নিবন্ধ

‘কিসসা কাঁচা মাংস কা’ – মানুষে কী না খায়?

অনমিত্রা চক্রবর্ত্তী Dec 20, 2020 at 7:22 am নিবন্ধ

রসিয়ে কষিয়ে
ত্রয়োদশ পর্ব

‘দ্য রেভেন্যান্ট’ ছবির এক দৃশ্যে যখন আমরা হিউগ গ্লাসকে কাঁচা মাংস খেতে দেখি, গা গুলিয়ে ওঠে। মুখ থেকে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে, তবুও হিউগ গোগ্রাসে কামড়ে খাচ্ছে বাইসনের কাঁচা মাংস। ভাত-ডাল খাওয়া মধ্যবিত্ত বাঙালির দৈনন্দিন খাওয়া-পরার সঙ্গে এই অস্তিত্বের সংগ্রামের এতটাই পার্থক্য যে অনেকদিন পর্যন্ত এই দৃশ্যটি অবিশ্বাস্য মনে হত। শুধু মনে হত– কী করে মানুষ কাঁচা জিনিস খেতে পারে? অথচ তলিয়ে দেখলে, আমরা তো ফল এবং অনেকরকম সবজি (বিশেষ করে স্যালাড) কাঁচাই খেয়ে এসেছি চিরকাল। এগুলোও তো খাওয়ারই ‘জিনিস’। কখনও তো গা গুলিয়ে ওঠেনি। মনে হয়নি এই কাঁচা জিনিসগুলো খাওয়া উচিত কি না!   


ফরাসি নৃতত্ত্ববিদ লিভাই-স্ট্রস তাঁর ‘দ্য র অ্যান্ড দ্য কুকড’ বইতে তুলে ধরেছেন raw এবং cooked-এর চিরন্তন দ্বন্দ্বের কথা। তিনি বলেছেন এই বৈপরীত্যের সংজ্ঞা কীভাবে শুধু পদ্ধতির উপর নির্ভর করেই ক্ষেত্রবিশেষে রূপান্তরিত হয়ে যেতে পারে। Raw মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির আদিম যোগসূত্রকে তুলে ধরে, আর cooked হল সভ্যতার ত্রেতাযুগ থেকে কলিযুগের দিকে যাত্রাপথের সাংস্কৃতিক টোটেম। তখনই আরেকবার প্রমাণ হয়ে যায় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কীভাবে কিংবদন্তি আমেরিকান ফ্রন্টিয়ার্সম্যান হিউগ গ্লাসকে বেঁচে থাকার আদিম নেশাই বাধ্য করে আদিমতম খাওয়ার পদ্ধতির কাছে ফিরে যেতে।  


তবে কাঁচা মাংস মানেই কিন্তু ‘আদিম’, ‘বর্বর’, ‘জান্তব’ নয়। পৃথিবীর বহু দেশ, যাদের হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে সমৃদ্ধ সংস্কৃতি, তারা কিন্তু আজও কাঁচা মাংস খায়। তারিয়ে তারিয়েই খায়। কোথাও কোথাও অতিথি আপ্যায়নের জন্য তা অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, কোথাও বা তা রোজকার খাবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 


ধরা যাক জাপানি সুশি বা সাশিমির কথা। কলকাতার বহু রেস্তোরাঁতেই এখন সুশি পাওয়া যায়। মূলত কাঁচা মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণী ভিনিগারে ডুবিয়ে ভাত আর সামুদ্রিক আগাছা দিয়ে মুড়ে রোল বানিয়ে খাওয়া হয়। তবে অ-জাপানি জিভে শুধুই কাঁচা মাছ সইবে না বলে অনেক সময়ই ভেজে কিংবা সাঁতলে নেওয়া হয়। আমেরিকায় বহুদিন ধরে জাপানিরা আছে বলে এখানকার জায়গার নামে বেশ কিছু রোল আছে (ক্যালিফোর্নিয়া রোল, ফিলাডেলফিয়া রোল ইত্যাদি), যেখানে কাঁচা মাছের ব্যাবহার হয় না। সুশি খাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ খানিকটা জল মিশলেও সাশিমি কিন্তু কাঁচাই খাওয়া হয়। জাপানিতে ‘সাশিমি’ শব্দের অর্থ ‘কাঁচা মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণী’। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে সার্ভার জিজ্ঞেস করেন কী কী চাই। বলে দিলেই চোখের সামনে পাতলা করে পছন্দের মাছ, অক্টোপাস বা কাঁকড়া কেটে সয়া সসের সঙ্গে সার্ভ করেন শেফ। 


ছবি : সুশি


জাপানের প্রতিবেশী দেশ কোরিয়াও কিন্তু পিছিয়ে নেই। এখানে অবশ্য শুধু সামুদ্রিক প্রাণী নয়, গোরুর মাংসও কাঁচা খায় লোকে। ইউখো তার নাম। মাংসটাকে দেশলাই কাঠির মতো সরু করে কেটে নিয়ে মধু, সয়া সস, গোলমরিচ, রসুন দিয়ে মেখে পাতলা করে কাটা নাসপাতির ওপর সাজিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া কোরিয়ানরা গেজাং বলেও একটা জিনিস খায়– কাঁচা কাঁকড়া। সয়া সস বা লংকাগুঁড়ো দিয়ে তৈরি একটা সসের মধ্যে ডুবিয়ে ডুবিয়ে। 


