Tokyo Digs a Garden : ছবিতে- কথায় কিশোরদের জন্য প্রকৃতিলগ্নতার শিক্ষা
বই : Tokyo Digs a Garden (গ্রাফিক কাহিনি) লেখা : Jon Erik Lappanoইলাসট্রেশন : Kellen Hatanakaপ্রকাশক : Groundwood Books Limited, Canadaপ্রথম প্রকাশ : ১ মার্চ, ২০১৬
মনে পড়ছে আমার এক গাছপাগল বন্ধুর কথা। সে নানারকম বৈপ্লবিক চিন্তাভাবনা করত। প্ল্যান করত কীভাবে বহুতল হাইরাইজ আর কর্পোরেট অফিসগুলোয় কোনও গোপন জায়গা খুঁজে সে লাগিয়ে দেবে বট বা অশ্বত্থের চারা। সবার চোখের আড়ালে সেই চারা বেড়ে উঠবে, কেউ টের পাবার আগেই একটু একটু করে ফাটিয়ে দেবে ইমারতের আস্ফালন। আমরা ঠাট্টা করতাম চন্দ্রাহত বলে।
জন এরিক লাপানোর সঙ্গে আমার সেই বন্ধুটির আলাপ নেই। বাঙালি বিশ্বকবির নগরের বদলে অরণ্য ফিরে পাবার আকুতিও লাপানোর কানে আসেনি বলেই মনে হয়। তবে Tokyo Digs a Garden বইটা পড়ে ফেলার পর এই দুটোই বিশ্বাস করা কঠিন। কানাডার তরুণ লেখক লাপানো জানিয়েছেন, টরন্টো শহরে তাঁর সহকর্মী এক ডিজাইনার জাপানি কায়দায় বৃক্ষরোপণ করতেন। তাঁর এই নেশা দেখেই লাপানোর মাথায় এ বইয়ের মূল ভাবনাটা জাঁকিয়ে বসে।
মাত্র ৩২ পাতার গ্রাফিক কাহিনিটি কিশোরদের জন্য লেখা। ছবিতে লাপানোর ভাবনাকে সঙ্গত করেছেন কানাডার নামকরা গ্রাফিক শিল্পী কেলেন হাতানাকা। ২০১৬ সালে বইটি প্রকাশিত হওয়ামাত্র জনপ্রিয়তা পায়। সে বছর গভর্নর জেনারেলের কিশোর সাহিত্য পুরস্কার পায় বইটি। অতি সহজ সরল ইউটোপিয়ান (কর্পোরেটদের কাছে ডিসটোপিয়ান মনে হবে) এক কাহিনিসূত্র। কিন্তু চিন্তাশীল পাঠক আশ্চর্য নান্দনিক এক নাশকতার মুখোমুখি হয়ে যেতে পারেন আচমকা।
আসলে শ্রেষ্ঠ শিশু-কিশোর সাহিত্য নিজের বুকে যত্ন করে আগলে রাখে এক তীব্র অন্তর্ঘাত। যে কারণে পৃথিবীর সমস্ত প্রথম সারির শিশু- কিশোর সাহিত্য প্রবলভাবে বড়দেরও বটে। আমাদের বাংলা সাহিত্যেই তো সুকুমার রায়, লীলা মজুমদার, শিবরাম চক্রবর্তী, মতি নন্দীর মতো উদাহরণ রয়েছেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় এখনও প্রতি বছর পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় একটি করে কিশোর উপন্যাস উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর অবিশ্বাস্য কলমের জোরে আমাদের মাঝে মাঝে খেয়ালই থাকে না যে টিনটিন বা অ্যাসটেরিক্স আদৌ বাঙালি নয়। যাই হোক, এই সবকিছুই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ছোটদের লেখাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি করে বড়দের লেখা হয়ে ওঠার ক্ষমতা রাখে। লাপানোর ভাবনা আর হাতানাকার রেখায় গড়ে ওঠা টোকিওর গল্পও তাই।
