নিবন্ধ

বর্তমান সময়ে সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন

শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ April 17, 2021 at 7:36 am নিবন্ধ

প্রথমে এই বৈশাখে লিখি সদ্য বিগত চৈত্রের একটি বসন্ত উৎসবের কথা। চৈত্রসংক্রান্তিতে হয় চড়্ক-গাজনের উৎসব। সেই উৎসব অতি-প্রাচীন উৎসব। অবৈদিক এবং প্রাগ্‌-বৌদ্ধ যুগেরও বটে। সেই উৎসবের হোতা সকলেই ছিল প্রাচীনে নিশ্চয়ই। পরে অবস্থার বিবর্তনে বৌদ্ধ থেকে ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির চাপে চাপে নিশ্চয়ই হোতার দলও কিছুটা হলেও পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সেই পরিবর্তিত নামের মধ্যে থেকে কিছু নাম (৫৩টি) অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন। কয়েকটা নাম লিখি। সর্বাধ্যক্ষ, ধর্মাধিকারী, বালা, রায়বালা, প্রথমবালা, ধঢুলিসাভট ইত্যাদিতেই থেমে গেলাম। প্রথম দুটি নাম খানিক সংস্কৃত ঘেঁষা বলে বাঙালির একাংশ মানে বুঝবেন। এসব শব্দের এখনো ব্যবহার আছে। কিন্তু বালা পুরুষ না নারী? তথাকথিত বাংলার আধুনিক যুগের শুরুতে তো নারীনামের পরেই বালা বসত। এখন যদি এইসব সূত্র উদ্ধার করে বলি, বালা বললে আসলে সন্ন্যাসীদের বোঝায়, যাঁদের বালা ছাড়াও সাঙ্গ বা সাঁই-ও বলা হত, খানিক অসুবিধে হয় না? লালনকে সাঁই বললে সংস্কৃত 'স্বামী' শব্দটাই উৎপত্তি বলে ধরতে হবে কেন? এমত লোকউৎসবের সাঙ্গ বা সাঙ্গাৎ-কে সাঁই বলা থেকে তা আসতে পারে না?


এই চড়ক-গাজনে পুরোহিত তথাকথিত অন্ত্যজ বা নিম্নবর্ণেরই। পরে খানিক বামুনপনা ঢুকেছিল বটে। তবু এখনো যেখানে হয় তথাকথিত অন্ত্যজদের প্রাধান্যই বেশি। আরেকটা কথা, এও লেখা দরকার যে, চড়ক-গাজনের এই উৎসব 'দেল' উৎসব নামেও পরিচিত। 'দোল' নয়, 'দেল'। আবার 'দেল' বললে কিছু মানুষ চট করে অতিবুদ্ধিতে 'দিল' থেকে 'দেল কোরানে' চলে যাবেন। এমন হতে পারে না, যে অংশ ইসলামে গিয়েছেন তাঁরাই 'দেল' নিয়ে গিয়েছেন কোরানেও? এত সব কথা বলছি কেন সেটা বলি! সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বস্তুটা শুধু আজকের কোনো বিষয়ই নয়। দেল-চড়ক-গাজনের মতো প্রাচীন উৎসবেও সূর্যপুজোর ছলে ব্রাহ্মণপুজোও কেমন ঢুকে গিয়েছে দেখানোই যায়। যে পুজোতে ব্রাহ্মণ লাগে না, যেখানে বালাদার/রেরাই প্রধান, সেখানে বন্দনা ও প্রণাম সমাপ্তির পরে সূর্যপুজোর ছড়া কাটা হয়। তার একটা অংশ দিই।