এবার আসি স্টেক টার্টারের কথায়। নাম শুনে ইউরোপিয়ান মনে হলেও এর আসল উৎস কিন্তু মঙ্গোলিয়ায়– তাতার দস্যুদের থেকে। মঙ্গোলিয়া কিংবা তার আশেপাশের মধ্য এশিয়ার দেশগুলোতে খুব জনপ্রিয় খাবার হল ঘোড়ার মাংস। ভৌগোলিকভাবে বিস্তীর্ণ অঞ্চল পার্বত্য মরুভূমি বলেই বোধহয় সেখানকার মানুষ রান্নার তেমন ব্যবস্থা করতে পারতেন না। সেই কারণে তাঁরা মাংসের কিমা করে কিছু মশলাপাতি মিশিয়ে সেটাকে নরম করে নিতেন। রান্নার ঝামেলা থাকত না, খাওয়াও হয়ে যেত চটপট। উনিশ শতকের শেষ দিকে নিউ ইয়র্ক বন্দরে এইরকম গোরুর মাংসের প্যাটি পাওয়া যেত, ওপরে থাকত ডিমের একটা কাঁচা কুসুম। পেঁয়াজ আর পাউরুটির গুঁড়ো দিয়ে খাওয়া হত। বন্দর এলাকা এবং হাসপাতালের রোগীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই খাবারটির নাম হ্যামবুর্গ স্টেক। হ্যামবার্গারের জনক বলা যেতে পারে এই মাংসের প্যাটিকে। আরও পরে প্যারিসে উর্চেস্টার্শায়ার সস (Worcestershire Sauce) এবং টার্টার সস দিয়ে এইভাবে মাংস পরিবেশন করা হত বলে এর নাম হয়ে যায় ‘স্টেক টার্টার’। বন্দর এলাকার শ্রমিকদের থেকে এই খাবারের জন্ম হলেও বর্তমানে পৃথিবীর সবথেকে অভিজাত রেস্তোরাঁয় পরিবেশন করা হয় ‘স্টেক টার্টার’, পাশাপাশি তার দামও আকাশছোঁয়া। 


চিনের দক্ষিণ-পশ্চিমে ইউনান এবং গুইজু প্রদেশে উৎসেচিত শুয়োরের মাংস খাওয়ার চল রয়েছে। ইউনানে এর নাম শেং রু, গুইজুতে তাকে বলে সুয়ান রু। ম্যান্ডারিনে শেং রু মানে ‘কাঁচা মাংস’ আর সুয়ান রু মানে ‘টক মাংস’। মনে করা হয় মঙ্গোলিয়ানদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই চিনেরা এভাবে মাংস খাওয়া শুরু করে। কিন্তু তারা নিজেদের মতন মশলাপাতি মিশিয়ে খেতে শিখেছে। 


শেষে বলব ইথিওপিয়ার কাঁচা গোরুর মাংস কিৎফোর কথা। অধমের এই জিনিসটি খেয়ে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কাঁচা মাংসের কিমায় শুধুমাত্র মাখন আর লংকাগুঁড়ো মিশিয়ে যে স্বর্গীয় এক স্বাদ সৃষ্টি হতে পারে, এ চেখে না দেখলে বোঝা সম্ভব নয়। ইথিওপিয়ান রুটি ইঞ্জেরা এবং আরও অনেক শাকসবজি বা মাংসের ঝোলের সঙ্গে কিৎফো খাওয়া হয়। কাঁচা মাংসে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর আশঙ্কা থাকে বলে কিৎফো বানিয়েই সঙ্গে সঙ্গে খেয়ে নিতে হয়, ফেলে রাখা যায় না। 

ছবি: কিৎফো

এইসব শুনে মনে হতে পারে এর একটাও তো হিউগ গ্লাসের মতো রক্তমাখা বাইসন চিবিয়ে খাওয়ার গল্প নয়। না, তা তো নয়। লিভাই-স্ট্রস এও বলেছেন, cooked  হল সেইসব খাবার যা কোনও পাত্রে নিয়ে ফোটানো হয়েছে, স্মোক করা হয়েছে বা এমনভাবে রান্না করা হয়েছে যাতে মাংসের টেক্সচারে কোনও পরিবর্তন আসে। আমি যতগুলো কিসসা শোনালাম, তার একটাও কিন্তু ফোটানো বা পোড়ানো হয়নি; শুধু কেটে মশলা মাখিয়ে খেয়ে নেওয়া হয়েছে। খুব বড়জোর ফার্মেন্ট করে পচিয়ে নেওয়া হয়েছে। স্ট্রসের সংজ্ঞা অনুযায়ী এগুলো তাই  raw, rotten– বাংলা ভাষায় কাঁচা। আর মশলাগুলো? ওই বললাম না, ওগুলো সভ্যতার যাত্রাপথের সাংস্কৃতিক টোটেম। 


এতকিছু পড়ে এবার কি জিভে জল আসছে? চেখে একবার দেখবেন নাকি? নাকি দেখে শুধু নাকই সিঁটকোবেন?  




[ নিবন্ধে ব্যবহৃত ছবি : লেখক ]
[কভার পোস্টার : অর্পণ দাস ]
#বাংলা #নিবন্ধ #রসিয়ে কষিয়ে #Levis Straus #The raw and cooked #Sushi #Steak #Kitfo #Worcestershire Sauce #মাংস #কাঁচা #জাপান #চিন #ইন্ডিয়া #ইথিওপিয়া #কোরিয়া #খাদ্যাভ্যাস #raw meat #meat #japanese #hamburg #ethiopia #korea #Hamburger #food habit #the revenant #China

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

86

Unique Visitors

181879