খ্যাতির মধ্যগগনে পৌঁছেও সপ্তাহে একদিন নুন-ভাত খেতেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভরদুপুরে অকস্মাৎ অতিথি এসে হাজির। এদিকে আহারের আয়োজন বাড়ন্ত। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রতিবেশীর ঘরে দৌড়লেন গৃহকর্ত্রী। ওবাড়ির কর্তা সবে খেতে বসেছেন। দরজা দিয়ে ঢুকে পড়শি বধূর কাছে সাহায্যের আবেদন জানাতেই প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কর্তার পাত থেকে মাছের ঝোলের বাটি তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন বধূটি। পড়শির মান বাঁচল। বধূটির নাম রমা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর তাঁর স্বামী? প্রখ্যাত সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
এমনটাই ছিলেন পথের কবি। মানুষের বিপদে আপদে যেভাবে হোক, যতটুকুই হোক পাশে এসে দাঁড়াতেন। দৈনন্দিন আহারের আয়োজন ছিল সাধারণ। তার মধ্যেও যদি এজাতীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন, শুধু ডাল ভাত দিয়েই দ্বিপ্রাহরিক আহার সাঙ্গ করতে কোনও বিরক্তি ছিল না। আসলে তিনি কোনোদিন তাঁর অতীতকে ভুলতে পারেননি। মেসের টাকা সময়মত শোধ করতে না পারায় মেসের মালিক যখন মালপত্র শুদ্ধু বিনা নোটিশে তাকে বের করে দেন, তখন একবেলা কোনও পাইস হোটেলে ক্ষুণ্ণিবৃত্তি আর একবেলা নির্জলা উপোস। কখনও বা এক পয়সার ছাতু কিংবা তালফুলুরি। ভুলে যাবেন কী করে, কর্মসূত্রে পিতা গিয়েছেন দেশান্তরে, নাতিকে স্কুলে ভর্তি করতে সংসারের শেষ সম্বল রূপোর গোট বিক্রি করে সাকুল্যে সাতটি টাকা হাতে তুলে দিচ্ছেন ঠাকুমা। পরীক্ষার ফি দিতে না পারায় যখন জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি ফেরার উদ্যোগ করছেন, বন্ধুর কথা শুনে নোটিশ বোর্ডে গিয়ে অবাক হয়ে দেখছেন ডিফল্টার লিস্টে তাঁর নাম নেই। পরে বি.এ পাস করে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়কে প্রণাম করতে গিয়ে শুনছেন, গোপনে আচার্যদেবই পরীক্ষার ফি জমা করে দিয়েছিলেন। এই দিনগুলিই গড়ে দিয়েছিল তাঁর জীবনবোধ। সারাদিন কাটিয়েছেন ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে, কখনও পরবর্তী উপন্যাসের খসড়া করছেন, সময় পেলেই কলকাতার কাছে-পিঠে গ্রামগুলিতে ঘুরে বেড়িয়েছেন। অথচ তখনও তাঁর দুবেলার অন্নসংস্থানের কোনও ঠিক নেই। অনেকদিন পরে, একবার কলকাতার ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে তাঁকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হবে, সপরিবারে উপস্থিত হয়েছেন লেখক। দরজা দিয়ে ঢোকার মুখে পাশে বাঁধানো একটি সিমেন্টের বেদির কাছে কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালেন, তারপর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘কল্যাণী, এই জায়গাটা দেখ, এই বেদিটা। তোমাকে গল্প বলেছিলাম মনে আছে? সেই যে, মেসের ভাড়া না দিতে পারায় আমাকে পথে বার করে দিয়েছিল, তখন বেশ কয়েকদিন রাত্তিরে আমি এই বেদিটার ওপরে ঘুমোতাম। মাঝরাত্তিরে পাহারাওয়ালা এসে তাড়া দিলে উঠে গিয়ে গোলদিঘির বেঞ্চিতে শুয়ে থাকতাম। আবার সেখানে তাড়া দিলে এখানে ফিরে আসতাম। মানুষের ভাগ্য কী অদ্ভুত কল্যাণী, সেই বাড়িটাতেই সভা করে আজ আমাকে সংবর্ধনা দিচ্ছে।’
