উইলিয়াম ‘এশিয়াটিক’ জোন্স
খোদ কলকাতার বুকে অবস্থিত বহু গবেষণার 'রত্নের খনি' যে এশিয়াটিক সোসাইটি, তার শুরুটা কিন্তু সুদূর লন্ডনের এক বাসিন্দার হাত ধরে। ১৭৪৬ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর তাঁর জন্ম। উইলিয়াম জোন্স। ১৭৫৩ সালে লন্ডনে হ্যারোর প্রসিদ্ধ বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা শুরু। ছোটবেলা থেকেই বহু ভাষার প্রতি একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল তাঁর। ছিল প্রাচ্য ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি আত্মিক টান। ইংরেজি, ফার্সি, হিব্রু, গ্রীক, ল্যাটিন, স্প্যানিশ সবই যেন তাঁর নিজের ভাষা। সব ভাষাতেই তিনি সাবলীল। ফার্সি ভাষায় অনূদিত নাদির শাহের জীবনী দেখে ষোড়শ লুই বলেছিলেন, “He is a most extraordinary man.He understands language of my people more than myself…”। এই অসাধারণ মেধা লক্ষ্য করে একবার এক শিক্ষক তাঁকে বলেছিলেন, "এই বালকটিকে সলিসবেরির জনশূন্য প্রান্তরে নিরাশ্রয় ও নগ্ন অবস্থায় ফেলিয়া আসা হইলেও সে জীবনে উন্নতির পথ খুঁজিয়া লইবে।" শিক্ষক মাত্রই দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর সেই ধারণা ফলেও গিয়েছিল।
প্রাচ্য সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ জোন্সকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছেল বহুদিনই। তাই ভারতে একটি পদ লাভের ইচ্ছা মনে মনে পোষণ করতে থাকেন তিনি। একদিন সে অপেক্ষারও অবসান ঘটে। ১৭৮৩ সালের মার্চ মাসে কলকাতার সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি হিসেবে জোন্সের নাম ঘোষণা করা হয়, একই সঙ্গে তিনি নাইট উপাধিতেও ভূষিত হন। এতদিনে মিলল প্রাচ্য সংস্কৃতিকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ। কোনো সময় নষ্ট না করে ১৭৮৩ সালেরই সেপ্টেম্বর মাসে 'ক্রকোডাইল' জাহাজে সস্ত্রীক জোন্স পাড়ি দিলেন ভারতের উদ্দেশ্যে। বিচারপতি হিসেবে যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দেবার পর নিজের মনের আসল খিদে মেটানোর কাজে তিনি নজর দেন। প্রাচ্য সংস্কৃতিকে খোঁজার তাগিদে শুরু করেন সংস্কৃত ভাষা শেখা। দু' বছরের পরিশ্রমের ফলে আয়ত্ত করেন এই ভাষা। আগেই বলেছি, সকল ভাষা শিক্ষার প্রতি ছিল তাঁর এক আত্মিক টান। অল্প সময়ের মধ্যেই সব মিলিয়ে প্রায় ২৭টি ভাষা শিখে ফেলেন এই আশ্চর্য মেধাবী মানুষটি।
জোন্স বুঝেছিলেন যে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার প্রকৃষ্ট স্থান এই কলকাতা, এবং তা কখনো একক ভাবে সম্ভব নয়। তাই ১৭৮৪ সালের ১৫ই জানুয়ারি, অর্থাৎ জোন্সের কলকাতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর নেতৃত্বে এমন একটি প্রতিষ্ঠান তৈরির উদ্যোগ শুরু হয়। তাঁর আমন্ত্রণে ৩০ জন কলকাতা-প্রবাসী ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবী ও বিদ্যোৎসাহী মিলে প্রতিষ্ঠা করেন 'এশিয়াটিক সোসাইটি'। সোসাইটি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য বর্ণনা করতে গিয়ে জোন্স বলেছিলেন, এশিয়ার ভৌগোলিক পরিধির মধ্যে মনুষ্যকৃত ও প্রকৃতি-সৃষ্ট সমস্ত কিছুই এই সোসাইটির আলোচনার বিষয়বস্তু হবে। এই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে প্রথমে হেস্টিংসকে নির্বাচন করা হলেও তাঁর সময়ের অভাবে তাঁরই অনুরোধে জোন্স-ই এর প্রথম সভাপতি হন।
শুধু সভাপতির দায়িত্ব পালনই নয়, ১৭৮৯ সালে মহাকবি কালিদাস রচিত 'অভিজ্ঞানশকুন্তলম' নাটকটির ইংরেজি অনুবাদ 'Sacontala or the Fatal Ring' প্রকাশ করেন তিনি। এটিই প্রথম সংস্কৃত নাটক যা ইউরোপীয় ভাষায় অনূদিত হয়। জোন্সের হাত ধরেই কালিদাসের রচনা প্রথম বহির্বিশ্বে পদার্পণ করে। এছাড়াও জয়দেবের গীতগোবিন্দ কাব্যটিও জোন্সই সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। শুধুমাত্র ভারতীয় কাব্য নয়, ভারতীয় দেব-দেবীদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত বেশ কিছু সংস্কৃত স্তোত্রও তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। এশিয়াটিক সোসাইটি প্রবর্তিত 'Transaction of Journal' ভারতবর্ষে প্রথম বিজ্ঞান-আলোচনার সূত্রপাত করেছিল। এছাড়াও বহুদিন ধরেই প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করছে জোন্সের এই প্রতিষ্ঠান।
কেবলমাত্র এশিয়াটিক সোসাইটি প্রতিষ্ঠাই নয়, ভারতের উদ্ভিদবিদ্যা-চর্চার ক্ষেত্রেও জোন্সের অবদান কিছু কম নয়। তাই আমাদের দেশের অতি প্রাচীন ঐতিহ্যশালী বৃক্ষ অশোক গাছের নাম দেওয়া হয়েছে তাঁকে স্মরণ করেই - 'জোনেসিয়া অশোক'। এছাড়া ভারতের অতীত ইতিহাস, প্রাণিবিজ্ঞান, এমনকি হিন্দু সঙ্গীত বিষয়েও আছে তাঁর বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ।
গতকাল ছিল উইলিয়াম জোন্সের জন্মদিন। যাঁর বিচরণ ক্ষেত্র প্রাচ্যবিদ্যার বিপুল আঙিনার প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রফল জুড়ে, তাকে কি কোনোদিন ঢেকে রাখা যায় কোনো কফিন বন্দী সমাধিতে? আজ যেখানে আমরা আমাদের নিজের সংস্কৃতিকে প্রায় ভুলতে বসেছি, নিজের ভাষা বলতে না পারার মধ্যে প্রচ্ছন্ন অহংকার বোধ করি, তখন বোধহয় পার্ক স্ট্রিটের সমাধিক্ষেত্রে শুয়ে থাকা জোন্স বেদনার হাসি হাসেন।