পশ্চিম ও কৃষ্ণা
একটু ব্যক্তিগত কথা দিয়ে শুরু করি। বাংলা কথাভুবনে যে নারী সত্যান্বেষীর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয় তাঁর নাম বিন্দী পিসি। ১৯৮১ সালের কথা। ১৯৬০ –এ প্রকাশিত দেব সাহিত্যকুটীরের পূজাবার্ষিকী ‘অপরূপা’ পুনর্মুদ্রিত হল, আর সেখানেই পড়লাম সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের গোয়েন্দা গল্প –‘বিন্দী পিসির গোয়েন্দাগিরি।’ দিন কেটে গেল। বড়ো হলাম। আলাপ হল আগাথা ক্রিস্টির সঙ্গে। তারপরই শকট্ হলাম।
‘দ্য স্টোরিটেলার’ পত্রিকায়, ১৯৩০-এর ফেব্রুয়ারিতে, ক্রিস্টি একটা গল্প লেখেন। নাম ‘দ্য রেসারেকশন অফ এমি ডুরান্ট’। পরে এর নাম হয়, ‘দ্য কমপ্যানিয়ন’। এটা ইংরেজ নারী সত্যান্বেষী মিস জেন মার্পল-এর প্রথম দিকের রহস্যভেদ কাহিনিগুলির একটা। দেখলাম, ১৯৬০-এ লেখা ‘বিন্দী পিসির গোয়েন্দাগিরি’ তার তিরিশ বছর আগে লেখা ‘দ্য রেসারেকশন অফ এমি ডুরান্ট’-এর প্রায় হুবহু অনুকরণ। তার মানে, বাংলা সত্যসন্ধানের আখ্যানবিশ্বে, বিন্দী পিসি যে মৌলিক নারী সত্যান্বেষী চরিত্র নন, সেটা স্পষ্ট হল। এও বোঝা গেল, পশ্চিমি দুনিয়ার রহস্যকাহিনির স্বর্ণযুগের নারীসৃষ্ট নারী রহস্যভেদীর প্রভাব বাংলা ডিটেকটিভ গল্পের ওপর কতটা বেশি।
তারপরই, মনে প্রশ্ন জাগল, এই প্রভাব কি বাংলা নারী সত্যান্বেষী চরিত্র সৃষ্টির আদিযুগ থেকেই আছে? যদি থাকে তাহলে কতটা? তা ছাড়া, পশ্চিমি ভুবনের ডিটেকটিভ কাহিনির রচয়িত্রীদের সঙ্গে কী জাতীয় সংলাপ রচিত হয়েছিল বাংলা ক্রাইম ফিকশনের জগতে প্রথম নারী রহস্যভেদীর আবির্ভাবের সময়? এই প্রশ্নের কারণ, বাংলা সাহিত্যে প্রথম নারী সত্যান্বেষী এক নারীরই লেখনীসৃষ্ট। তার কথায় আসার আগে, একবার পশ্চিম দিকে তাকাই। দেখে নিই, রহস্যানুসন্ধান কাহিনির প্রথম যুগে লেখিকারা কী জাতীয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক নির্ধারক দ্বারা চালিত হয়েছিলেন।
ইংরিজি রহস্যকাহিনির দুনিয়ায়, মেয়েদের লেখক হিসেবে বা চরিত্র হিসেবে আবির্ভাবের ইতিহাস এবং সাগরপারের কথাভুবনে নারীদের উপস্থাপিত হওয়ার ন্যারেটিভ হাত ধরাধরি করে চলে। বস্তুত, ইংরিজি উপন্যাসের শুরু থেকেই আখ্যানজগতে নারীদের আধিপত্য দেখা যায়। সেই আফ্রা বেনে থেকে শুরু করে গ্যাসকেল-অস্টিন-ব্রন্টি-ইভানস্ (জর্জ ইলিয়ট) –এরকম বহু নাম করা যায়। আধুনিক নারীবাদী সমালোচনা মনে করে, উপন্যাসের ভাষাপৃথ্বীতে ছদ্মবেশে, ছদ্মনামে লুকিয়ে, চরিত্রদের মধ্যে নিজেকে বিস্তৃত করে লেখিকারা এক জাতীয় মুক্তির স্বাদ পেতেন, সামাজিক অবদমনের মধ্যে বাস করেও।
অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকে উপন্যাস লেখায় অনেক বেশি নারীকে যোগদান করতে দেখা যায়। কাব্যজগৎ পুরুষশাসিত ছিল। বিচিত্র ব্যাপার হল, বিশ শতকের স্বর্ণযুগের আগে, রহস্যকাহিনিস্রষ্টা রূপে পাঁচজনের বেশি নারীর দেখা পাওয়া যায় না। এদিকে আবার, গথিক কাহিনি রচনায় তাঁরা পুরুষ লেখকদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। অ্যান র্যাডক্লিফ, শার্লট ডাইকার, লুইজা মে অ্যালকট, ইসাবেলা কেলি, এলিজাবেথ স্লেথ– এরকম প্রচুর নাম করা যায়। এত লেখিকার গথিক ফিকশন লেখার প্রধানতম কারণ, গথিকের পটভূমি আর আখ্যানকৌশল অতিলৌকিক জগৎকে কায়া দেয়, এবং সে সময়ের রক্ষণশীল সমাজ মেয়েদের চারিত্র্য বলতে যা বুঝত– নারীপ্রকৃতি সম্বন্ধে তার যা ধারণা ছিল- তাদের মধ্যে কোনও আড়াআড়ি ছিল না। বাস্তব দুনিয়ায় মেয়েদের কর্তব্য বিষয়ে সমাজমান্য সিদ্ধান্ত আর এক আপাত অলীক পৃথিবীর স্রষ্টা হিসেবে তাদের ভূমিকা এক হয়ে যেত জনমানসে। কিন্তু, তাতেও অবাক ভাবটা যায় না। রহস্যকাহিনিও তো একরকমের এসকেপিস্ট ফিকশনই? তাহলে যে মহিলারা গথিক লিখছেন, তাঁরা ডিটেকটিভ গল্প-উপন্যাস লিখবেন না কেন? পণ্ডিতরা তো বলেন, গথিক কথাকার হিসেবে পো-এর অভিজ্ঞতাই ইনস্পেক্টর দ্যুপঁ-র বিশ্ব গড়তে সহায়ক হয়েছিল।
যাই হোক, ব্রিটেনে বা আমেরিকায় নারী রচিত প্রথম রহস্য উপন্যাস হল ১৮৬২ সালে প্রকাশিত, মেরি এলিজাবেথ ব্র্যাড্ন্-এর লেখা ‘লেডি অডলিস্ সিক্রেট’। একে সেনশেসন ফিকশন বলে অভিহিত করা হয় সে সময়। তার কারণ, ব্র্যাড্ন্ ১৮৬০ সালের বহু চর্চিত কনস্টান্স কেট মামলার মূল ঘটনাগুলো অলজ্জভাবে তাঁর বইতে বসিয়ে দিয়েছিলেন। ডেভন-এর রোড গ্রামের বাসিন্দা, ষোলো বছরের কনস্টান্স কেট, কেমনভাবে তার চার বছরের সৎ ভাই, ফ্রান্সিসকে, ছুরি দিয়ে মেরে, বাচ্চাটার দেহ বাড়ির বাইরের প্রিভিতে লুকিয়ে রেখেছিল; কেমন করে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডিটেকটিভ ইনস্পেক্টর জ্যাক উইচার তাকে গ্রেফতার করলেও, জনমত এক খেটে খাওয়া শ্রেণির প্রতিনিধি গোয়েন্দার, বড়ো ঘরের মেয়ের বিরূদ্ধে করা অভিযোগকে উড়িয়ে দেয় এবং কেটের কোনও বিচারই হয় না; কেমনভাবে কেন কেট ফ্রান্সিসকে মেরেছিল, তার কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি– এসব নিয়ে খবরের কাগজে দীর্ঘদিন চাপানউতোর চলে। এসবই ছিল ব্র্যাড্ন্-এর সোর্স।
যাই হোক, লেডি অডলি কেটের মতো খুন- টুন করেননি। বইয়ের শেষ দিকে সব কিছু ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে আগুন লাগানোর চেষ্টাতেও সফল হননি। কিন্তু, তাঁর অপরাধ ভিক্টোরিয়ান নীতিবোধের কাছে খুনের চেয়ে কম কিছু ছিল না : নিজের রূপ-যৌবনকে সম্বল করে, ছোটো ঘরের মেয়ে লুসি, সার মাইকেল অডলিকে বিয়ে করেন, লেডি অডলি বনে যান। লুসির ধোঁকাবাজি ধরে ফেলেন, এই বইয়ের গোয়েন্দা সার মাইকেলের ভাইপো, ব্যারিস্টার রবার্ট অডলি।লুসির গতি হয় পাগলা গারদে। শ্রেণি আর সামাজিক মর্যাদার সীমাকে অস্বীকার করে, যৌবনের মায়াবলে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার মতো জঘন্য অপরাধের এর চেয়ে উপযুক্ত শাস্তি আর কী-ই বা হতে পারত?
