‘প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি’ – অথ Soul Food কথা
.....................................
[রসিয়ে কষিয়ে : সপ্তদশ পর্ব]
.............................................
বিশ্বায়নের দৌলতে শিলিগুড়ি থেকে কলকাতার মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তের ঘরে ঘরে KFC বা কেন্টাকি ফ্রায়েড চিকেন নামটা বোধহয় আর অপরিচিত নেই। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের খুবই প্রিয় এই ভাজা মুরগির মাংস। এত জনপ্রিয় এই খাবার কি শুধুই হুজুগ? নাকি এর পিছনে আছে দীর্ঘ এক ইতিহাস?
আমেরিকান খাবার কী এবং তাতে কী কী উপাদান রয়েছে– এই প্রশ্ন উঠলে আমেরিকার ঔপনিবেশিক যুগ এবং বর্ণবিদ্বেষের কালা ইতিহাসের কথা আসবেই। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের খাবারের যেমন আলাদা আলাদা চরিত্র আছে, তেমনি দীর্ঘদিন সহাবস্থানের কারণেই তা নানাভাবে মিলেমিশে গিয়েছে। দক্ষিণ অঞ্চলের প্রদেশগুলোতে, যেখানে দাস ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, সেখানকার খাবারকে বলা হয় ‘সাদার্ন ক্যুইজিন’। ফ্রায়েড চিকেন, ফ্রায়েড ফিশ, কর্নব্রেড, পোটাটো স্যালাড, ম্যাক অ্যান্ড চিজ– এই সবই সাদার্ন খানাপিনার অংশ। তুলো আর ধানের খেতে কাজ করার জন্য আফ্রিকা থেকে শয়ে শয়ে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে ক্রীতদাস হিসেবে নিয়ে আসা হয়। নিয়ে আসে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক বণিকরা। এই দক্ষিণী খাবারে যেমন ইউরোপীয় উপাদান আছে, তেমনভাবেই চলে এসেছে নানান রকম আফ্রিকান উপাদান।
খেতের কাজ থেকে বাড়ি দেখভালের কাজকর্ম– ক্রীতদাসদের সবকিছুই বিনা পারিশ্রমিকে করতে হত। বিনিময়ে পাওয়া যেত মালিকদের উচ্ছিষ্ট খাবার কিংবা একেবারেই যৎসামান্য খাদ্যশস্য, মাছ-মাংস, প্রায় পচে যাওয়া সবজি ইত্যাদি। তাই দিয়ে কোনোমতে রান্নাবান্না করতেন তুলোর খেতের ক্রীতদাসেরা। অনেকেই সকালবেলা হাঁড়ি চাপিয়ে কাজে চলে যেতেন, সারাদিন ধরে আস্তে আস্তে রান্না হতে থাকত। ভোর থেকে সন্ধে পর্যন্ত কাজ করে এসে কোনোমতে খেয়ে নিয়ে পরদিন ভোরে আবার কাজে যাওয়া– তাই রান্নার প্রণালী হত সহজ, জটিলতাহীন। এভাবেই জন্ম হয় ‘সোল ফুড’-এর (soul food)। যেই খাবারের নামেই আত্মার যোগ রয়েছে, তা খেয়ে ‘প্রাণের আরাম’ না হয়ে কি থাকতে পারে? প্রকৃত অর্থেই ‘কমফর্ট ফুড’।
ক্রীতদাসরা অনেকেই শ্বেতাঙ্গ মালিকের বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন। তাঁরা ছিলেন মূলত ফরাসি বা স্প্যানিশ বণিক। মালিকের বাড়িতে রান্নার উপকরণ এবং পদ্ধতি দুই-ই হত ইউরোপিয়ান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আফ্রিকান খানসামারা ইউরোপীয় রন্ধনশৈলীতে পারদর্শী হয়ে ওঠে। এদিকে উচ্ছিষ্টের মধ্যে যে মাছ মাংসটুকু তাঁরা পেতেন, তা সাধারণত হত ছাঁটের মাংস, গিলে মেটে, পূর্বব্যবহৃত তেল কিংবা প্রায় পচে যাওয়া সবজি। তুলো খেত বা ধান খেতে কাজ করার