                   ভাস্করায় নমঃ       হর মোর তম

                          দয়া কর দিবাকর।

                চারি বেদে কয়     ব্রাহ্মণ তেজোময়

                     সর্বজ্যোতি পরাৎপর।।

অঞ্চলভেদে এ ছড়ার ভিন্নরূপ থাকলেও এই 'ব্রাহ্মণ তেজোময়'-টা দেখার। এভাবেই আগ্রাসন চলে। এই আগ্রাসন অনেক বেশি গভীর। অনেক কাল আগে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বৌদ্ধ সময়কালের বাংলায় বৌদ্ধ প্রভাবের অবসান নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন 'বেনের মেয়ে'। সেই টেক্সটকে ধরলে বেশ একটা ধাঁচ পরিষ্কার হয়। বাগদি রাজা। তাঁর গুরু বৌদ্ধ। রাজার দানে-দক্ষিণায় মঠ চলে তাঁদের। ওদিকে নিঃসন্তান বণিকের মৃত্যুর পরে তার স্ত্রী-র ওপর মঠের থেকে প্রবল চাপ আসতে থাকে ভিক্ষুণী হবার জন্য। অথবা সম্পদ মঠকে দান করার জন্য। ওদিকে মঠাধ্যক্ষ, যিনি রাজার গুরুর প্রিয় শিষ্য, তিনি আবার এই স্ত্রী-টির প্রেমে পড়েছেন। এইসব নিয়ে নানা কাণ্ড ফেঁদে অবশেষে শাস্ত্রী মহাশয় দেখালেন তথাকথিত হিন্দু ব্রাহ্মণ এবং পার্শ্ববর্তী রাজারা কেমন করে বাগদি রাজা ও বৌদ্ধদের হটিয়ে সনাতনী সমাজ বসাচ্ছেন। সেই সমাজে বাইরে থেকে আসা ব্রাহ্মণের মতোই সৎ শূদ্র আসছে, গোয়ালা থেকে কারিগর ইত্যাদি হয়ে। তার মানে শুধু নতুন রাজা বা ব্রাহ্মণ-কায়স্থই নয়, একেবারে বর্ণাশ্রমে বিভক্ত সমাজকে অন্য জায়গা থেকে উপড়ে এনে বসানো হচ্ছে বাংলার একটি রাজ্যে। সেই স্ত্রী-র সমস্যার সমাধান হচ্ছে দত্তক পুত্র নিয়ে। স্ত্রী-র সতীত্ব থেকে সম্পদ কিছুই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না। সমাজ তার রক্ষণশীল চরিত্রকেই মহান রক্ষাকর্তা বলে স্থাপন করছে শাস্ত্রী মশাই-এর কলমে। অথচ বেদেও কিন্তু বিধবা বিবাহের কথা আছে। সেই বৈদিক রীতি শাস্ত্রী মহাশয় উপন্যাসে আনতে সাহস পেলেন না? সনাতনী ধ্যান-ধারণা ও তৎকালীন সমাজ-ভাবনা তাঁকে বাধা দিল? নাকি নিজেই চাইলেন না এমন অসনাতনী বিবাহ আচরণ ঘটাতে। প্রেম তো বিভীষিকা সেখানে। এই আগ্রাসন আরো গভীর আগ্রাসন। বহুযুগ ধরে চলছে।


আরও পড়ুন

মুসোলিনির উত্তরাধিকার : ফ্যাসিবাদের জীবাণু ও তার সাধারণ লক্ষণ

এই ধারাতেই এসেছে বাংলার তথাকথিত নবজাগরণ। ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গী ও তাঁবেদার বাঙালি হিন্দুর দল আচমকাই আবিষ্কার করলেন মুসলমানই শত্রু। ব্রিটিশের মতো মানুষ হয় না। আপিম থেকে দাস ব্যবসা, কয়লা থেকে নীল, পাট, সবেতেই তো মুনাফাই মুনাফা। সিরাজ লম্পট স্বেচ্ছাচারী। গিয়েছে বাঁচা গেছে। আর বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর। আশ্চর্য, এত তাবড় তাবড় পণ্ডিতেরা কেউ বললেন না নবাব হোক কিংবা রাজা, কে না লম্পট হয়! এই যে দেব-দেবীদের কাহিনি, গ্রিক থেকে প্রাচীন ভারতীয় পুরাণ জুড়ে, তাতে কম লাম্পট্য আছে? তবে দেবরাজ ইন্দ্রকে পূজা কেন? কেউ বললেন না, মীরজাফর রীতিমতোই সুবিধে নিতে গেছিলেন মাত্র। আগে সেনাবাহিনীর টাকা মেরেছেন। তারপরে সিরাজকে না সরালে বেশ ঝামেলায় পড়তেন, তাই সিরাজের বিরুদ্ধে। কিন্তু জগৎশেঠ থেকে রাজবল্লভ কিংবা উমিচাঁদেরা? জগৎশেঠের হাতেই তো ছিল নবাবের কোশাগার সেই কবে থেকে। এমনি এমনি লোকটার অত টাকার দাপট হয়? জগৎশেঠ উপাধি হয়? সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের মূল হোতাই তো এরা! বিশ্বাসঘাতক নয় এরা?

