খেলা হবে, টুম্পা বেলা!
সদ্য ভাষা দিবস গেছে। আর দিগ্বিদিক শিহরিত করে বাংলায় আসছে বিধানসভা নির্বাচন। প্রচারের ভাষা নিয়ে কথা বলার এই তো সময়। ভারতের রাজনীতির নানা দিক নিয়ে যে চর্চা চলে, তাতে একটা রাজনৈতিক প্যারাডাইম শিফট মনে হয় সবার নজর এড়িয়ে যাচ্ছে। এলিট বুড়োদের জায়গায় সামনে আসছেন ওদিকে শতরূপ,এদিকে দেবাংশু-সুদীপ আর অন্যদিকে তরুণজ্যোতিরা। আর রেজিমেন্টের বাইরেও থাকছে আরেক গুরুত্বপূর্ণ বলয়। যাঁরা গদির লড়াইয়ে না থেকেও হোক কলরব করেন। আবার যে কানহাইয়া আজাদির বাঁশি বাজিয়েছিলেন JNU প্রাঙ্গণে, তিনিও তো নবীন যৌবনের দূত। এই প্রজন্ম যখন প্রচারে নামছেন তখন তো বদলে যাবেই রাজনৈতিক জনসংযোগের ভাষা! স্লোগানের সুর।
অবশ্য বাঙালির স্লোগানের ইতিহাসে রসিকতার ঐতিহ্য খুব নতুন নয়। সে অনেক কাল আগেই শুনে নিয়েছে, "দিল্লি থেকে এল গাই, সঙ্গে নিয়ে সিপিআই"। তবে এই লেখার আলোচ্য স্লোগানের অতীত নয়। বহমান বর্তমান। যেখানে তারুণ্যের দীপ্তি নির্মাণ করছে এক স্বতন্ত্র রাজনৈতিক আখ্যান।
ভিসি তুমি দুষ্টু লোক/ তোমার মাথায় উকুন হোক– প্রতিবাদের এমন ভাষ্য দেখেছে বাংলা। একেবারেই সাধারণ কিন্তু রাজনীতিসচেতন ছাত্রদের মুখ থেকে উঠে এসেছিল এমনই কিছু অভিনব স্লোগান এক অভিনব আন্দোলনে, যার নাম "হোক কলরব"।
প্রতিবাদের এই ভাষিক নতুনত্ব কিন্তু ঢুকে পড়েছে রেজিমেন্টেড রাজনৈতিক দলের প্রচারেও। কোথাও ছড়া কোথাও গান কোথাও আবার র্যাপ। এরা শিল্প হিসেবে কতটা উৎকৃষ্ট তা নিয়ে তর্ক অর্থহীন। কারণ শিল্প এদের উদ্দেশ্যই নয়। এরা অনেকটাই অ্যাজিট প্রপ গোত্রের। এদের উদ্দেশ্য প্রচার। জনসংযোগ। সেখানে কিন্তু এরা দল নির্বিশেষে বেশ সফল।
দেবাংশু রাজনৈতিক বিরোধিতাকে তুলে এনেছেন ছড়ায়। বিরোধিতাকে গেঁথে দিয়েছেন ছন্দে। তাঁর "খেলা হবে" এখন ডিজের দৌলতে তৃণমূলী প্রচারের হিট আইটেম। "তৃণমূলের ভাঙিয়ে নেতা নয়তো সহজ ভোটে জেতা/ দিদির ছবি সরবে যবে বন্ধু সেদিন খেলা হবে"। বস্তির রাজনীতি না জানা ভুখা পেটের খালি গা ছেঁড়া প্যান্টের ছেলেটাও নেচে চলেছে কান ফাটানো ‘খেলা হবে’-র বিটে। দলীয় রাজনীতি সে বোঝে না। বোঝে না আরও অনেক কিছুই। গানটির শব্দ বদলে একেবারে অর্থহীন কিছু বসিয়ে দিলেও সে নাচত। কারণ তার আনন্দ কালোয়াতি সূক্ষ্মতায় কোনও দিনই ছিল না। যে সাবঅলটার্ন ক্যাওড়ামো দেখে নাক সিঁটকোয় একদল , সেই ক্যাওড়ামো