অভিজ্ঞতার জন্মান্তর: ল্যামার্ক কি তবে ঠিকই ভেবেছিলেন?
মানুষের জীবনে দেনা-পাওনার হিসাবটা যতই জটিল হোক না কেন, একটা কথা সরলভাবে বলে ফেলাই যায় যে জীবনের একমাত্র অনায়াসলব্ধ প্রাপ্তি হোল বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া আদর-যত্ন, ভালবাসা ও নিরাপত্তা। নিষিক্ত ডিম্বাণু পূর্ণাঙ্গ শিশুরূপ পেয়ে মায়ের জরায়ু থেকে ঠিকঠাক ভাবে বেরতে পারলে, বাকিটা যেন এমনিই জুটে যায়। সমস্যার হাতেখড়ি হয়, যেদিন নিছকই খেলার ছলে বর্ণমালার সদস্যদের সাথে পরিচয়পর্ব দিয়ে ইঁদুর দৌড়ের প্রস্তুতিটা শুরু হয়। বাকি গল্পটা সবার ক্ষেত্রে হরেদরে একই রকম; অনেকবার কানমলা, মাথায় চাঁটি, বকা-ঝকা খেয়ে প্রথমে নিজের নিজের মাতৃভাষায় সড়গড় হওয়া, তারপর সারা জীবন ধরেই শেখার ধারা অব্যাহত রেখে অভিজ্ঞতার ঝুলি ভরতে থাকা। এই গুচ্ছগুচ্ছ মহামূল্যবান অভিজ্ঞতা আর স্মৃতির কণামাত্রও যদি জন্মসূত্রে পাওয়া ৪৬টি ক্রোমোজোমের হাত ধরে কোনোভাবে এমনিই জুটে যেত, তাহলে মানবসভ্যতার বিবর্তনের উপর কী প্রভাব পড়ত ভাবুন! সেই বিতর্কে না ঢুকেও একটা সম্ভাবনার কথা অনুমান করা যায় যে আগের প্রজন্মে মুখস্থ করা “কুমোর পাড়ার গরুর গাড়ি”র স্মৃতিটা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার সৌজন্যে, পরবর্তী প্রজন্ম বইয়ের পাতা না উল্টিয়েই গড়গড় করে কবিতাটা বলে দিতে পারত। অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির জন্মান্তরবাদের মতো এমন বিষয়কে কল্পবিজ্ঞানের একটি নিছক উপাদান হিসেবে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, কিন্তু Aplysia californica (এক ধরনের সামুদ্রিক শামুক), Caenorhabditis elegans (একধরনের নিমাটোড) এবং ইঁদুরদের নিয়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ তথ্যাদি অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।
Caenorhabditis elegans-এর আণুবীক্ষণিক ছবি; সৌজন্যে Shutterstock
নলাকার, ১ মি.মি. লম্বা, শান্ত ও গোবেচারা স্বভাবের Caenorhabditis elegans-এর খাদ্যাভাসের উপর আলোকপাত করে বিষয়টা প্রথমে গুছিয়ে বুঝে নেওয়া যাক। এই প্রাণীটির খাবারের বিশেষ কোনো চাহিদা নেই, বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটিরিয়া পেলেই খুশি। এরা দেখতে পায় না, শুধুমাত্র গন্ধ ও স্পর্শের অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ঠিক বুঝে যায় যে মাটির মধ্যে কিভাবে চলাফেরা করলে বেশি বেশি করে ব্যাকটিরিয়ার সন্ধান পাওয়া যাবে। এই গুণের জন্য বিজ্ঞান মহলে এর ব্র্যান্ড ভ্যালু প্রচুর। সবধরনের ব্যাকটিরিয়া খেয়ে এরা আবার সুস্থ থাকতে পারে না; প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক Collen Murphy-র দলবল প্রমাণ করেছে, বিশেষ করে Pseudomonas aeruginosa (সিউডোমোনাস) গোত্রের ব্যাকটিরিয়াকে একবার খাবার পরে শরীর খারাপ করলে, একটি C. elegans তার নিজের জীবদ্দশায় আর কোনোদিন একে খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করে না, এমনকি যেদিকে এই দুষ্টু ব্যাকটিরিয়াগুলো আছে সেই পথও মাড়ায় না। আর কোনদিন বেলতলায় যাব না – এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনোর আগে নেড়ার অন্তত একবার বেলতলায় যাবার অভিজ্ঞতাটা হওয়া প্রয়োজন। এই মুহূর্তে যারা ভাবছে – বাঃ, প্রাণীটির ভাবগতিক তো বেশ মজার – তাদের জন্য আরও মজা অপেক্ষা করে আছে। C. elegans তার নিজের জীবনের এই ঠেকে-শেখার অভিজ্ঞতার স্মৃতিটি পরবর্তী কয়েকটি প্রজন্ম ধরে সংরক্ষণ করতে পারে। তাই তার সন্তান-সন্ততিকে আর নতুন করে ঠেকে শিখতে হয় না, সেই তথ্যটা এরা নিষিক্ত ডিম্বাণু মারফৎ জন্মসূত্রে পূর্ববর্তী প্রজন্মের থেকেই পেয়ে যায়। এই বিশেষ ক্ষমতাটি Transgenerational Inheritance নামে বিজ্ঞানমহলে বেশি পরিচিত।
এটা যদি ম্যাজিক হয় তাহলে মূল রহস্যটা লুকিয়ে আছে স্নায়ুকোষ ও জননকোষ এর মধ্যে তথ্য সরবরাহের কৌশলে। August Weismann এর প্রস্তাবিত “Weismann Barrier” অনুযায়ী দেহকোষ ও জননকোষের মধ্যে পর্যাপ্ত তথ্য বিনিময় না হওয়ার জন্যই দেহকোষে ঘটে যাওয়া কোনো পরিবর্তনের ছাপ জননকোষে পাওয়া যায় না। ফলে অভিজ্ঞতা ও স্মৃতির মতো বিষয় স্নায়ুকোষের অন্তর্জালেই বন্দি থেকে যায়, পরবর্তী প্রজন্মে পৌঁছতে পারে না। মনে করুন বেচারা ল্যামার্কের কথা, অর্জিত গুণাবলীর বংশানুসরণের তত্ত্ব এই কারণেই তো প্রমাণ করতে পারেননি তিনি! আর তাই একদল বিজ্ঞানীর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল এটা খুঁজে বের করা যে উল্লিখিত ক্ষেত্রে তাহলে জননকোষ কিভাবে “Weismann Barrier”-কে ফাঁকি দিয়ে সিউডোমোনাসের উপস্থিতিতে স্নায়ুকোষের ভিতর গোপনে ঘটে যাওয়া জৈবরাসায়নিক পরিবর্তনের হদিশ পাচ্ছে? শুধু যে পাচ্ছে তাই নয়, সেই অনুযায়ী নিজের জৈবরাসায়নিক চরিত্রে এমন কোনো পরিবর্তন ঘটাচ্ছে যার ফলে পরবর্তী প্রজন্মের স্নায়ুকোষও P. aeruginosa-র গন্ধে ওই একই আচরণ করতে পারছে! কী মনে হচ্ছে এখন? মহীনের ঘোড়াগুলি বোধহয় এরকম কিছুর জন্যই লিখেছিল “ধাঁধার থেকেও জটিল তুমি…”।
ধাঁধার জট পুরোপুরি ছাড়াবার আগে আরো কিছু কথা জানিয়ে রাখা দরকার। কোনো কোষের জৈবরাসায়নিক চরিত্র নির্ভর করে সেই কোষের ভিতরে থাকা প্রোটিন উপাদানের সমন্বয়ের উপর। কার্যসূত্রে এক প্রোটিন আরেক প্রোটিনের সঙ্গে কখন এবং কতটা আলাপ জমাবে, সেটা নির্ধারিত হয় কোষের DNA-তে থাকা জিন গোষ্ঠীর সদস্যদের কে কে, কোন রীতিতে সক্রিয় আছে, তার মাধ্যমে। মোটের উপর বলা যায়, কোনো বাহ্যিক উদ্দীপনা সম্বন্ধে পুরনো স্মৃতির গোপন সঙ্কেত লুকানো থাকে স্নায়ুকোষে প্রোটিন ও জিনের জটিল মিথস্ক্রিয়ার ধরনের মধ্যে এবং সেটা পরীক্ষা করেই Collen Murphy-র গবেষণায় জানা গেছে যে সিউডোমোনাসের গন্ধ পেলেই C. elegans-এর চম্পট দেবার পেছনে আসল কারণ হল – স্নায়ুকোষে daf-7 জিনের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া।
আরেকটু খোলসা করে বলা যাক? P. aeruginosa সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ C. elegans-এর স্নায়ুকোষে daf-7 জিন কম পরিমাণে সক্রিয় থাকে বলে এদের গন্ধের ফাঁদে C. elegans-কে একবার অন্তত পড়তেই হয়। তার ফলাফল হল চোরা ঢেঁকুর, বদহজম, আর কপাল ভাল না থাকলে পুরো খতম! ভাগ্যের জোরে যারা কোনোমতে বেঁচে যায়, তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে এই ব্যাকটিরিয়ার গন্ধ পেলেই daf-7 সক্রিয় হয়ে উঠে C. elegans-কে সতর্ক করে দিচ্ছে। পরবর্তী কয়েকটি প্রজন্ম ধরে daf-7 এই অ্যালার্ম বাজানোর কাজটা করতে থাকে, যাতে P. aeruginosa -এর ফাঁদে আবার না পড়তে হয়।
