ফোর্থ বেলের দুটি নাট্য : 'একটি অবাস্তব গল্প' ও 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'
ফোর্থ বেল থিয়েটারস তরুণদের নাট্যদল হলেও কলকাতার থিয়েটার-মহল্লায় বেশ পরিচিত নাম। গত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি স্মরণীয় প্রযোজনা তাঁরা উপহার দিয়েছেন। সম্প্রতি তাঁদের তিনদিনের নাট্যোৎসব হয়ে গেল মধ্য কলকাতার জ্ঞান মঞ্চে। নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিন গিয়ে দুটো চমৎকার প্রযোজনা দেখার সুযোগ পেয়েছি। সেই অভিজ্ঞতা খানিক ভাগ করে নেওয়া যাক।
প্রথম নাট্য 'একটি অবাস্তব গল্প' ডার্ক কমেডি। নাটক বিমল বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্দেশক আকাশ পাত্র। বেশ কয়েক দশকের পুরনো নাটকটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এক শ্রমিকের পারিবারিক বিপর্যয়ের কাহিনি। অভাবের পাকেচক্রে সে কীভাবে নিজের স্ত্রীকে খুন করে বসে এবং ফাঁসির আসামী হয়ে যায়, সেই নিয়েই গল্প। ফাঁসির দিন এক অদ্ভুত বিপত্তি দেখা দেয়। ফাঁসি দেওয়ার পরেও বেঁচে যায় আসামী। সেখান থেকে সুতো ছাড়তে শুরু করে আসল গল্প। জেলার সাহেবের ভূমিকায় অনিন্দ্য সাঁইয়ের দাপুটে অভিনয় আগাগোড়া টেনে রাখে নাটকটিকে। সঙ্গে সরকারি ঠাকুরমশাই সিদ্ধার্থ লাহাও খুব ভালো। ক মণ্ডলের ভূমিকায় আকাশ পাত্র চরিত্রের প্রতি সুবিচার করেছেন। নাটকটি সমাজসচেতন। বক্তব্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। গল্পে চমক ভরপুর। কিছু কিছু জায়গায় সিচুয়েশনাল কমেডি পেটে খিল ধরিয়ে দেয়। কিন্তু কমেডি থেকে সিরিয়াস বক্তব্যে যাওয়া-আসাটা খুব মসৃণ হয়নি। বাম্পারে ঠোক্কর খেয়েছে স্ক্রিপ্ট। জোড়ের দাগগুলো চোখে পড়ে বড্ড। নাটকের শেষ দিকে ক মণ্ডলের একোক্তি এতটাই লম্বা, নাট্যরস বিঘ্নিত হয়। তবে সেটা মূল নাটকের সমস্যা। দু-একজনের অভিনয়ের ত্রুটি বাদ দিলে নাট্য-উপস্থাপনা মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন ও উপভোগ্য। সেদিনের কারখানার কর্মী থেকে শুরু করে আজকের কর্পোরেট শ্রমিকরা - কলার সাদা হলেও সমস্যা যে পাল্টায়নি, সেকথার ধরতাই দেওয়া থাকে নাটকের শেষে।
মুগ্ধ করেছে দ্বিতীয় নাট্য 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু'। সত্যজিতের বিখ্যাত গল্পের নাট্যরূপ দিয়েছেন উজ্জ্বল মণ্ডল। নির্দেশনাও তাঁর। মূল কাহিনির খানিক সম্প্রসারণ ঘটিয়েছেন তিনি। এ- গল্পের মূল কথা, যাঁরা পড়েছেন তাঁরা জানেন, 'উল্টে দেখুন,পাল্টে গেছি'। কল্পবিজ্ঞানের মলাটে নিজেকে খুঁজে পাবার আখ্যান। সাহিত্যবেত্তারা অনেকেই অবশ্য সায়েন্স ফিকশন না বলে সায়েন্স ফ্যান্টাসি বলতে চাইবেন। তাতেই বা আপত্তি কী! রূপকথাই তো! যা-ই হোক, অ্যাং-কে কীভাবে দেখানো হবে তা নিয়ে