সেকালে হিঁদুয়ানির প্রবক্তা রাজনারায়ণ নিজে নিয়েছিলেন ব্রাহ্ম ধর্ম। নিয়ে হিঁদু সমাজপতিদের চাপে ছেড়ে এলেন নিজ জন্মস্থান। অথচ আজীবন হিন্দুদের সংগঠন গড়ার কথা বলে গেলেন। ইনিই হিন্দু মহাসভার প্রকৃত জনক। বক্তব্যটা কী? যা চাপা থাকে টেক্সটের ভিতরে? মুসলমানেরা আসার পর থেকে সত্যযুগ চলে গেছে। তাই? তাহলে শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব-ঐন্দ্র্য-গাণপত্য, কোনো মারামারি কোনো কালে ছিল না? বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের সম্পদ নিয়ে ঝগড়ার গল্প কিছু বোঝায় না? ভার্গবদের সঙ্গে হৈহয় ক্ষত্রিয়দের বিরোধের গল্প, ভার্গব পরশুরামের কার্তবীর্যার্জুন বধ এবং নিক্ষত্রিয় করার কাহিনি কোনো বিরোধের চিহ্ন ধারণ করে না? বৌদ্ধদের বা শ্রামণিকদের বিরুদ্ধে ভবভূতি থেকে রামায়ণ-মহাভারতের সম্পাদিত পাঠগুলোতে বিদ্বেষের চিহ্ন বোঝায় এই সবই সত্যযুগ? নাকি ত্রেতা-দ্বাপর বলে এইসব, সেই সত্যযুগে একমাত্র বৈদিকরাই ছিল বলে এসব ছিল না, সেখানেই ফিরতে হবে। অর্থাৎ উত্তর-পশ্চিমে আসা একটি জাতিগোষ্ঠীর ভাবনাই একমাত্র সত্য, বাকি পৃথিবী মিথ্যে। তা ঋক আর সাম-এর ঝগড়াটাও মুসলমানদের আগমনের ফল? যাক গে, এমন অজস্র উদাহরণ আনা যায়। আনব না। বলার কথা, পরের দিকে হিন্দুত্ববাদীদের হাতে রামের মন্দির ভেঙে বাবরি, তাই বাবরি ভেঙেই রামের মন্দির হবে– এই ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্ব নিয়ে দু-এক কথা।

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার তত্ত্বে বহু কিছুর ব্যাখ্যা মেলে? তাই না? এই যে বঙ্কিম-ভূদেব হিন্দুয়ানি নিয়ে নানা কথা বললেন, তা কেউ কেউ বলবেন আগের যবন শাসনের প্রতিক্রিয়া। ফিরিঙ্গি আসাতে তা স্পষ্ট করে ব্যক্ত হল। আবার বঙ্কিমেরা ব্যক্ত করলেন বলে চন্দ্রনাথ বসু 'হিন্দুত্ব -হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস' বলে বই-ই লিখে ফেললেন। এই প্রথম 'হিন্দুত্ব' কয়েনেজটি সার্থকভাবে ঘোষিত হল– যা সামাজিক-রাজনৈতিক হয়ে উঠছিলই, তাকে রাজনৈতিক-রাষ্ট্রনৈতিক করা গেল। হিন্দুই জগৎশ্রেষ্ঠ (কেমন যেন জগৎশেঠ মনে হয়) এই বানোয়াট– খেলা করতে শুরু করল বাংলার ইতিহাসে। ক্রমে বাকি ভারতের ইতিহাসে। প্রসঙ্গত বলে রাখি বাংলায় লিখিতভাবে 'ভাটের কাহিনী' কথাটি তাচ্ছিল্যবাচকভাবে ব্রিটিশের বড় চাকুরে চন্দ্রনাথ-ই বোধহয় চালু করেন, ইউরোপধর্মী ইতিহাসচর্চাকে চিহ্নিত করতে।