মাঝে সময় পেলে আফ্রিকানরা ফলাতেন দেশ থেকে নিয়ে আসা ফলমূল-শাকসবজি। নিজেদের খাবার বানানোর সময়ে দেশের কথা মনে করে সেগুলোও ব্যবহার করতেন তাঁরা। ঢ্যাঁড়শ এবং নানান রকমের শাকপাতা (কালার্ড গ্রিনস) ছিল এর অন্যতম উপাদান। এ ছাড়া থাকত কর্নমিল, গ্রিট (ভুট্টা থেকে তৈরি আরেকরকম দানাশস্য), হট পেপার সস, শুয়োরের চর্বি, ক্যানোলা অয়েল, শুয়োরের ছাঁট মাংস ইত্যাদি। রাজ্য বিভেদে আরও আলাদা অনেক কিছু পাওয়া যেত। যেমন ফ্লোরিডা বা সাউথ ক্যারোলিনায় অ্যালিগেটরের সসেজ খুবই জনপ্রিয় ছিল– ক্রীতদাসদের কমফর্ট ফুডের অন্যতম উপাদান। ল্যুইজিয়ানায় গিলে মেটে ভেজে খাওয়া হত, নাম চিটারলিংস। কখনো ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়া হত– ভাতের মধ্যে গিলে মেটে পড়লে দেখতে নোংরা লাগে, তাই নাম ‘ডার্টি রাইস’। বহুবার ব্যবহৃত পোড়া তেল দিয়ে কড়া করে ভেজে নেওয়া হত শুয়োর কিংবা মুরগির ছাঁট মাংস বা কড মাছ। এ ছাড়া প্রায় সব রাজ্যেই টমেটো দিয়ে ঢ্যাঁড়শের ঝোল খুবই সাধারণ ছিল। আফ্রিকান খাদ্য উপাদান ব্যবহার করে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে রান্না ক্রমে হয়ে ওঠে সোল ফুডের উপপাদ্য।
অনেকদিন পর্যন্ত কিন্তু ‘সোল ফুড’ নামটাই ছিল না। ষাটের দশকে যখন সিভিল রাইটস আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে সারা দেশে, আফ্রিকান-আমেরিকানরা লড়াই করছেন নিজেদের অধিকারের জন্য, তাঁদের অত্যাচারের ইতিহাসকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য; তারই মাঝে তাঁরা খুঁজে নিচ্ছেন নিজেদের সংস্কৃতি, নিজেদের আত্মপরিচয়, তৈরি করছেন নিজেদের ন্যারেটিভ। এই সময় নাগাদ তাঁরা এমন কিছু শব্দচয়ন করছেন, যা তাঁরা নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যবহার করতে অভ্যস্ত। ‘Soul Sister’, ‘Soul Music’, ‘Soul Food’– এই শব্দগুলি সেই সময়ের আন্দোলনেরই ফসল। এইভাবেই সোল ফুড হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ রাজ্যগুলির আফ্রিকান-আমেরিকান খাবারের আইকন। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমেরিকার উত্তর এবং মধ্য-পশ্চিমে যখন শ্রমিকের প্রয়োজন দেখা দেয়, কর্মসংস্থানের খোঁজে আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষরা পাড়ি দেন সেইসব রাজ্যগুলিতে। তাঁদের হাত ধরেই ‘সোল ফুড’ উত্তরে এসে পৌঁছয়। তবে আজও কিন্তু সোল ফুড বললেই মনে হয় ‘সাদার্ন চার্ম’-এর কথা।
যদি কেউ মার্কিন মুলুকের সাদার্ন ক্যুইজিন নিয়ে গবেষণা করতে চান, তাহলে সতর্ক করে দেওয়া দরকার। কারণ সাদার্ন ক্যুইজিন এবং সোল ফুডের মধ্যে অনেক সময়েই গুলিয়ে যায়। এই সমস্ত উপকরণ সাদার্ন ক্যুইজিনেও আছে, অন্যভাবে আছে। বিখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান শেফ বব জেফ্রিস তাঁর ‘সোল ফুড কুকবুক’-এ বলেছেন, “সোল ফুড মাত্রেই সাদার্ন খাবার কিন্তু সাদার্ন খাবার মাত্রেই সোল ফুড নয়।” উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ‘দ্য