একই বৃন্তে দুইটি কুসুম – ডিএনএ কাইমেরা
অতিমারি, অনিশ্চয়তা, ভ্যাক্সিন আর এই এখন আস্ত একটা যুদ্ধ – এতকিছুর মাঝে গত বছর এপ্রিল মাসের একটা ছোট্ট খবর গবেষক মহলের বাইরে অনেকেরই চোখ এড়িয়ে গেছে। আমেরিকা ও চীনের দুই দল বিজ্ঞানী মিলে বানিয়েছেন মানুষ ও বাঁদরের ভ্রূণের সংকর বা কাইমেরা। অন্য সময়ে হলে এই খবরে গবেষণাক্ষেত্রের পুরনো বিতর্ক মাথাচাড়া দিত, রে-রে করে উঠতেন বিজ্ঞানীরা। পূর্ণাঙ্গ কাইমেরা তৈরির দিকে বিজ্ঞানের আদৌ পা বাড়ানো উচিত কিনা, স্টেম কোশ গবেষণায় এই বিতর্ক বহুদিনের। এমন নয় যে এর আগে আলাদা আলাদা ভ্রূণের সংমিশ্রণ ঘটানো হয়নি। কিন্তু দুই উন্নত স্তন্যপায়ী, যারা কিনা একে অন্যের বিবর্তনগত নিকটতম আত্মীয়, তাদের নিয়ে এমন কাজ এই প্রথম। পরীক্ষাগারে ছয়দিন বয়সী একেকটি বানরভ্রূণে পঁচিশটি করে মানবভ্রূণের স্টেম কোশ প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়; মূল উদ্দেশ্য ছিল মানব স্টেম কোশের উপস্থিতিতে বাঁদরের ভ্রূণ কীভাবে মানিয়ে নেয় তা দেখা। বিবর্তনের পথে অনেকটা সময় একসঙ্গেই হেঁটেছে বাঁদর এবং আদিমানব হোমো ইরেক্টাস। বদল তো শুধু বহিরঙ্গে নয়, কোশের অন্তরঙ্গে, ভ্রূণের বৃদ্ধি ও বিকাশে, পেশি ও অন্যান্য কলার গঠনে – বদল সর্বব্যাপী। বিবর্তনের সেই প্রাথমিক পত্রালাপ পড়তে চাওয়ার বাসনাতেই এমন কাইমেরার সৃষ্টি।
সে পরীক্ষার ফলাফল এই লেখার উপজীব্য নয়, গেল-গেল রব তোলার মতো এখনও কিছু হয়নি। বরং নজর করি অন্য একটি শব্দ, কাইমেরা (chimera) – গ্রীক পুরাণে বর্ণিত এক দানবীয় জন্তু যা কিনা অংশত সিংহ, ছাগল ও সাপের সমষ্টি। এই ধারণা থেকেই জীববিদ্যার গবেষণায় দুটো আলাদা বস্তুর অস্বাভাবিক সমন্বয়কে কাইমেরা বলা হয়। যে ভ্রূণ সম্পর্কে এতকিছু বলা হল, সে যদি ঠিকঠাক বেড়ে উঠত তাহলে তার শরীরে থাকত দুটো আলাদা ধরনের কোশ – সে হতো প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাইমেরা।
প্রথম? সত্যিই কি তাই? ক্রিস লং দ্বিমত পোষণ করতে পারেন। বেশিদিন না, এই তো ২০১৯ সালের ঘটনা, আমেরিকার নেভাডা প্রদেশের রেনো শহরে কাউন্টি শেরিফের অফিসে একটা সার্ভে হচ্ছিল। ক্রিস সেখানেই তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরে কাজ করেন, সার্ভেতে নাম লিখিয়ে নিয়মানুযায়ী নিজের বীর্যের নমুনা জমা দিয়েছিলেন। একদিন হঠাৎ উপরওয়ালার তলব পেয়ে চমকে গেলেন, রিপোর্ট বলছে বীর্যে পাওয়া ডিএনএ নাকি তাঁর নয় মোটেই! এমনটা যে হতে পারে ক্রিসের কোনও ধারণাই ছিল না। বিস্তর অনুসন্ধানের পর জানা গেল, বছর চারেক আগে ক্রিসের লিউকেমিয়া ধরা পড়েছিল। সেই সময় অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে তিনি নতুন জীবন ফিরে পান। এই খবর জানা মাত্রই ক্রিসের রক্তের নমুনা থেকে ডিএনএ নিয়ে বিশ্লেষণ করে দেখা গেল সেইটি দিব্যি মিলে গেছে বীর্যের নমুনার সঙ্গে, অথচ সেটিও ক্রিসের ডিএনএ নয়। ক্রিসের কাছে ব্যাপারটা ভৌতিক শোনালেও বিজ্ঞানীরা রহস্যটা ধরে ফেললেন। তাঁদের ততক্ষণে মনে পড়ে গেছে পুরনো একটা মামলার কথা যা আমেরিকার আইনব্যবস্থাকে নাকানি-চোবানি খাইয়ে ছেড়েছিল, সেবারও ত্রাতা হয়েছিল বিজ্ঞান।