ঊনবিংশ আর বিংশ শতকে কোনও নারী রহস্য উপন্যাস লিখতে বসলে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতেন। প্রথমত, সত্যান্বেষীকে পুরুষ হতেই হবে। দ্বিতীয়ত, নারী চরিত্রগুলিকে কিছু স্টিরিওটাইপের বাইরে গেলে চলবে না। যেমন, লুসি-লেডি অডলি- যদি ব্যবসা করে, অভিনয় করে বা সৎভাবে পরিশ্রম করে বড়লোক হতে চান, তাহলে তাঁর কথা কেউ পয়সা খরচ করে কিনে পড়বে না। কারণ ওসব কাজ পুরুষের একচেটিয়া। তাই লুসিকে সুন্দরী, ছলনাময়ী হতে হবে, প্রেমের ফাঁদে পুরুষ ধরতে হবে। কেন-না, ওটাই ঠিকঠাক মেয়েলি পদ্ধতি।
অনেকটা গব্বর সিং-এর, যো ডর গয়া,উও মর গয়া-স্টাইলে, ‘দ্য ডিস্যাপিয়ারেন্স অফ লেডি ফ্রান্সিস ফেয়ারফ্যাক্স’ গল্পে এক ম্যাক্সিম আওড়ান সত্যাসন্ধানীদের ঈশ্বর শার্লক হোমস্ :
“যে সব মেয়ের বন্ধু নেই, কোনও শেকড় নেই, তাদের চেয়ে বেশি বিপজ্জনক শ্রেণি পৃথিবীতে কমই আছে। এমনিতে এরা নিরীহ, কাজে কর্মেও লাগে, কিন্তু অন্যের মধ্যের অপরাধীকে জাগিয়ে তুলতে এদের জুড়ি নেই। ওরা অসহায়…শেয়ালের পালের মধ্যে গিয়ে পড়া মুরগিছানার মতো। তবে, [শেয়ালগুলো] ওদের গপ করে গিলে ফেললেও, ওদের মিস করার কেউ থাকে না।” (অনু. চয়ন সমাদ্দার)
যতই মুরুব্বিয়ানার ভঙ্গিতে কথা বলুন ডিটেকটিভের ভগবান, তাঁর বর্ণনায় একটা অস্বস্তি, অপ্রীতি, আর আশঙ্কার সুর স্পষ্ট। মেয়েরা তুলতুলে, অবলা; কিন্তু, অন্যকে দিয়ে অপরাধ করিয়ে নিতে পারে তারা- ইয়াগোর মতো।
এই পুরুষতান্ত্রিক ডিসকোর্স সমাজমনের অধিকার নিয়ে রাখে বলেই, লুসিকে সার মাইকেলকে প্রলুব্ধ করতে হয় আর রবার্টের হাতে ধরা পড়তে হয়।
ইংরিজি-বলা দুনিয়ায় প্রথম নারী সত্যান্বেষীকে জন্ম দেন এক পুরুষ। বলতে কী, ‘লেডি অডলিস্ সিক্রেট’ প্রকাশিত হওয়ার দু-বছর আগে, ১৮৬০ সালে তার আবির্ভাব হয়। উইলকি কলিন্সের ‘দ্য উম্যান ইন হোয়াইট’ বইতে দেখা দেয় মেরিয়ন হলকম্। এই বইয়ের রহস্যসন্ধানী ওয়ল্টার হার্টরাইটের সমান বুদ্ধি তার, রহস্যভেদে সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। কিন্তু, তার এই ভূমিকাই একটা অ্যাংজাইটির জন্ম দেয়। ওয়ল্টার বারবার নিজেকে বোঝায়– বুদ্ধি থাকতে পারে, কিন্তু মেয়েটা দেখতে তো বিচ্ছিরি। স্পষ্ট করে কিছু না বললেও, ন্যারেটিভের চলনে, এটাই প্রকাশ পায়। তার চেয়েও বড়ো কথা, তাকে কেউ মেয়ে বলেও ধরে না, সহযোদ্ধা হিসেবেও সঙ্গে নেয় না। তাকে সেই বৃত্তে ফেলে দেয়, যেখানে রানি প্রথম এলিজাবেথকে ফেলে একদা আশ্বস্ত হয়েছিল পুংচিন্তন– এরা এক জাতীয় মেটাফর। ছেলে বা মেয়ে কোনোটাই নয়। মোদ্দা কথা, সত্যান্বেষী চরিত্রের মধ্যে থাকবে কর্তৃত্ব আর স্বাধীনতা, আর এই দুটো পুরুষালি জিনিস। যদি কোনও মেয়ে রহস্যভেদী হয়ে, স্বাধীন চিন্তার কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তবে, সমাজ নারীত্ব বলতে যা বোঝে তার কিছুটা বিসর্জন দিতে হবে। মেরিয়ন হলকম্-এর ক্ষেত্রে এই বস্তুটি হল রূপ।
১৮৯৭ সালে আনা ক্যাথরিন গ্রিন-এর ‘দ্যাট অ্যাফেয়ার নেক্সট ডোর’ বইতে দেখা দিলেন আমেলিয়া বাটারওয়র্থ- মিস মার্পল চরিত্রের অনুপ্রেরণা। ১৮৯৯ তে আমরা পেলাম লোইস কেইলি-কে, গ্রান্ট অ্যালেন-এর ‘মিস কেইলিস্ অ্যাডভেঞ্চারস্’ বইতে। এইসব চরিত্রের মধ্যে বেশ কিছু মিল আছে। সেই সময় নারীত্ব বলতে যা বুঝত, তার বাষ্প পর্যন্ত এদের মধ্যে নেই। পরিবার থাকলেও তারা কাহিনির অংশ হয় না। এক ধরনের পুরুষবর্জিত পরিবেশে নিবাস এদের। যদিও নিউ ইয়র্কের কেট গোলেট– হারালান হলসি-র ‘দ্য লেডি ডিটেকটিভ’ (১৮৯০) বইয়ের নারী সত্যসন্ধানী– সুন্দরী আর বুদ্ধিমতী দুইই; লেখক তাড়াতাড়ি তার বিয়ে দিয়ে কেরিয়ারে ইতি টেনে দেন। পাঠক কেটকে সইতে পারছিল না বোধহয়। আসল কথা সেই একই: সমাজ গোয়েন্দা আর নারীদের কাছ থেকে একই জিনিস চায় না।
বিশ শতকের প্রথম দিকেও গল্পটা বদলায়নি বেশি। মেরি রবার্টস রাইনহার্টের টিশ কারবেরি, হিল্ডা অ্যাডামস; হিউ ওয়াইয়ার-এর ম্যাডলিন মিক – সবাই হয় স্বাভাবিক জীবনের বাইরে আর নাহয় মডলিন এবং মিক – স্যাঁতানো রকম নম্র!