 

আজ হঠাৎ এখানে হিন্দুত্ব এয়েছে বললে তো হবে না, এখানেই ভিতপুজো হয়েছে মানাটা আশু দরকার। হয়েছে বলে এই লাইন ধরে কালে কালে ব্রিটিশ ধামাধরা দেবেদের 'ধর্মসভা' (দেবেন্দ্রনাথও পৃষ্ঠপোষক? কিমাশ্চর্যম?) থেকে 'অনুশীলন সমিতি' জাতীয় গুপ্ত সমিতি জন্মাবে। তারা গীতা আর তলোয়ার নিয়ে (কুরান আর তলোয়ার বা বাইবেল আর তলোয়ার পরম্পরায়?) সদস্যদের গুপ্ত শপথ নেওয়াবে। শুধু কালীর সামনে বা ভারতমাতার সামনেই শপথ নয় কিন্তু, মনে রাখবেন। তারপরে আমরা কাঁদব ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গে ‘অ্যাঁ অ্যাঁ মোছলমানেরা আসেনি গা’ বলে।

 

মুজফ্‌ফর আহমদ্‌ লিখেছিলেন সেই সময় তিনিও চাইলে বঙ্গভঙ্গের পক্ষে বা বিপক্ষে যোগ দিতে পারতেন। একেবারেই অসাম্প্রদায়িকও ছিলেন না তিনি। নামাজ রোজ না পড়লেও রোজা রাখতেন ইত্যাদি। আর বঙ্কিম এবং আনন্দমঠ এবং বন্দেমাতরম-এর দেবীপূজা সেই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু ভদ্রলোকদের মূলমন্ত্র বলে জানতেন। ব্রিটিশের আরেক বড় চাকুরে বঙ্কিমের লেখা তাই পড়তেন না। একেশ্বরবাদী মুসলমান পরিবারের ছেলে এভাবে স্বদেশীতে কেমন করে যোগ দেয়? এ প্রশ্নটাও করেছিলেন তিনি। তবু তাঁরই বন্ধু এস এম আবদুল আহাদ কিন্তু ইংরেজির পাশাপাশি বঙ্কিমও তাঁকে পড়িয়ে ছেড়েছিলেন। অর্থাৎ ততটাও বিষ ছিল না, যা অতিক্রম করা যায় না।

 

কিন্তু গোলমাল আরো তো ছিল। মুজফ্‌ফর আহমদ দেখেছেন নোয়াখালিতে স্বদেশী দ্রব্য কেনার তালিকায় জাপানের দেশলাই-এর উপস্থিতি। খুব খারাপ দেশলাই। জ্বালাতে জান চলে যেত। যাই হোক, জাপানি দেশলাই স্বদেশী দ্রব্য হল? এ দেশে, বিশেষ করে বাংলাতে কারা আনত এসব? পার্সিরা! নৌরোজি ফ্রামজি বাবার সঙ্গে মিলে শুরু করেছিলেন এফ.পি.নাল্লাদুরু কোম্পানি। ইটালি, চেকোস্লোভাকিয়া, অস্ট্রিয়া, চিন আর জাপান থেকে আনতেন দেশলাই, আরো কিছুর সঙ্গে। শুধু বুদ্ধি খরচ করতেন বলে সেই দেশলাই স্বদেশী হয়ে যেত। এখানে এনে দেশলাই বাক্সটাতে বাংলায় নাম, বাংলায় লেখা আর বাংলার লোকের ছবি ব্যবহার করত। ব্যস, দেশি হয়ে গেল। এখন যখন আপনার খোকা-খুকু বাংলাতে পড়ে না, পড়লে নীচু চোখে দেখা হয়, তখন মনে রাখবেন বাংলার বাণিজ্য আমার/আপনাদের পূর্বজরাই জমিদারি করতে ইউরোপিয়ান থেকে পার্সি, মাড়োয়ারিদের হাতে তুলে দিয়েছে। আর জমিদারি ফুঁকতে ফুঁকতে ‘হিন্দুত্ব–প্রকৃত ইতিহাস’ চর্চা করেছে। আর প্রথমে ধুতি-শাড়ি মাথায় চড়িয়ে তারপরে প্যান্ট-কোট-টিশার্টে পৌঁছে গেছি আমরা। জাতীয়তাবাদ!!