ছোট্ট ছেলে টোকিও যে শহরে থাকে সেখানে শুধুই উঁচু উঁচু বিল্ডিং আর চওড়া হাইওয়ে। আকাশ দেখা যায় না। পরিবারের লোকজন আর কেভিন নামের পোষ্যকে নিয়ে টোকিও যে বাড়িটায় থাকে, এককালে তার চারপাশে প্রচুর গাছপালা ছিল। অনতিদূরে ছিল একসার ছোট টিলা, নদী, ইতস্তত ছোট ছোট ঘাসজমি। এখন সবই অতীত। একদিন টোকিওর সঙ্গে আচমকা দেখা হয়ে যায় এক মায়াবিনী বুড়ির। বুড়ি টোকিওর হাতে তুলে দেয় তিনটে বীজ। বলে, এখান থেকে তোমার যা ইচ্ছা, তাই জন্মাবে। টোকিও মনে মনে চেয়ে ফেলে প্রাগৈতিহাসিক এক দুনিয়া, যেখানে আদি প্রাণেরই নিরঙ্কুশ রাজত্ব। দাদুর সাহায্য নিয়ে টোকিও বাড়ির সামনে ফুটপাথের ইট তুলে তার নীচে পুঁতে দেয় বীজগুলো।
পরেরদিনই দেখা গেল ম্যাজিক। টোকিও দেখল, রাতারাতি গোটা শহর জুড়ে ঘন জঙ্গল গজিয়ে উঠেছে। এমনকি ইমারতের উদ্ধত শিখরেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে গেছে ইয়া বড় বড় গাছ। ফিরে এসেছে ভিটেমাটি হারানো জীবজন্তু পশুপাখিরা। গাছে গাছে ডিঙ মেরে মেরে চলে যাচ্ছে দুর্বিনীত রামভক্তের দল। গাড়ি চলার রাস্তা দখল করে নিয়েছে লতাপাতা আর শ্বাপদের ঝাঁক। হাইওয়ে ভেঙেচুরে নদী হয়ে গেছে। সভ্যতাকে আক্ষরিক অর্থে গিলে নিয়েছে আদিম জগত।
এই পর্যন্ত অসাধারণ কিছু বলে মনে হবে না। আসল বাজিমাত হয়েছে গল্পের শেষটায়। চিন্তিত দাদু যখন বলেন, “এবারে আমরা কী করব?” তার উত্তরে টোকিও জানায়, “We will just have to get used to it…”
মানিয়ে নিতে হবে। যেমন সবেতেই মানিয়ে নিই। এর চেয়ে অমোঘ কথা আর কী হতে পারে। আধুনিক মানুষের অনিবার্য নিয়তি তো ওই একটিই। বয়েলিং ফ্রগ সিনড্রোম। আনন্দ চেপে রেখে যথাসম্ভব গম্ভীর সেজে টোকিও যেভাবে এই কথাটা বলে, সেটাকে দূরবীনের উল্টো দিক থেকে দেখলে আমাদের চোখে পড়বে সিসিফাসের দীর্ঘশ্বাস। এরপরেও কার সাধ্য একে 'ছোটদের বই' বলে?
হোক না একেবারেই গালগল্প, কিশোরদের জন্য লেখা ইকো - ফিকশনের ধারায় এত অসামান্য অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন লেখা আর খুব বেশি পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। আধুনিক সমাজ- মনস্তাত্ত্বিক গবেষণা এ কথা স্বীকার করে যে ছোটবেলা থেকেই প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সংযোগ মানুষের শারীরিক মানসিক স্বাস্থ্যের স্বার্থে অপরিহার্য। আমাদের অলক্ষ্যে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের ন্যায্য অধিকারের তালিকা থেকে খেলার মাঠ, গাছগাছালি, পুকুরপাড়। হারিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পাখি, কাঠবিড়ালি, ভোঁদড়, ভামের মতো প্রতিবেশিরাও। এই সময় দাঁড়িয়ে হাতে হাতে ইস্তেহারের মতো ছড়িয়ে দেওয়া উচিত ‘Tokyo Digs a Garden’-এর মতো বই।
তবে আমরা তো আজও ক্ষতিটাকে ক্ষতি হিসেবে দেখতেই পাই না। লড়াইটাকে লড়াই হিসেবে স্বীকার করা তো অনেক পরের কথা। বইটি প্রসঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লাপানো বলছিলেন, "মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে তাঁর কৃতকর্মের দায় নিতে।"
এগিয়ে তো আসতে হবেই। নাহলে প্রকৃতি নিজেই এগিয়ে আসবে। আর প্রকৃতি এগিয়ে এলে কী হয়, কোভিড - উত্তর পৃথিবীর মানুষকে সে কথা বোঝাতে বেশি বেগ পেতে হবে না আশা করি।
#বই #বই রিভিউ #রিভিউ #কিশোর সাহিত্য #গ্রাফিক নভেল