১৯৩০ সালে আগাথা ক্রিস্টি লিখলেন ‘দ্য মার্ডার অ্যাট দ্য ভিকারেজ’। আবির্ভূত হলেন বিন্দী পিসির আদি রূপ মিস জেন মার্পল। অবশ্য, সঠিক অর্থে, ১৯২৭ সালে লেখা ছোটো গল্প, ‘দ্য টিউসডে নাইট ক্লাব’-এ প্রথম দেখা মেলে তাঁর। প্রায় একই সময়, প্যাট্রিসিয়া ওয়েন্টওয়র্থ জন্ম দেন মড সিলভার-এর [‘দ্য গ্রে মাস্ক’ (১৯২৮)]।
এই দুই মেয়ে ডিটেকটিভও অনেকটা এক ধরনের – বাস্তবের নারীর ছায়া-ছোঁয়া থেকে দূরে থাকা সমস্যাসমাধান যন্ত্র। মিস মার্পল তো পরে নিজেকে মানবতার বাইরে দেবলোকে তুলে আনেন, হয়ে ওঠেন ন্যায় বিচারের দেবী– নেমেসিস।
১৯২৯ সালে ‘দ্য ওমনিবাস অফ ক্রাইম ফিকশন’ বইয়ের ভূমিকায় ডরোথি এল সেয়ার্স যা লেখেন, তার থেকে উঠে আসে : এই যে বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে হলে গোয়েন্দা হয় না, আবার গোয়েন্দা হলে বিশ্বাসযোগ্য মেয়ে হয় না – এর দ্বন্দ্ব, তার প্রধান কারণ, সমাজ বিশ্বাস করে, সমস্যার সমাধানে মেয়েরা ইনটিউশন ব্যবহার করে, আর পুরুষরা লজিক। আগাথা ক্রিস্টিতে পোয়ারোর লজিক আর মিসেস অলিভারের ইনটিউশন-এর খটাখটি আমরা দেখেছি। কতখানি তেতো হাসি এর আড়ালে লুকোনো, তা নিয়ে নাহয় বারান্তরে কথা হবে। আপাতত, এটুকু বলি, ১৯৩০ সালে ‘স্ট্রং পয়জন’ বইতে সেয়ার্স সৃষ্টি করেন, অক্সফোর্ড শিক্ষিতা, রহস্যকাহিনি লেখিকা তথা সত্যসন্ধানী হ্যারিয়েট ভেন-কে। মূল গোয়েন্দা লর্ড পিটার উইমসিই থাকেন, কিন্তু, ইংরিজি বলা দুনিয়া প্রথম এক নারী সত্যান্বেষী পেল, যে রক্তমাংসের মেয়ে আর গোয়েন্দা দুই-ই। হ্যারিয়েটই প্রথম ‘কুমারী গোয়েন্দা – স্পিনস্টার স্লিউথ’ যার একটা প্রেমজীবনের কথা জানা যায়।
এইখান থেকেই বরং ঘরের পানে চাই আমরা। বাংলা ভাষায় যে নারী প্রথম গোয়েন্দা গল্প লেখেন, তাঁর নাম সরলাবালা দাসী। ১৯০৩ সালে, ‘ঘড়ি চুরি’ বলে সেই গল্প লিখে লেখিকা কুন্তলীন পুরস্কার পান। এবার, চল্লিশ বছরের ফাস্ট ফরোয়ার্ড। বিশ শতকের চারের দশকের মাঝামাঝি, দেব সাহিত্য কুটীর প্রকাশ করতে শুরু করে ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘প্রহেলিকা’ প্রভৃতি নামের রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনির সিরিজ। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ সিরিজটি। এই সিরিজের চব্বিশটা বইয়ের এগারোটা ছিল রহস্য কাহিনি বা গোয়েন্দা উপন্যাস, এবং এই এগারোটি বইয়ের মধ্যে একটি হল প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর লেখা ‘গুপ্তঘাতক’ (১৯৪৪?)। এই বইতেই বাংলা রহস্যকাহিনিজগৎ পেল তার প্রথম নারী সত্যান্বেষীকে –রহস্যভেদী কৃষ্ণা।