হেল্প’ সিনেমার কথা। বাড়ির পরিচারিকা কৃষ্ণাঙ্গ মিনির বানানো ফ্রায়েড চিকেন খেতে শ্বেতাঙ্গ মালকিন সিলিয়া খুবই পছন্দ করত। কিন্তু সিলিয়া নিজে শত চেষ্টা করেও মিনির মতো ফ্রায়েড চিকেন বানিয়ে উঠতে পারত না। ফ্রায়েড চিকেন শুনলে মনে হবে খুবই সাধারণ হোমোজেনাস একটি খাবার, অথচ তার মধ্যেই কত পরত লুকিয়ে আছে। সাদার্ন ক্যুইজিনের যে আফ্রিকান-আমেরিকান উপাদান, তাতে নানারকম মশলার ব্যবহার রয়েছে, যা সোল ফুডের অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মিনির ফ্রায়েড চিকেনে সেই ‘সোল ফুড’-এরই ছাপ দেখা যায়। অন্যদিকে ইউরোপিয়ান-আমেরিকান সাদার্ন খাবার অনেক বেশি সাদামাটা। এ ছাড়াও সাদার্ন ক্যুইজিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্রেওল ক্যুইজিন। তার গল্প আরও সুবিস্তৃত।
আরও পড়ুন : ‘কিসসা কাঁচা মাংস কা’ – মানুষে কী না খায়? / অনমিত্রা চক্রবর্ত্তী
একদিন যেই খাবারের জন্ম হয়েছিল ইউরোপিয়ান মালিকদের উচ্ছিষ্ট খাবার থেকে পুষ্টি খুঁজে নেওয়ার লক্ষ্যে, দুঃখের বিষয় আজও তা সেখানেই রয়ে গিয়েছে। ‘সোল ফুড’ হয় পোড়া তেলে কড়া করে ভাজা, মাংসের ছাঁট কিংবা এমন সমস্ত জিনিস যাকে কোনোভাবেই বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর আখ্যা দেওয়া যায় না। সিভিল রাইটস আন্দোলনের ষাট বছর পরে আজও এ দেশে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার সবচেয়ে বেশি। ফলস্বরূপ শিক্ষার অভাব, বেকারত্ব, অসুস্থতা– একে একে গ্রাস করছে পুরো সম্প্রদায়কে। শিক্ষার অভাব থেকে আসে সচেতনতার অভাব, স্বাস্থ্যব্যবস্থার অ্যাক্সেস না থাকার কারণে তাঁদের সামাজিক প্রগতি আরও রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। বর্তমানে আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে ওবেসিটির হার সবচেয়ে বেশি। বাইরন হার্টের তথ্যচিত্র ‘সোল ফুড জাঙ্কিস’-এ বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহ চিত্র পরিষ্কার করে তুলে ধরা হয়েছে। যেই সম্প্রদায়ের অত্যাচারের ইতিহাস, বঞ্চনার মধ্যে দিয়ে এই খাবারের জন্ম, যা সেই সমাজের পরিচয়ের অন্যতম প্রতীক, যেই সমাজের অধিকারের আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এই খাবারের নামকরণ, তাকে কখনোই পুরোপুরি বর্জন করা সম্ভব নয়, এমনকি তা কাম্যও নয়। কিন্তু সেই সমাজের সার্বিক উন্নতির জন্য জনস্বাস্থ্যের নিরিখে তাকে পুনর্মূল্যায়ন করার প্রয়োজন রয়েছে। মনের আরামের সঙ্গে শরীরের পুষ্টি জোগালে, তবেই তো ‘সোল ফুড’ প্রকৃত অর্থে কমফর্ট ফুড হবে– হয়ে উঠবে ‘প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি’।
.......................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]
#Soul food #Southern United States #KFC #Southern Cuisine #Comfort Food #African Americans # Soul Food Cook Book #bob jeffries #রসিয়ে কষিয়ে #নিবন্ধ সিরিজ #অনমিত্রা চক্রবর্ত্তী #সিলি পয়েন্ট