কৌতূহল ছিল। মূল গল্পে অ্যাং-এর বিচিত্র চেহারার কথা দর্শকদের অনেকেরই জানা ছিল নিশ্চয়ই। সত্যজিতের আঁকা ছবিটাও মাথায় ঘুরছিল। দেখলাম, পরিচালক খুব জটিল পথে হাঁটেননি। বঙ্কুবাবু যাতে চমকে না যান, তাই নিজের আসল চেহারায় না এসে বঙ্কুবাবুর মতোই ধুতি-ফতুয়া পরে অবতীর্ণ হয়েছে অ্যাং। ছোট্ট এই বদল এনে ভিস্যুয়াল ঝুঁকি বাদ দিয়ে দিয়েছেন নাটককার। কিছু আলোর খেলা ও পিছনে সাইক্লোরামায় চমৎকার শ্যাডোগ্রাফির মাধ্যমে এর পরের ফ্যান্টাসি অংশগুলো দেখানো হয়েছে। নাটকে 'চিত্রপট'-এর বাড়াবাড়ির চেয়ে 'চিত্তপট'-এ ভরসা রাখতে বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ভালো লাগল অযথা ঝুঁকি না নিয়ে এই মিনিমালিস্ট অ্যাপ্রোচ। বঙ্কুবাবুর ভূমিকায় রমিত গাঙ্গুলির অভিনয় নিয়ে বলতে গেলে শব্দ কম পড়ে যায়। একদিকে ঝুঁকে পড়া, মিনমিনে, আত্মবিশ্বাসহীন বঙ্কুবাবু আর অন্যদিকে অ্যাং-এর সংস্পর্শে এসে ঘাড় সোজা রেখে কথা বলতে শেখা বঙ্কুবাবু - দুয়েই বাজিমাত করেছেন তিনি। নাটকে বঙ্কুবাবুর স্ত্রী মালতী এসেছেন, মূল গল্পে যিনি নেই। মালতীর চরিত্রে প্রজ্ঞা দেবনাথ সাবলীল। অ্যাং অরিত্র দত্তও যথাযথ। ছায়াবাজির কাজ করেছেন ইন্দ্রনীল মজুমদার আর অম্বরীষ দাস। কুর্নিশ জানাই তাঁদের। আলাদা করে বলতে হয় শব্দপ্রক্ষেপন ও নাচের কোরিয়োগ্রাফির কথাও। সত্যজিতের গল্পে আরও টুকটাক যা কথাবার্তা বীজের আকারে ছিল, সেই সবকিছুকে আরও একটু পাপড়ি মেলতে দিয়েছেন নাটককার। বা হয়তো কথাটা মূল গল্পের গর্ভে ছিল না মোটেই, নাটককারই 'বন্ধু' শব্দটাকে আরও অনেক প্রসারিত চেহারায়, আরও অনেক বৃহত্তর আঙিনায় দেখতে চেয়েছেন। সব মিলিয়ে, সহজ কথায় বড় সুন্দর করে বেঁধে বেঁধে থাকার বার্তা দিয়েছেন তিনি। এ-প্রসঙ্গে মনে পড়ল, 'সধবার একাদশী' নাটকে জীবনচন্দ্রের ভূমিকায় অভিনয় করার সময় একটা বাগবিতণ্ডার দৃশ্যে অর্ধেন্দুশেখর মুস্তফী তাঁর স্টেজ-পুত্র অটলকে লাথি মেরে প্রস্থান করেছিলেন। লাথির ব্যাপারটা মূল নাটকে ছিল না। সেদিন দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন দীনবন্ধু মিত্র স্বয়ং। তিনি কিন্তু সিন দেখে উচ্ছ্বসিত। নাটক শেষে তিনি ধরলেন অর্ধেন্দুবাবুকে। বললেন - আপনি যে অটলকে লাথি মারলেন, ও হচ্ছে 'Improvement on the author'। আমি পরের সংস্করণেই জুড়ে দেব 'অটলকে লাথি মারিয়া গমন। উজ্জ্বলবাবুর এই নাট্যরূপকে 'ইম্প্রুভমেন্ট অন দ্য অথর' বললে খুব বাড়িয়ে বলা হবে না বোধহয়।
দুটি নাট্যেরই সাফল্য কামনা করি। বিশেষত, এই দ্বিতীয় প্রযোজনাটি ভালোরকম দর্শক-আনুকূল্য পাবে এবং ফোর্থ বেল থিয়েটারসের ঘরে লক্ষ্মীদেবীকে বারবার ডেকে আনবে, এ আমার একান্ত বিশ্বাস।
.............................
#বঙ্কুবাবুর বন্ধু #সত্যজিৎ রায় #4th bell theatres