একটু আগে থেকেই গল্পটা শুরু করি তাহলে। ওয়াশিংটন প্রদেশ, ২০০২ সাল। লিডিয়া ফেয়ারচাইল্ড নামে জনৈক মহিলা আদালতে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন জানালেন। তিনি ও তাঁর স্বামীর দুই সন্তান বর্তমান, তৃতীয় সন্তান তখনও লিডিয়ার গর্ভে। এমতাবস্থায় সন্তানের দায়িত্ব একটা টানাপোড়েনের বিষয়, তাই আইনমতে পিতৃত্ব ও মাতৃত্ব পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। নিতান্ত মামুলি ব্যাপার এবং তাতেই লিডিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। জানা গেল, তিনি মোটেই ঐ দুই সন্তানের জন্মদাত্রী মা নন। নিঃসন্দেহ হওয়ার জন্য আবার পরীক্ষা করানো হল – ফল একই, বাবার সঙ্গে বাচ্চাদের ডিএনএ মিললেও মায়ের সঙ্গে আকাশ-পাতাল ফারাক! আইনকে বিভ্রান্ত করার অপরাধে লিডিয়ার বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিলেন বিচারক। যে সময়ের ঘটনা, তখন ডিএনএ-সংক্রান্ত প্রমাণ দেশের আইনে অকাট্য বলে মানা হতো। লিডিয়া যতই বাচ্চাদের সঙ্গে তাঁর ছবি দেখান, অতীতের গর্ভাবস্থার সাক্ষী হাজির করেন, এমনকি তাঁর হতভম্ব স্বামীটিও পর্যন্ত আদালতে দাঁড়িয়ে শপথ করে বলেন যে তিনি নিজে প্রসূতি-ঘরে থেকে সন্তানদের জন্মাতে দেখেছেন – বিচারক সেসব কানেই তুললেন না। অবস্থা এমন বেগতিক হল যে কোনও উকিল তাঁর হয়ে মামলা লড়তে রাজি হচ্ছিল না, ডিএনএ প্রমাণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে নাম ডোবাতে কে চায়! শেষে লিডিয়া নিজেই নিজের হয়ে সওয়াল করতে নামেন। এইসবের মাঝে তাঁর তৃতীয় সন্তানের জন্মের সময় হয়ে এসেছিল, লিডিয়া এই সুযোগকে খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরলেন। আদালতে আবেদন করলেন, তাঁর প্রসবের পর এই তৃতীয় সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করে তারপর যেন শুনানি হয়। আদালত মেনে নিল। এবার আরও বড় ধাক্কা – ডিএনএ বলছে এই সন্তানও লিডিয়ার নয়! ওদিকে আদালত নিযুক্ত এক অফিসার পুরো প্রসব প্রক্রিয়ার সাক্ষী, তিনি তো দেখেছেন এই সন্তান লিডিয়ার গর্ভ থেকেই ভূমিষ্ঠ। তিতিবিরক্ত বিচারক বললেন, নিশ্চয়ই লিডিয়া কোনোভাবে গর্ভবতী সাজার কারচুপি করছেন।
এই সময়, মামলার বিবরণ পড়ে, লিডিয়ার সাহায্যে এগিয়ে এলেন উকিল অ্যালান টিন্ডেল। মক্কেলের সদ্যজাত সন্তানের সঙ্গেও ডিএনএ নমুনা মিলছে না – চোখের সামনে এমনটা দেখে রীতিমতো আগ্রহী হয়েছিলেন তিনি। নথিপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে তিনি হঠাৎ খুঁজে পেলেন সে বছরেরই মে মাসের একটা গবেষণাপত্র, যেখানে একদল চিকিৎসক-গবেষক একটা বিশেষ কেস নিয়ে আলোচনা করেছেন। আলোচনার কেন্দ্রে বাহান্ন বছর বয়সী এক মহিলা, ক্যারেন কীগান। অসুস্থ মহিলাটির আশু প্রয়োজন ছিল কিডনি প্রতিস্থাপনের, তাঁর পরিবারের সদস্যরা দাতা হতে চাইলে ডিএনএ পরীক্ষা করানো হয় এবং জানা যায় ক্যারেনের সঙ্গে তাঁর দুই সন্তানের ডিএনএ-র কোনও মিল নেই।
