কোন মন্ত্রে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড ?
সুখ জিনিসটার পিছনে ছোটে না এমন মানুষ পৃথিবীতে খুব কমই দেখা যায়। আসলে ঠিক কোন কোন শর্ত পূরণ হলে সেই আকাঙ্খিত সুখকে ছোঁয়া যাবে, তার কোনও নির্দিষ্ট উত্তর এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার হয়তো বা এই উত্তর খুঁজে চলার জন্যই আর পৌঁছনো হয়ে ওঠে না 'সুখ' শব্দটায়। এমনই এক মরীচিকার পিছনে যখন ছুটছে গোটা পৃথিবী, তখন ২০১৯ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট নেটওয়ার্ক বিভাগ ঘোষণা করল বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের নাম - ফিনল্যান্ড। শুধু ২০১৯ না, ২০১৮-তেও এই খেতাব ছিল এই দেশের ঝুলিতেই।
এই খবরের পর স্বভাবতই আমাদের মত চিরসুখ সন্ধানী মানুষেরা খুঁজে দেখতে চায় কি এমন উপকরণ আছে সেখানে, যেখানে গোটা একটা জনজাতি পেয়ে যায় সবচেয়ে সুখী দেশের তকমা !
সন্ধান চালাতে গিয়ে ফিনল্যান্ড দেশের যে জিনিসগুলি প্রথমেই আমাদের সামনে আসে, তা কিন্তু একটু চমকেই দেয়। এদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশ, নানা বিষয়ের পরিসংখ্যান কিন্তু ঠিক এর উল্টো কথাই বলে। প্রাকৃতিক পরিবেশগত দিক দিয়ে এ দেশ মোটেও চির বসন্তের দেশ নয়। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রায় ২০০ দিনই ফিনল্যান্ডের উত্তরে থাকে তীব্র শীত। আর এই শৈত্যপ্রবাহের তীব্রতা কখনো কখনো পৌঁছে যায় মাইনাস ৫০ ডিগ্রি র কাছাকাছি। এমন আবহাওয়া দেশের মানুষের কাছে কাজের উপযুক্ত নয় কোনওভাবেই, বলাই বাহুল্য। এছাড়াও বছরের অধিকাংশ সময়ে সূর্যালোক পৌঁছয় না এই দেশটিতে। অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে থাকে। এমন চরম প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যে থেকে কেমন করে সুখের সন্ধান পায় এই দেশের মানুষগুলো? কেবল প্রাকৃতিক প্রতিকূলতাই নয়, ১৯৯০ সালে একটি সমীক্ষা করে দেখা গেছে এই পরিবেশগত কারণের প্রভাবে এই দেশের মানুষের মধ্যে বাড়ছে বিষণ্ণতা এবং সেই সঙ্গে বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। পরিসংখ্যান বলছে ফিনল্যান্ড ছিল বিশ্বের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আত্মহত্যাপ্রবণ দেশ।
বর্তমানে এর হার প্রায় অনেকটা কম হলেও এখনো তা সম্পূর্ণ মুক্ত নয়। এর সঙ্গে কমছে এদেশের জন্মহারও। গড়ে একজন নারী জন্ম দেয় প্রায় ১.৬ টি শিশুর। অতএব, ফিনল্যান্ড সম্বন্ধে জাতিসংঘের এই বিধান আমাদের ধোঁয়াশার মধ্যেই রাখে। তবে কোন পথে আসে সুখ?
চরম প্রাকৃতিক বৈষম্য, অসুবিধা, মানুষের মনের উপর তার প্রভাব এর সবই এক লহমায় জয় করে নিতে শিখেছে ফিনিশীয়রা। শুধুমাত্র তাদের জীবনযাত্রাযই এনে দিয়েছে তাদের যাত্রাপথে সুখকে। কেমন তাদের এই যাপন-পদ্ধতি যা একাধিক অসম্ভবপ্রায় প্রতিকূলতাকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারে?