এমনটাই ছিলেন মহানন্দ-পুত্র। খ্যাতির মধ্যগগনেও কখনও তাঁর শিকড় বিস্মৃত হননি। অপ্রয়োজনীয় বিলাস-ব্যসন ছিল দু চোখের বিষ। বিলাসিতাকে বলতেন ‘ফোতো নবাবি’। একবার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে আঢ়া জেলায় সাহিত্য সম্মেলনে যাবেন বিভূতিভূষণ। আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গের তালিকায় আছেন গজেন্দ্রকুমার মিত্রও। তিনি গল্পপাঠ করবেন। আর ‘বড়দা’ বিভূতিভূষণ সভাপতি। একসঙ্গেই যাবেন। নির্দিষ্ট দিনে হাফ হাতা টুইল শার্ট আর খাটো ধুতি পরে বাড়ি থেকে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে প্রস্তুত বিভূতিভূষণ। এদিকে আঁতকে উঠেছেন রমা দেবী। এই পোশাক পরে কি না অত বড় অনুষ্ঠানে যাবেন! অগত্যা সেসব ছাড়তে হলো। পরিবর্তে এলো গিলে করা পাঞ্জাবির সঙ্গে কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি। সঙ্গে সোনার বোতাম। অস্বস্তি সত্ত্বেও সেসব পরতে হলো। এদিকে জুতো বদলাবার কথা মাথায় নেই। মিত্র ঘোষে পৌঁছনোর পর বড়দার এহেন সাজ দেখে সবাই অবাক। সমবেত প্রশ্নের সামনে লেখক স্বীকার করলেন, এই পোষাক পরিকল্পনা মোটেই তাঁর নয়। তাঁর পত্নীর। তিনি তো তাঁর পছন্দের পোষাক পরেই বেরোতে চেয়েছিলেন। সবার নজর এবার পড়ল তাঁর পায়ের দিকে আর গজেন্দ্রকুমার মিত্র প্রায় চিৎকার করে উঠলেন, ‘একী! এত সুন্দর ড্রেসের সঙ্গে এই জুতো!’ সঙ্গে সঙ্গেই সুমথবাবুকে বলে রাদুর দোকান থেকে বড়দার পায়ের মাপে নিউকাট পাম্পশু কিনে আনতে বললেন। বিভূতিভূষণ এতক্ষণ স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই মৃদু স্বরে আপত্তি জানাচ্ছিলেন, সুমথবাবু জুতোর মাপ নেওয়ার জন্যে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে জুতো খুলতে এলে রেগে গেলেন। পরে গজেন্দ্র কুমার মিত্র, লেখকের পুত্রবধূ মিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে এক আলাপচারিতায় বলেছিলেন, বড়দাকে এমন রাগতে তিনি আর কখনও দেখেননি। ভীষণ রেগে বিভূতিভূষণ বলে উঠলেন, “বারবার বলেছি—ওসব ফোতো নবাবি কোরো না। এসবে কিছু যায় আসে না। একটা কথা বলি শোনো। যখন ওরা নেমন্তন্ন করতে এসেছিল তখন আমার পায়ে এই ক্যাম্বিশের জুতোই ছিল এবং তোমার পায়ে ওই নিউকাট পাম্পশুই ছিল। তা সত্ত্বেও ওরা তোমাকে শুধু গল্প পাঠ করতে বলেছে এবং আমাকেই সভাপতি করেছে, তোমাকে নয়।” ‘বড়দা’র তিরস্কারে শিউরে উঠেছিলেন গজেনবাবু। এক অন্যতর সত্য দর্শন হয়েছিল তাঁর।
এমনটাই তো ছিলেন বিভূতিভূষণ। যাঁর উপর তথ্যচিত্র নির্মাণের সময়, বিখ্যাত মানুষদের সঙ্গে ঠাঁই পায় এক অখ্যাত জেলেও। বিভূতিকাকাকে যে খুব কাছে থেকে দেখেছিল সে। কাছে থেকে দেখেছিল বলেই প্রতি বছর সাহিত্যিকের জন্মদিনে বিস্তর ভিড়, আলোর সমারোহে বিভূতিভূষণের পুরোনো ভিটের অন্ধকারে থাকা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তার চেয়ে ভালো কেই বা আর জানে তিনি পূর্বপুরুষের ভিটেকে কতটা ভালোবাসতেন। সে যে ছোট থেকে তাঁকে দেখে এসেছে। এই ভালোবাসা, এই মনে পড়া থেকেই সপ্তাহে একদিন বাড়ির সবার জন্যে ডাল-তরকারি-মাছ ইত্যাদি রান্না হলেও তিনি শুধু নুন-ভাত খেতেন। রমা দেবী দুঃখ করলে বলতেন, “কল্যাণী, দারিদ্রময় বাল্যই আমাকে সাহিত্যের প্রেরণা দিয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছাকাছি রেখেছে, আমি ওদের মানুষ। এই খাবার আমার অহংকে স্থির রাখে, মৃদু রাখে, আমার উৎসকে স্মরণে রাখতে সাহায্য করে”।
ঠিক, এমনটাই ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
****************************************
ঋণস্বীকার: বিভূতিভূষণের সংসার, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়
****************************************