 

এসব বিচিত্র কাণ্ড আর হিন্দু জাতীয়তাবাদ কেমন করে জুড়বে বাঙালিকে? উল্টোদিকে জন্মাচ্ছে মুসলিম জাতীয়তাবাদও। হিন্দু আর মুসলিম জাতি কেমন করে হয় সে প্রশ্নও কেউ স্পষ্ট করে না তখন, উত্তরও দেয় না। যাক গে, মোছল্‌মানেরা তো কয়েকজন বাদ দিলে কেউ তেমন এলেন না। তাহলে? বিপ্লববাদী হিঁদুয়ানির দল নিশ্চয়ই দাপটে ব্রিটিশ তাড়িয়ে ছেড়েছিল?

 

সাড়া তাঁরা ফেলেছিলেন অবশ্যই। আত্মত্যাগও অনেকে করেছেন তাও সত্যি। কিন্তু আত্মত্যাগীদের বাইরেও যে অংশটা এই হিন্দু আগুন জ্বালালেন, মুখ্যত নেতাকুলের একাংশ, তাঁদের নিয়ে ভাবনাগুলো সেকালেও খুব আহ্লাদজনক ছিল না। এখানেই চলে আসি হেমচন্দ্র কানুনগোতে। মনে আছে তো? অনুশীলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অরবিন্দ এবং বারীন্দ্রকুমারের সঙ্গেই। বিদেশ থেকে তিনিই নিয়ে এসেছিলেন সামরিক প্রশিক্ষণ। তাঁর তৈরি বোমাই ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল চাকীরা ব্যবহার করেছিলেন। এবং একমাত্র আলিপুর বোমা মামলার আসামি, যিনি পুলিশের কাছে কোনো স্বীকারোক্তি দেননি। অনুশীলন-বীর, অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষদের প্ররোচনা সত্ত্বেও অটল ছিলেন স্বীকারোক্তি না দেওয়ায়। জেল খেটেছেন, কথা কিন্তু বলেননি। সেই তিনিই কথা বললেন তাঁর লেখাতে। 'বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা'-তে। এঁকে নমস্কার করি চাঁচা কথা বলার জন্য। কেমন শুনবেন? এই যে ঘটা করে দীক্ষা, গুপ্ত সমিতি হাবভাব, বিপ্লবের জন্য গোটা দেশে লক্ষ লক্ষ সৈন্য তৈরি বলে মিথ্যা বোঝানো– সব তিনি লক্ষ করেছেন। দীক্ষা নিয়ে বলতে গিয়ে চেঁচে দিয়েছেন।

বলছেন দীক্ষা নিয়ে তাঁর মনে সন্দেহ জাগেনি। কিন্তু গুপ্ত সমিতির বীভৎস কাজগুলো কর্তব্য বলে মনে স্থির করে নিলে, তারপরে যখন সংকট আসে (মানে পুলিশ, থানা, গ্রেপ্তার, মামলা, মারধর, ফাঁসি এইসব বোধহয়) তখন বিবেকের দোহাই দিয়ে কর্তব্য ত্যাগের সম্ভাবনা খুবই বেশি। লাইনটা আদপে দেখিয়ে দিয়েছেন বঙ্কিম-ই। এও স্পষ্ট বলছেন হেমচন্দ্র।