জাতিসংঘ জীবনযাত্রার ছয়টি বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কোনও দেশের সুখের মাত্রা নির্ণয় করে। এই ছয়টি বিষয় হলো- উপার্জন, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, সুস্থভাবে গড় আয়ুষ্কাল, সামাজিক সমর্থন এবং উদারতা ও মহানুভবতা। আর এই বিষয়গুলোই হলো ফিনল্যান্ড দেশের সুখের চাবিকাঠি। একটু খতিয়ে দেখলেই দেখা যাবে যে শিক্ষাব্যবস্থার দিক থেকে ফিনল্যান্ড অন্যান্য দেশের থেকে পৃথক ভাবনা পোষণ করে। অন্য সকল দেশের মত এই দেশের শিশুদের পিঠে ৬ বছর বয়সেই চাপিয়ে দেওয়া হয় না ভারী ব্যাগ। ফিনল্যান্ডের শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ৭ বছরে এবং ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত তারা এই প্রাথমিক শিক্ষার আওতার মধ্যে পড়ে। এই দেশের শিক্ষার্থীরা হাই স্কুলে যায় ১৬ থেকে ১৯ বছর বয়সে। এবং এদের শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে আধুনিক মনোবিজ্ঞানের স্পর্শ। ১৬ বছরের আগে এখানে শিক্ষার্থীদের কোনওরকম পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় না। শিক্ষকরাই ঠিক করে দেন তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠ্যক্রমে কী কী বিষয় থাকবে। কোনও হোমওয়ার্ক বা বাড়ির কাজ দেওয়া হয় না ছাত্র-ছাত্রীদের। উপরন্তু তাদের অনুপ্রাণিত করা হয় তাদের নিজ নিজ ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করার দিকে। ফলে শিক্ষাস্থান বা শিক্ষাগ্রহণ তাদের কাছে হয়ে ওঠে না কোন ভয়াবহ বিষয়। একমাত্র ফিনল্যান্ডেই ৮৮ শতাংশ ওই মাধ্যমে পরবর্তী পর্যায়ে শিক্ষাগ্রহণ করে। ৬৯ শতাংশ করে চাকরি।
সুখের মাত্রা নির্ণয়ে এর অন্যতম বিষয় 'সামাজিকতা'-তেও এই দেশ এক অন্যরকম গল্প বলে। বর্তমানে যেখানে সর্বত্র নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি কনসেপ্টে বিশ্বাসী মানুষ, তিন কামরার ফ্লাটের দরজার বাইরে পুরোটাই বহির্জগৎ তখন এক সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে ফিনল্যান্ডের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষই নিশ্চিত ভেবে জানেন যে তাদের পরিবারের বাইরেও অসময়ে সাহায্য করার জন্য পাবেন বন্ধুর হাত। 'আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি'-ই এই দেশের একমাত্র কনসেপ্ট। আরো একটি বিশেষ বিষয় লক্ষ্য করা যায় এই দেশের সম্পর্কে, তাহল এদেশের মানুষের বিনয়। সমাজে নিজেদের সামাজিক ও আর্থিক উচ্চ অবস্থান, সাফল্য, চাকরির মান ইত্যাদি কোন কিছু নিয়েই কোনও মাতামাতি করতে দেখা যায় না এদের কখনোই। জীবনটাকে ‘শো অফ’ করা থেকে অনেক দূরে দূরে থাকে তারা। আরেকটি বড় কারণ হল তৃপ্তি বা সন্তুষ্টি। দেখা যাচ্ছে, তারা তাদের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট এবং তারা উপভোগ করতে জানে এই জীবন ও পৃথিবীকে।
আসলে ‘সুখ-সন্ধানী’ আর ‘সুখ’ শব্দটা বোধহয় একে অপরের বিপরীত। ঠিক যেখানে সন্ধানের ঘোড়দৌড় শেষ হয়, সেখানেই বোধহয় আসে তৃপ্তি। সেখানেই বোধহয় শুরু হয় সুখের যাত্রা। ফিনল্যান্ডের জনমানস তারই উদাহরণ।
#ফিনল্যান্ড #Finland #The Happiest Country #Standard of Living #Happiness #Happiness Quotient #সবর্ণা চট্টোপাধ্যায় #সিলি পয়েন্ট