কৃষ্ণা এতটাই পাঠক আনুকূল্য পায় যে, প্রভাবতীকে কৃষ্ণা সিরিজ লিখতে হয়। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’, ‘প্রহেলিকা’ আর কৃষ্ণা সিরিজ মিলিয়ে মোট এগারোটা বই আছে। কী জাতীয় গল্প লিখতেন কৃষ্ণার স্রষ্টা? কৃষ্ণা যখন আবির্ভূত হয়, তখন বাংলায় কিরীটী রায় আর ব্যোমকেশ বক্সীর যুগ। ১৯৩২ থেকে শরদিন্দু আর ১৯৩৯ থেকে নীহাররঞ্জন লিখছেন। দ্বিতীয়জনের রচনায় বিদেশি গন্ধ বড়ো প্রকট। ১৯৪৩-এ প্রকাশিত ‘আঁধার পথের যাত্রী’ (পরে নাম হয় ‘ঘুম নেই’) আগাথা ক্রিস্টির ‘মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড’-এর আক্ষরিক অনুসরণ। অন্যদিকে, প্রথমজন বিদেশি প্রভাবকে আত্তীকৃত করে মৌলিক কাহিনি লিখছেন ঈর্ষণীয় ভাষায়। এঁরা দুজনেই লজিক আশ্রিত তদন্তের বর্ণনা দেন; দুজনেরই সত্যান্বেষী (শরদিন্দু সৃষ্ট শব্দ) ধাপে ধাপে এগিয়ে, তদন্তের শেষ পর্যায়ে অপরাধীকে শনাক্ত করেন।
প্রভাবতী দেবীর কৃষ্ণা ঠিক এই পথে চলে না। কৃষ্ণার অভিযানগুলো পড়লে, আমার অন্তত এডগার ওয়ালেসের কথা মনে পড়ে : প্লট জটিল নয়, ভাষা সরল, টানটান উত্তেজনা। ক্লাসিকাল হুডানিট না বলে, ক্রাইম থ্রিলার বলা যায় কৃষ্ণা সিরিজের কাহিনিগুলিকে।
কৃষ্ণা দু-পুরুষের পুলিশ কর্মচারী কর্মচারী পরিবার থেকে এসেছে। তার মা পল্লিবাংলা থেকে আসা লজ্জাশীলা গৃহবধূ ছিলেন, কিন্তু সে তা নয়। ব্যায়াম করা সুগঠিত চেহারার কৃষ্ণা, মাতৃভাষা ছাড়াও পাঁচ-সাতটা ভাষায় অনর্গল বাক্যালাপের ক্ষমতা রাখে, অশ্বারোহণ, মোটর চালানো, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে সে দক্ষ, মা-বাবার হত্যার প্রতিশোধ নিতে সে রহস্য উদঘাটনের পথে বা বাড়ায়, জানাতে চায় – ‘মেয়েরা এগিয়ে চলুক, তাদের শক্তি ও সাহসের পরিচয় দিক।’
বোঝাই যাচ্ছে, কৃষ্ণা একটা ইচ্ছাপূরণের প্রতীক। বিশ্বাসযোগ্য মানবী নয় সে। বার্মা ও বাংলা সংলগ্ন অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে সে ‘অবলা অল্পবুদ্ধি মেয়েমানুষ’ মিথ ভাঙে বটে, কিন্তু, নিজে সে রয়ে যায় তার পশ্চিমি বোনদের মতো একা, এক রক্তমাংসের স্পর্শহীন সমস্যাসমাধান যন্ত্র। আমরা জানি না, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী কোন কোন ইংরিজি লিখিয়ের রহস্যকাহিনি পড়েছিলেন। তবে, কোনান ডয়েল আর ক্রিস্টি পড়েছিলেন ধরেই নেওয়া যায়। ফলে, মেয়ে গোয়েন্দাদের সঙ্গে জোড়া ডিসকোর্স তাঁকে প্রভাবিত করেছিল। তার ওপর তিনি লিখছেন, বাঙালি মধ্যবিত্ত পাঠকের জন্য। হতে পারে, তিনি যে সময়ে লিখেছেন, তার অন্তত বছর বিশেক আগে থেকে বাঙালি সমাজে নারীর অবস্থান সম্পর্কে ধারণা বেশ কিছুটা বদলেছে; হতে পারে শিক্ষা, অবরোধ প্রথার কড়াকড়ি হ্রাস