ভোজনের ‘গুরু’-ত্ব
অনেকদিন আগে মাসিক শুকতারার পাতায় একটা গল্প বেরিয়েছিল। এক ডাকাত জমিদারের গল্প। বঁড়শে নামে একখানা গ্রামে তার জমিদারি। কিন্তু খাওয়ার খরচ মেটাতে গিয়ে টান পড়ে যায় জমিদারির খাজনায়। রাজস্ব বাকি পড়ে, নবাবের পেয়াদা ধরে নিয়ে গিয়ে নজরবন্দি করে রাখে। সেকালের নবাব, ফলে বন্দি থাকলেও দুবেলা পোলাও-কালিয়া জোটে। কিন্তু পরিমাণ তো বঁড়শের মতো হয় না। এদিকে চোখের সামনে ঘুরে বেড়ায় নবাবের পনেরো সেরী আর আধমনি দুটো খাসি। লোভ সামলাতে না পেরে পনেরো সেরীটিকে এক রাতে গলাধঃকরণ করে বসে জমিদার বাঁশি রায়। নবাবের কানে যেতে দেরি হয় না। পরদিনই শাস্তি বরাদ্দ হয়, আধমনি খাসিটাকে একলা শেষ করতে হবে। বাঁশি রায় কৃতজ্ঞতায় নবাবকে প্রায় জড়িয়েই ধরে আর কি! ব্রহ্মহত্যা হয়ে গেল কি না ভেবে নবাব যখন ভয়ে ঘেমে উঠেছেন, তখন চেটেপুটে ভোজের শেষে বাঁশি রায় এসে বলে, পেটটা ঠিক ভরল না! এই পেট নিত্য ভরাতে গিয়েই যে আর রাজস্ব দেওয়া হয় না, হাতেনাতে তার প্রমাণ পেয়ে চিরদিনের মতো বঁড়শের খাজনা মাপ করে দেন নবাব।
কী মনে হচ্ছে? নিছক গল্পকথা? তাহলে ইতিহাসে ফেরা যাক। ‘মধ্যযুগের বাঙ্গালা’ বইতে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় জানাচ্ছেন— “নবাবী আমলে বড়িশা-বেহালার সাবর্ণ চৌধুরী জমিদার রাজস্ব বাকির দায়ে বন্দিভূত হইয়া গোটা একটা খাসি রাঁধিয়া একাকী নিঃশেষ করায় খাজনা বাকি রেহাই পাইয়াছিলেন।” অর্থাৎ, যা রটে, তার কিছুটা তো বটে! শোনা যায় রামমোহন রায়ও নাকি একাসনে একটা আস্ত পাঁঠা শেষ করার ক্ষমতা রাখতেন। অতিভোজন সেকালে নিন্দার্হ ছিল না, বরং অমানুষিক ভোজনক্ষমতার অধিকারীরা রীতিমতো সম্ভ্রম আদায় করে নিতেন নিমন্ত্রণবাড়িতে। কালীপ্রসন্ন লিখেছেন, “এক বক্স আলী মিঞা ‘পাকি ৮ সের পোলাও কালিয়া’ স্বচ্ছন্দে ভক্ষণ করায় তাঁহার তৈলচিত্র প্রস্তুত হইয়াছিল— উহা এখনও নিজামৎ প্রাসাদে সযত্নে রক্ষিত।” একাধিক ‘মুনকে রঘু’, ‘আধমনি কৈলেস’-এর খবর জানা যায়, যাঁরা এক মন কি আধ মন আহার্য উদরসাৎ করার ক্ষমতা নিয়ে যে-কোনো অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির আসনটি জাঁকিয়ে বসতেন। তাঁদের অনেকে আবার উপরি পেতেন বকশিশ। কেমন করে? ‘যাচন’-এর দৌলতে। ভরপেট খাওয়ার পর বাড়ির কর্তা উপস্থিত হতেন সন্দেশের বারকোশ সহ। আবার গন্ডা দুয়েক সন্দেশ পেটে যাওয়ার পর শুরু হত ‘যাচন’। যিনি আরও চারটে সন্দেশ খেতে পারবেন তাঁর ভাগ্যে জুটবে দু টাকা, আর দুটো খেলে চার টাকা, আরও একটা খেলে চার টাকা... এমন করে রিলে রেস চলত। অরুণ নাগ হাজির করেছেন এক প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য, “এই যাচনে অনেকে দশবার টাকা রোজগার করতেন।... বাড়ীর কর্তা নিজে দাঁড়িয়ে হাতে গোছা গোছা টাকা নিয়ে এই যাচন করাতেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ঝনাৎ ঝনাৎ টাকা দিয়ে দিতেন।”