কেমনভাবে? তার আগে বলি ওই যে চন্দ্রনাথ বসু 'হিন্দুত্ব– প্রকৃত ইতিহাস' লিখেছিলেন ব্রহ্ম-ব্রহ্মাণ্ড হ্যানো-ত্যানো দিয়ে, তিনি আরো কিছু আমোদের কাজও করেছিলেন। জুলিয়েট কেমন বস্তুবাদী আর শকুন্তলা কেমন পতিনিষ্ঠ ভারতীয় নারী, এ সবের তুলনা করেছেন। মহান ভারতীয় নারী সাবিত্রীর আদর্শে সব মেয়েদের ঢালবার জন্য। [এখানে একটু সাম্প্রতিক অতীতের হাথরসে আবার ঘটা ঘটনাটা– মেয়ের বাপের গুলি খেয়ে মরা ইভটিজারের হাতে, মনে রাখবেন দয়া করে। আদর্শ হিন্দু রাজ্যে এমনটাই তো ঘটার কথা।]

 

আর হেমচন্দ্র-ও তুলনা দেখিয়েছিলেন আরেকরকম। দেখিয়েছিলেন, সংকটকালে কেমন করে কর্তব্য ত্যাগ করতে হয় তার রাস্তাটাও বঙ্কিমই তাঁদের দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কেমন করে? ওই যে ভবানী পাঠক ইংরেজের হাতে ধরা পড়া নিশ্চিত জেনে My misson is over বলে টুক করে দাঁড়ি টানলেন। প্রফুল্ল-ও দেখলেন এত সাধনার দেবীগিরি তত সুখকর নয়। তখন কৃষ্ণে সব সমর্পণ করে, স্বামীসেবা কর্তব্যপালনরূপ শ্রেষ্ঠ কর্তব্যের টানে ব্রজেশ্বরের আরো দুটি শাকের আঁটির উপরে বোঝা হয়ে সংসারে ফিরে গেলেন।

 

ভবানীর মতো কাজই আনন্দমঠ-এ সত্যানন্দ করেছিলেন, বলছেন হেম কানুনগো। এও বলছেন জীবানন্দ আদর্শ-কর্তব্য ত্যাগ করে শান্তির আঁচল ধরে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেল একইভাবে। হেম কানুনগো আরো লিখছেন, এভাবেই আমাদের অতিবৃহৎ নেতা থেকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সেবকদের জীবনে কর্তব্য আর অন্য কিছুর উভয় সংকট দেখা দিলেই কর্তব্য উল্টে-পাল্টে ধোঁয়া হয়ে যায়।

 

তাহলে? গোদা করেই বলি। এসব দেখে বুঝতে চাইলে বোঝাই যায় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তত্ত্বে হিঁদু-মোছলমান সাজা চলে অহরহ, আরো অনেক কিছুই সাজা চলে, দেশের কাজ তাতে ঘণ্টা হয়! কাজের মিমিক্রি হয়, কাজ অভাগা না খেয়ে না দেয়ে শুকিয়ে মরে পড়ে থাকে। দেশ-ও তাই। পেটে খেতে পাই না, পায়ের লাথেরও জোর নেই; তবু খাবার-দাবার নয়, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্ম নয়, এই সব হিঁদু-মোছলমান, খতরে মে হ্যায়-এর 'ভাটের কাহিনী'-তে (চন্দ্রনাথের ঋণশোধ আর কী) ছাগলের তৃতীয় সন্তানের মতো নেচে বেড়াই। ওই আমাদের ধর্ম। ক্রিয়া করার মুরোদ নেই প্রতিক্রিয়া দিয়ে মরি।

 

