক লেনিনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া #BLPI #নারী কর্মমন্দির #ঊর্মিলা দেবী #নওজোয়ান ভারত সভা #ফরোয়ার্ড ব্লক #আইন অমান্য আন্দোলন #কমিউনিস্ট পার্টি #ট্রটস্কি #এআইটিইউসি #আগুনের ফুলকি

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

21

Unique Visitors

219135