এবং আংশিক অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের ফলে নারীদের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন ও আত্মসচেতনা বৃদ্ধি পুরুষের মনে নারী সংক্রান্ত ধারণা অনেকটাই বদলে দিয়েছে; সঠিক অর্থে স্বাধীন না হলেও তাঁরা ‘স্বাধীনচেতা’ হয়েছেন, কলকাতায় তো বটেই, তার সঙ্গে মফস্সল আর গ্রামেও (বস্তুত, এসব না হলে কৃষ্ণা চরিত্র কল্পনাই করতে পারতেন না প্রভাবতী দেবী) – তবু ভালো মেয়ে/মন্দ মেয়ে বাইনারিটা রয়েই গেছে। তাই, কৃষ্ণা যে সচ্চরিত্রা, তার ‘সতীত্ব’ যে অক্ষুণ্ণ, সেটার ওপর জোর দিতে হয় লেখককে। কারণ, তা না হলে, তাঁর উদ্দিষ্ট মধ্যবিত্ত, ভদ্র, পাঠক সমাজ কৃষ্ণাকে গ্রহণ করবে না।
তার মানে, পিতৃতান্ত্রিকতার যে বয়ানের মধ্যে লিখেছেন এলিজাবেথ ব্র্যাড্ন্ থেকে ডরোথি এল সেয়ার্স, সেই একই বয়ান নিরূপণ করেছে বাংলার কৃষ্ণাকেও। তাই, মানবীবিদ্যা চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ হলেও সে ছায়ামানবী; দোষলেশশূন্য, কাম-প্রেম বর্জিত এক মেটাফর। কিরীটী আর-এক কৃষ্ণাকে বউ করতে পারে (পারবেই। কারণ, অর্জুনপত্নী কৃষ্ণা ছাড়া আর কে হবেন? মহাকাব্য দিয়ে কাহিনিভুবন মহিমান্বিত করেন নীহাররঞ্জন।), সত্যান্বেষী বলেই সত্যরূপিণী সত্যবতীকে পায় ব্যোমকেশ; কিন্তু, কৃষ্ণার অধিকার নেই কোনও ইন্দ্রপুত্রকে সঙ্গী করার। গোয়েন্দাগিরি করছে, এই না কত, তার ওপর লব্ করলে, ছেলে-মেয়ে বকানো বই কিনবে গেরস্থ সংসার? মনে রাখা ভালো, মেয়েদের ‘স্বাধীনচেতা’ হওয়ার অনুমতি আছে, ‘স্বাধীনতা’ তখনও সুদূরপরাহত।
তাই আপস। প্রভাবতী দেবী সরস্বতী কোনও দিনই র্যাডিক্যাল সাহিত্য রচনার কথা ভাবেননি। ‘বিজিতা’ই হোক বা ‘ব্রতচারিণী’; ‘সংসার পথের যাত্রী’ই হোক বা ‘মহীয়সী নারী’, তাঁর সব রচনাকেই তিনি গণদেবতার আশিসধন্য করতে চেয়েছেন। জনমনোরঞ্জনী বলেই ‘বিজিতা’ (১৯২৭) বাংলা, হিন্দি, এমনকি মালয়ালাম ভাষায় চিত্রায়িত হয়ে বিপুল সাফল্য লাভ করে। সুতরাং, কৃষ্ণা সিরিজ লেখার সময়ও বাজারের চাহিদাকে অস্বীকার করার কোনও উপায় ছিল না তাঁর।
আরও পড়ুন : পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে পুরোদস্তুর গোয়েন্দা হলেন মেয়ে / রণিতা চট্টোপাধ্যায়
কিন্তু, সম্ভবত তাঁর সম্পূর্ণ অজ্ঞাতসারেই, বাংলার প্রথম নারী সত্যান্বেষী এক আন্তর্জাতিক বয়ানের অংশ হয়ে উঠেছে। আর তাই, বর্তমানের অ্যাকাডেমিক ডিসকোর্সে তার মূল্যও বেড়ে গেছে বহুগুণ।
ঋণস্বীকার :
১) রিচার্ড ব্র্যাডফোর্ড
২) সুকুমার সেন
৩) গোলাম মুরশিদ
৪) শিশিরকুমার দাশ
৫) রণিতা চট্টোপাধ্যায়
......................................
[পোস্টার : অর্পণ দাস]