এরপর যে প্রশ্নগুলোর উত্তর পাওয়া বাকি থেকে যায় সেগুলো হল – daf-7 জিনের সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়ার খবর কে বা কারা, কিভাবে স্নায়ুকোষ থেকে জননকোষে পৌঁছে দিচ্ছে? এই বিষয়ে এখনও সঠিক ভাবে কিছু জানা না গেলেও বিজ্ঞানীদের সন্দেহের তালিকায় সবার উপরে আছে বিভিন্ন ধরনের Small Non-coding RNA (যে সকল RNA থেকে প্রোটিন তৈরি হয় না)। Craig Mello, Andrew Fire, Oded Rechavi এবং আরও অনেক বিজ্ঞানীর গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া গেছে যে Small Non-coding RNA-রা দেহকোষ থেকে জননকোষে অবাধে বিচরণ করতে পারে; সেই কারণে বলাই যায় যে সন্দেহটা মোটেই অমূলক নয়। আর এই সন্দেহকেই আরও জোরদার করে তোলে University of California-তে গবেষণারত David Glanzman-এর একটি পরীক্ষার ফলাফল। উনি প্রথমে একধরনের সামুদ্রিক শামুক (A. californica)-কে electric shock treatment দিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন যে কিভাবে এবং কতটা দক্ষতার সাথে প্রতিরক্ষামূলক প্রতিক্রিয়া তৈরী করা যায়। এরপর, প্রশিক্ষিত শামুকের স্নায়ুকোষ থেকে Small Non-coding RNA-দের আলাদা করে শিক্ষানবিশ শামুক-এর স্নায়ুকোষের ভিতর কৃত্রিম উপায়ে প্রবেশ করিয়ে দেখেছিলেন যে একে প্রশিক্ষণ দেবার প্রয়োজন ফুরিয়েছে; কারণ বৈদ্যুতিক শকের মোকাবিলায় শিক্ষানবিশটি প্রশিক্ষিতের মতই সমান ভাবে পারদর্শী হয়ে উঠেছে।
পেটের মধ্যে আজব ইয়ারির কথা জানতে পড়ুন - অন্ত্রবাসী অণুজীব : এমন বন্ধু আর কে আছে! // টিম সিলি পয়েন্ট
কী মশাই, কী ভাবছেন? অরিজিৎ সিং এর স্নায়ুকোষ থেকে Small Non-coding RNA ধার নিয়ে গেয়ে উঠবেন নাকি “তু সফর মেরা, তু হি মেরি মঞ্জিল…”? তবে এই ব্যাপারে আমার উপদেশ হল, গায়ক নয়, কোনো বিজ্ঞানীকে নির্বাচন করুন। সেক্ষেত্রে আপনি হয়ত নিজেই নিজের অভিজ্ঞতা ও স্মৃতিকে কৃত্রিম উপায়ে নিয়ন্ত্রণ ও সংরক্ষণ করতে পারবেন। এমনকি আরও বেশি মজা পাবেন যখন বুঝতে পারবেন যে আপনি চাইলেই কোনো মানসিক অবসাদে বেসুরো জীবন কাটানো মানুষের মন থেকে দুঃস্বপ্নের স্মৃতিগুলো মুছে দিতে পারেন, সেই ক্ষমতা আপনারই হাতের মুঠোয়। এমন দিন হয়তো খুব বেশি দূরে নেই যেদিন এই প্রত্যেকটা সম্ভাবনা বাস্তব হয়ে উঠবে এবং তার জন্য Transgenerational Inheritance রহস্যের পর্দা সম্পূর্ণভাবে ফাঁস হওয়া ভীষণ ভাবে জরুরি। বিজ্ঞান জগতের ফেলুদা, ব্যোমকেশ, কিরীটি এবং শার্লকরা যেভাবে এই বিষয় নিয়ে একজোটে কাজ করছে, আশা করা যায় এটা হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।
কৌতূহলী পাঠকের জন্য:
১। Piwi/PRG-1 argonaute and TGF-β mediate transgenerational learned pathogenic avoidance, Coleen Murphy
২। Could ancestral memories of experiences really be inherited, Pratik Pawar, The Wire
৩। RNA from trained Aplysia can induce an epigenetic engram for long-term sensitization in untrained Aplysia, David Glanzman