দীর্ঘদিন উদযাপিত হয়েছে ভাসানের ডিজে-তে , জিত গাঙ্গুলির গানে। এইবার সে তৈরি করে নিচ্ছে এক রাজনৈতিক ভাষ্য। আমরা তাকে পড়ছি না। অথবা পড়তে পারছি না। সত্যিই শিল্পদায় নেই এই প্রচারের। উৎপল দত্ত যুগন্ধর। সে চ্যাপ্টার বন্ধ বলে মেনে নেওয়াই ভালো। ‘তীর’ অথবা ‘টিনের তলোয়ার’ যিনি লেখেন, তিনি ক্ষণজন্মাই। বাঙালি বহু ভাগ্যে তাঁকে পেয়েছিল। কিন্তু বাংলা বদলেছে। বদলেছে বিনোদনের ভাষা ও ভাষ্য। এবং হয়তো বা, রাজনীতিও হয়ে উঠছে বিনোদন। এ ভালো না খারাপ তা নিয়ে তর্ক অর্থহীন। তর্কাতীত হল, 'খেলা হবে'-র তথাকথিত জনপ্রিয়তা। গুড় বাতাসা, নকুলদানা, চড়াম চড়াম-খ্যাত অনুব্রত মণ্ডলের মুখেও বারবার উঠে আসছে "খেলা হবে"। বস্তুত 'খেলা হবে'র চূড়ান্ত জনপ্রিয়তার ক্রেডিট অনেকে তৃণমূলের প্রিয় কেষ্টদাকেই দিতে চান। তবে এই জনপ্রিয়তার স্রোতে খড়কুটোর মতো এমন বিরোধী বাণীও মুহুর্মুহু ভেসে আসছে যে "খেলা হবে" স্লোগান বস্তুত সরাসরি হুমকি। দেবাংশু অবশ্য এই গান-স্লোগান লেখার পেছনে রবীন্দ্রনাথের একটি গানের উল্লেখ বারবার করেন। "মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ জানিস নে কি ভাই।/ তাই কাজকে কভু আমরা না ডরাই॥" লক্ষণীয়, জনতোষ সংস্কৃতির বোড়ে ব্যবহার করার সময়ও তথাকথিত হাই কালচারের গজের কথা ভুলে যাচ্ছেন না এখনকার তরুণ রাজনৈতিক।
পাশাপাশি আমাদের অবশ্যই মনে পড়বে টুম্পার ব্রিগেড যাত্রা। শ্রেণিসচেতন দলীয় প্রচার হিসেবে, প্রেম বিপ্লব মিশিয়ে, বিষয়টি গণসংগীত না হলেও গণতোষসংগীত হবে সে কথা আন্দাজ করাই যাচ্ছিল। বিশেষত এই গানের কনোটেশন রয়েছে সমসাময়িক হিট গান টুম্পার সঙ্গে। ভোজপুরী গানের এই অদম্য নৃত্যদোদুল সুর না থাকলে টুম্পার ব্রিগেডযাত্রা এমন উচ্ছ্বসিত উন্মাদনায় ভরা থাকত কি না সন্দেহ। তবে সন্দেহাতীত এই যে, আমাদের রাজনৈতিক প্রচার এক রিভার্স অ্যাকালচারেশন ঘটিয়ে চলছে মুহুর্মুহু। কলেজের অধ্যাপক বাবুটিও টুম্পার তালে আঙুল নাচাচ্ছেন। মোটা চশমা হয়তো বলছে অপসংস্কৃতি। কিন্তু শুনছে। হয়তো কোনও এলিট ধুতি বলছে, খোঁজ নিন, আলিমুদ্দিন এর পিতৃত্ব স্বীকার করে না। তবু, টুম্পা বাবার পরিচয়পত্রকে কাঁচকলা দেখিয়ে প্রেমিকের চাকরির স্বপ্ন দেখছে গানে। আবার এই গান জন্ম দিয়েছে অনেক বিতর্কেরও। মূল টুম্পা গানটির গীতিকার প্রযোজক প্রশ্ন তুলেছেন কপিরাইটের। অনেকে সিপিএমী টুম্পা-লিরিক্সে খুঁজে পেয়েছেন পুরুষতান্ত্রিক অবদমনের চিরচেনা ছক। এই ছোটো লেখাটি সেই আলোচনার ক্ষেত্র নয়। তবে প্যারোডি যে খুব উল্লেখযোগ্য ভাবে রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার হয়ে উঠছে, আন্তর্জালিক-নাগরিক যে সেই প্রচার উপভোগ করছেন তারিয়ে তারিয়ে, সেটুকুই আমাদের বক্তব্য।
