নিবন্ধ

‘ইষ্টিরস’-এর দাপট

নির্মাল্য কুমার ঘোষ July 26, 2020 at 5:07 am নিবন্ধ

৺ওরা থাকে ওপারে (তৃতীয় পর্ব)




উনিশ শতকের আগে, এমনকী তার পরেও, গ্রামবাংলার সংস্কৃতিতে আকস্মিক পাগলামিকে মূলত ভূতে-ভর-করার প্রমাণ হিসেবেই দেখার একটা চল ছিল। মনে করুন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত গল্প ‘হলুদপোড়া’ -- “ঠিক একুশ দিন গাঁয়ে বাস করার পর নবীনের স্ত্রী দামিনী সন্ধ্যাবেলা লণ্ঠন হাতে রান্নাঘর থেকে উঠান পার হয়ে শোবার ঘরে যাচ্ছে, কোথা থেকে অতি মৃদু একটু দমকা বাতাস বাড়ীর পুব কোণের তেঁতুল গাছের পাতাকে নাড়া দিয়ে তার গায়ে এসে লাগল। দামিনীর হাতের লণ্ঠন ছিটকে গিয়ে পড়ল দক্ষিণের ঘরের দাওয়ায়, উঠানে আছড়ে পড়ে হাত পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে দামিনীর দাঁতে দাঁত লেগে গেল। দালানের আনাচে কানাচে ঝোড়ো হাওয়া যেমন গুমরে গুমরে কাঁদে‚ দামিনী আওয়াজ করতে লাগল সেই রকম।” দামিনীর এই হালত দেখে গাঁয়ের লোকে কি ডাক্তার ডাকল? উঁহু! -- “বুড়ো পঙ্কজ ঘোষাল... বললেন, ‘ডাক্তার ? ডাক্তার কি হবে ? তুমি আমার কথা শোন বাবা নবীন, কুঞ্জকে অবিলম্বে ডেকে পাঠাও।’...নবীন আমতা আমতা করে বলল, ‘এসব খাপছাড়া অসুখে ওদের চিকিৎসাই ভাল ফল দেয় ভাই।’... কুঞ্জই আগে এল। লোক পৌঁছবার আগেই সে খবর পেয়েছিল। চক্ৰবৰ্ত্তীদের বৌকে অন্ধকারের অশরীরী শক্তি আয়ত্ত করেছে। কুঞ্জ নামকরা গুণী।” সাগরপারের লালমুখোরা এসে ঘা দিল এই ধারণায়! পাঞ্জাব মেন্টাল হসপিটালের সুপারিন্টেন্ডেন্ট মেজর সি জে লজপ্যাচ ১৯৩১-এ লেখেন -- “ভারতীয়রা তাদের অজ্ঞতার কারণে জানেই না যে পাগলামি একটা রোগ এবং সেটা চিকিৎসায় সেরে যায় এবং তাকে প্রতিরোধও করা সম্ভব। বংশপরম্পরায় এই বিশ্বাস চলে আসছে যে পাগলামির কারণ ক্ষতিকারক বা ক্ষতিহীন আত্মার ‘ভর’ হওয়া। আর সেইজন্যই এটা প্রতিরোধ করা যায় না এবং গুনিনের ঝাড়ফুঁক ছাড়া অন্য কোনও চিকিৎসাও অসম্ভব।” ১৮৯১ সালে ভারতীয় মেডিকেল গেজেটে এক সুস্থ রোগীর জবানবন্দিতেও শুনি -- “আমার মনে হয় আমার উপর অপদেবতা ভর করেছিল।” পাশ্চাত্য চিকিৎসাবিজ্ঞান, বিশেষত মনশ্চিকিৎসার পাল্লায় পড়ে, উনিশ শতকের মাঝবয়স থেকে, অন্তত নাগরিক শিক্ষিত ভারতীয় তথা বাঙালির মন-মানসিকতায় এ-বিষয়ে কিছুটা পরিবর্তন আসতে শুরু করল।


ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে মনশ্চিকিৎসার প্রসার শুরু হয় উনিশ শতকের প্রথমার্ধ থেকেই। ১৮১৭-তেই ইউরোপীয়দের জন্য কলকাতায় তৈরি হয় পাগলাগারদ। দেশি লোকেদেরও ঠাঁই মেলে রসাপাগলায়। ১৮৫৮ সালে ‘অ্যাক্ট ৩৬’ নামে পাগলামি-বিষয়ক আইন বলবৎ হয়! ১২.৮৩ শতাংশ রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সংবাদও আমরা পাই। ফলে ১৮৭১-এর ‘বিষবৃক্ষ’ উপন্যাসে দেবেন্দ্রর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হীরার মধ্যে যখন এইসব লক্ষণ দেখা গেল -- “হীরা এখন কখনও কখনও একা হাসে -- একা কাঁদে, কখনও বা ঘরে দ্বার দিয়া নাচে। কখনও চীৎকার করে। কখনও মূর্চ্ছা যায়।” তখন, হীরার আয়ি কিন্তু গুনিনের দ্বারস্থ না হয়ে, সোজা চলে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার বলে দিল -- “তোর নাতিনীর হিষ্টীরিয়া হইয়াছে।” সেই রোগ সারাবার জন্য ডাক্তার দিলে ‘কাষ্টর-অয়েল’। হীরার আয়ি বুঝল -- “হীরের ইষ্টিরস হয়েছে, তাই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, সে একটু কেষ্টরস দিয়াছে।” হীরার আয়ির সঙ্গে সঙ্গে উনিশ শতকের বাঙালি পাঠককুলও জেনে গেল, পাগলামি কোন অপদেবতার বায়ু-স্পর্শে ঘটে না, ওটা আসলে ‘হিস্টিরিয়া’ । এ-হেন পরিস্থিতিতেই ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় স্বভাবসিদ্ধ পরিহাসের সুরে লেখেন -- “এই হতভাগা দেশের লোকগুলো এমনই ইংরেজি ভাবাপন্ন হইয়াছে যে, কাহাকেও ভূতে পাইলে কি ডাইনে খাইলে, বলে কিনা হিস্টিরিয়া হইয়াছে।” বোঝা যায়, পাগলামি-সংক্রান্ত ধারণা, প্রাক্-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশে যা শুধুই প্রেত-বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল, তার থেকে মুক্ত হয়ে উপনিবেশে তা রূপ নিচ্ছিল মানসিক ব্যারামের।



না! তা বলে এ’সব ‘ভূতে ভর হওয়া’-র সবকিছুই কিন্তু শেষপর্যন্ত মনশ্চিকিৎসার আওতায় গিয়ে পড়ল, এমন ভাবলে ভুলই হবে। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় পাঁজি-সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধে দেখান, কেমন ছিল স্বাধীনতার পরে ষাটের দশকে বাংলা পাঁজিতে ছাপা ধন্বন্তরি ঔষধের বিজ্ঞাপন -- “শ্বেত বা রক্ত প্রদর, হিস্টিরিয়া বা মৃগীনাশক, বন্ধ্যারও সন্তানপ্রাপ্তি, ভূত, প্রেত, পিশাচ হইতে রক্ষা, মৃতাবৎসার দীর্ঘজীবন পুত্রলাভ ও গর্ভিনীর সুপ্রসব হয়।” কী ধন্বন্তরি ওষুধ দেখেছেন! সাক্ষাৎ প্রোফেসর শঙ্কুর মিরাকিউরল! কিন্তু না, ওষুধ নয়, আমাদের লক্ষ্য রোগের নামগুলো। খেয়াল করে দেখুন, ভূত-প্রেত-পিশাচও আছে, আবার পাশাপাশি ‘হিস্টিরিয়া’-ও আছে। ভূতে-ভর-হওয়া মানেই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত হওয়া -- উপনিবেশের গোড়ার দিকের এই কড়া যুক্তিবাদ তার মানে বাঙালি পুরোটা গেলেনি! ভাগ্যিস! বাংলা ভূতের গল্পের আড়ালে মানসিক আধি-ব্যাধির কথা তো তাই রইলই; রবীন্দ্রনাথের ‘নিশীথে’ থেকে হালের নাবিল মুহতাসিমের ‘শ্বাপদ সনে’ ইস্তক তারই প্রমাণ। কিন্তু পাশাপাশি বহাল-তবিয়তে রইল, অন্যরকম সত্যি ভূতের কথাও, যাদের তাড়াবার জন্য দরকার পড়ে জাঁদরেল সব গুনিনের! ফলে বিভূতিভূষণের তারানাথ তান্ত্রিক থেকে এই সময়ের সৌমিক দের “কালীগুণীন” -- এঁরাও কিন্তু করে-কম্মেই খাচ্ছে। ‘ইষ্টিরস’-এর দাপটে অন্তত নষ্ট হয়নি বাঙালি ভূতের কষ্টার্জিত সম্মান!

#নিবন্ধ #নিবন্ধ সিরিজ #ওরা থাকে ওপারে #নির্মাল্য কুমার ঘোষ

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

95

Unique Visitors

184826