ব্যাস! এইটাই তো খুঁজছিলেন অ্যালান, শুধু একটা রেফারেন্স। যোগাযোগ করলেন সেই চিকিৎসকদের সঙ্গে, জানা গেল ক্যারেনের ঘটনা শারীরবিদ্যার জগতে বিরল হলেও আশ্চর্যের নয়। ক্যারেন আসলে দুটো ভিন্ন ধরনের কোশসমষ্টির কাইমেরা। ক্যারেনেরও তৃতীয় আরেকটি সন্তান ছিল, নেহাত শিশু, দাতা হতে পারবে না তাই তার নমুনা নেওয়া হয়নি। পরে তার সঙ্গেই ক্যারেনের ডিএনএ মিলে যায়। সব তথ্যপ্রমাণ সমেত এবার আদালতের দরজায় কড়া নাড়লেন লিডিয়া ও অ্যালান। লিডিয়া অবশ্যই একজন ডিএনএ কাইমেরা, আদালত পরীক্ষা করে দেখুক।
কিন্তু এমন ঘটনা কীভাবে সম্ভব? যে কোনও জীবের জন্ম হয় ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলনে, দুজনের অর্ধেক-অর্ধেক ডিএনএ নিয়ে তৈরি হয় সম্পূর্ণ ভ্রূণ আর তা থেকে গোটা জীবদেহ। তাই পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি সবরকম কোশে একই ধরনের ডিএনএ পাওয়া যায়। আসলে রহস্য লুকিয়ে আছে ঐ শুক্রাণু-ডিম্বাণুর মিলনেই। স্বাভাবিক অবস্থায় মেয়েদের ফ্যালোপিয়ান টিউবে একবারে একটিই ডিম্বাণু এসে জমা হয়, দল বেঁধে শুক্রাণুরা তাকেই ঘিরে ধরে। বিশেষ ক্ষেত্রে দুটি ডিম্বাণু একই জায়গা দখল করে থাকতে পারে, তখন দুটি আলাদা শুক্রাণু তাদের নিষিক্ত করবে। এর ফলে একের জায়গায় জন্ম নেয় দুই – অর্থাৎ যমজ ভ্রূণ। এর মানেই যে যমজ সন্তান তা নয়; মায়ের স্বাস্থ্য, জরায়ুর অবস্থা এইসবের ভিত্তিতে অনেক সময়েই একটি ভ্রূণ নষ্ট হয়ে যায় আর অন্যটি সেই মৃত ভ্রূণের কোশগুলি পুষ্টির জন্য আত্মস্থ করে। এর ফলে একই দেহে দুই ধরনের ডিএনএ-যুক্ত কোশ থেকে যায়। তবে সাধারণত এরা সারা দেহে সমান ভাবে থাকে না, এদের মধ্যে মৃত ভ্রূণের কোশ অল্প জায়গার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে।
লিডিয়ার ক্ষেত্রেও এরকমই হয়েছিল। এতদিন ধরে নিয়মমতো ডিএনএ-র নমুনা নেওয়া হয়েছিল মুখের লালারস থেকে। এবার নমুনা নেওয়া হল লিডিয়ার যোনিপথের ভিতরে সার্ভিক্স থেকে। ফল হল অপ্রত্যাশিত – তিন সন্তানের সঙ্গেই একশো শতাংশ মিল! আদালত বাধ্য হল লিডিয়াকে সসম্মানে রেহাই দিতে।
ক্রিসের ক্ষেত্রেও তাহলে একই কিস্যা? না, সেখানে গল্প একটু আলাদা। লিউকেমিয়া আক্রান্ত ক্রিসের পুরনো, রোগাক্রান্ত অস্থিমজ্জা একেবারে সরিয়ে নতুন অস্থিমজ্জা স্থাপন করতে হয়েছিল। এর ফলে সেই অস্থিমজ্জা থেকে উৎপন্ন রক্তকোশগুলিতে ছিল দাতার ডিএনএ। বীর্যে যেহেতু শুক্রাণু ছাড়াও থাকে শ্বেত রক্তকণিকা, তাই ক্রিসের বীর্যে আলাদা ডিএনএ-র অস্তিত্ব পাওয়া গেছিল। জন্মগত ভাবে নয়, বরং আকস্মিক ভাবেই ডিএনএ কাইমেরিজম-এর নিদর্শন হয়ে গেছেন তিনি। তাই আজকের মানুষ আর বাঁদরের কাইমেরা বানানোর গল্প তার কাছে বালখিল্য।
.....................................................................................................................................................
তথ্যসূত্র:
১) The case of Lydia Fairchild and her chimerism, The Embryo Project Encyclopedia
২) Disputed maternity leading to identification of tetragametic chimerism, 2002, NEJM