তবে আটাশের ব্রিগেড নিয়ে কেবল প্যারোডি নয়, অরিজিনাল গানও বাঁধা হয়েছে, ছবিও আঁকা হয়েছে। সে গান লিখেছেন জয়রাজ ভট্টাচার্য। গেয়েছেন অর্ক মুখার্জি। তবে অন্তত ইউটিউবের হিসেবে জনপ্রিয়তায় সে টুম্পার কাছে বিশেষ পাত্তা পায়নি। শতরূপ ঘোষের নিজের ইউটিউব অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট হওয়া গানটির লাইক এখন তিন হাজারের কাছাকাছি। ভিডিওটি দেখেছেন চব্বিশ হাজার মানুষ। এবিপি আনন্দের অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট হওয়া টুম্পার লাইক কুড়ি হাজার। দেখেছেন পাঁচ লক্ষ মানুষ । আর ছবিটি এঁকেছেন হিরণ মিত্র।
আসলে প্রচারের বক্তব্য তো সমস্ত রাজনৈতিক দল নিজের মতো রাখবেই। চিরটাকাল রেখে এসেছে। কিন্তু কেমনভাবে সেই বক্তব্য রাখা হচ্ছে সেইটা এখন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পপুলার কালচারের চর্চা তো শুরু হয়েছে বহুদিন। পপুলিস্ট রাজনীতির চর্চা ও প্রয়োগ পশ্চিমবঙ্গ নিজে চোখে দেখেছে এবং দেখছে। এইবার শুরু হয়েছে এক নতুন প্রতর্ক। পপুলার কালচারাল পলিটিক্স। যার ঋত্বিক ছাত্র যুব। তা যে দলেরই হোক।
আবার এই পপুলার কালচারাল পলিটিক্সের চর্চায় কিন্তু অনেক ডিসকোর্স বদলে যাচ্ছে। বেলা চাও গানটির অস্তিত্ব বাঙালি নেটফ্লিক্স না থাকলে জানত কি না সন্দেহ। মানি হেইস্ট তাকে বাজারজাত এবং বাজারসফল করেছে। এবং ক্ষীণ হয়ে গেছে তার বৈপ্লবিক উৎসমূল। প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে ইতালির কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে বেলা চাও-এর সংযোগ। নাৎসি আগ্রাসনের দিনগুলোয় এই প্রতিবাদী গান হয়ে উঠেছিল কার্যত একটি অ্যান্টি-ফ্যাসিস্ট অ্যান্থেম। আর এখন সেই গানটির জনপ্রিয়তাকে এক দক্ষিণপন্থী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে গিয়ে, আর-এক উগ্রদক্ষিণপন্থী দল, অবলীলায় লিখে ফেলেছে, "পিসি যাও, পিসি যাও, পিসি যাও যাও যাও..."
এই পপুলার কালচারাল পলিটিক্সের নিয়তি। বেলা চাওয়ের জন্য কষ্ট হয়।