লেখার বিষয় ছিল বর্তমান সময়ে সংস্কৃতির উপর আগ্রাসন। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে আগ্রাসনটা বর্তমান সময়ের শুধু নয়। আগে তো জাতি হিসেবে মানতে হবে ব্রিটিশকে পা রাখার জায়গা ভালো করে দেওয়া থেকে শুরু করে এই আগ্রাসনের রূপরেখাও বাঙালিই স্থির করে দিয়েছে একদা। নইলে বুঝতে পারব না আচমকা এত ঘরশত্রু বিভীষণ জন্মাচ্ছে কোথা থেকে। জন্মাচ্ছে না আলাদা করে। বহু যুগ, আমাদের ভেতরেই এইসব বিভীষণ বেড়েছে। বাড়ে। তাই আজকের আগ্রাসন আসলে একটানা বহুযুগ ধরে চলা ব্রাহ্মণ্যবাদের আগ্রাসন, যা সামরিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এবং সামাজিক। বাঙালি মিশ্র জাতি। নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে সে মিশ্র বলে কারো ভালোটা নেওয়া তার সমস্যা ছিল না। মন্দও অঢেল নিয়েছে বটে। কিন্তু বহু যুগ ধরেই চেষ্টা চলছে তার মিশ্রত্বের চেহারা, বহুত্বের চেহারাকে স্টিম-রোলার চালিয়ে সমান করে দিয়ে স্রেফ ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রতিষ্ঠার।

 

তবে ইতিহাস ভারী মজার! যে দক্ষিণ ভারতীয় রাজা বল্লাল এখানে কুৎসিত বর্ণপ্রথা এনেছিলেন, কনৌজ থেকে ব্রাহ্মণ ধরে এনে এখানে সে ব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে প্রবর্তনের ব্যবস্থা করেছিলেন, সেই বল্লালই আবার ডোম নর্তকীর প্রেমে পড়েছিলেন। ফলে পুত্র লক্ষ্মণ সেন সমেত বহু জাতিতে 'ওঠা' শাসিতদের সঙ্গে তাঁর বিরোধও বাধে। অর্থাৎ আদপেই বহিরাগতরা এসে বাঙালিদের উপর কিছু চাপিয়ে দিলেই তার চাপ থেকে যাবে এমনটাও না। দেল-চড়ক-গাজনে সূর্য আর ব্রাহ্মণ পুজো ঢোকালেই তাকে গোটা গিলে নেওয়া সম্ভব হয় না, বদলে সে-ই গিলে নিয়ে চলতে থাকে পথ। এও ইতিহাস। বর্তমান তাই ব্রাহ্মণ্যবাদী এবং আসলে পুঁজির দালালদের জন্য খুব সুখকর হবে এমন ভাবার কারণ খুঁজে পাচ্ছি না।


[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস ]
[ লেখায় ব্যবহৃত পোস্টারের কার্টুনটি ডেভিড লো-র আঁকা ]
#বাংলা #নিবন্ধ #রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন বিরোধী লেখাগুচ্ছ #ফ্যাসিবাদ #Fascism # শুদ্ধসত্ত্ব ঘোষ #চিন্তাহরণ চক্রবর্তী #সর্বাধ্যক্ষ #ধর্মাধিকারী #বালা #রায়বালা #প্রথমবালা #ধঢুলিসাভট #লালন #সাঁই #চড়ক গাজন #দেল #সাংস্কৃতিক আগ্রাসন #হরপ্রসাদ শাস্ত্রী #রাজনারায়ণ বসু #বেণের মেয়ে #বাংলার নবজাগরণ #মুসলমান বিদ্বেষ #হিঁদুয়ানি #শৈব #শাক্ত #বৈষ্ণব #ঐন্দ্র্য #গাণপত্য #হৈহয় ক্ষত্রিয় বিরোধ #কার্তবীর্যার্জুন বধ #ভার্গব #পরশুরাম #ভবভূতি #রামায়ণ #বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় #ভূদেব #চন্দ্রনাথ বসু #হিন্দুত্ব -হিন্দুর প্রকৃত ইতিহাস #ধর্মসভা #মোজাফ্ফর আহমেদ #এস এম আব্দুল আহাদ #নৌরোজি ফ্রামজি #এফ.পি.নাল্লাদুরু কোম্পানি #অরবিন্দ #বারীন্দ্র #বাংলার বিপ্লব প্রচেষ্টা

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

55

Unique Visitors

185012