নজরে থাকুক
রসিয়ে কষিয়েঃ প্রথম পর্ব
‘যাচন’ শব্দটি শুনলে ‘যাচাই’-এর কথা মনে পড়বেই। হাল আমলের মতো ভদ্রতা আর স্বাস্থ্যরক্ষা করে চলা ‘যাচাই’ কিন্তু সেকালে পাত্তা পেত না মোটেও। শোনা যায় আদর্শ ‘যাচাই’ নিয়ে একটি শ্লোক আওড়াতেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর, “হাঁ হাঁ দেয়ং, হুঁ হুঁ দেয়ং, দেয়ঞ্চ করকম্পনে। শিরশ্চালনে দেয়ং, ন দেয়ং ব্যাঘ্রঝম্পনে।” অর্থাৎ নিমন্ত্রিত হাঁ হাঁ করে উঠুন বা উঁহুঁ উঁহুঁ করে বারণ করুন, পরিবেশকের নিজের কর্তব্য ভুললে চলবে না। হাত বা মাথা নেড়ে আপত্তি করলেও সেসব উপেক্ষা করতে হবে। কেবল বাঘের শিকার ধরার মতো পাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে তবেই পরিবেশককে নিবৃত্ত করা সম্ভব।
পরিবেশকের এহেন খাওয়ানোর আগ্রহ যে মাঝে মাঝে বিপত্তিরও জন্ম দেয়, ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সে কথা বলে যাননি। কিন্তু বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সে অভিজ্ঞতা হয়েছিল। বিভূতিভূষণ যে খাদ্যরসিক ছিলেন, তাঁর লেখায় মাঝে মাঝেই তার প্রমাণ মেলে। তাঁর ‘ইছামতী’ উপন্যাসে হলা পেকে খোকার অন্নপ্রাশনে ভোজনপর্ব সমাধা করে দু কাঠা চালের ভাত, দু হাঁড়ি কলাইয়ের ডাল, এক হাঁড়ি পায়েস, আঠেরো গন্ডা নারকেলের নাড়ু, এক খোরা অম্বলের পর দু ঘটি জল খেয়ে। ডালের এহেন কদর দেখে চমকে যাওয়ার কারণ নেই, পূর্ববঙ্গে তখন ডালের দাম মাছের চেয়েও বেশি। সেদিন ব্রাহ্মণভোজনের সময় প্রতিযোগিতা হয়েছিল কলাইয়ের ডাল কিংবা মাছ খাওয়া নিয়ে। শরৎচন্দ্রের ‘পল্লীসমাজ’-এ ব্রাহ্মণদের মধ্যে মিষ্টি নিয়ে কাড়াকাড়ির কথাও এই প্রসঙ্গে মনে পড়া আশ্চর্য নয়। কিন্তু এসব তো বইয়ের গল্প। অতিরিক্ত খাওয়ার দরুন বাস্তবে বিভূতিভূষণ কেমন বিপাকে পড়েছিলেন, সে কথা জানিয়েছেন সাগরময় ঘোষ, ‘সম্পাদকের বৈঠকে’-তে। এক শনিবারের আড্ডায় কথা উঠেছিল সাহিত্যিকদের খাওয়াদাওয়া নিয়ে। সেখানে যাকে বলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সবার ভোট আদায় করে নেন বিভূতিভূষণ। সেই প্রসঙ্গেই নরেন্দ্রনাথ মিত্র এই বিপত্তির গল্প শোনাতে ছাড়েননি। মেদিনীপুরে এক সাহিত্যসভায় সভাপতি হয়ে গিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ। স্টেশনে নেমেই তাঁর প্রথম প্রশ্ন দ্বিপ্রাহরিক আহারের বন্দোবস্ত সম্পর্কে। এখানেই শেষ নয়, খেতে খেতেই ফরমাশ, পরদিন কাঁকড়া খাওয়াতে হবে। তারপর?
পরদিন দুপুরে এক উকিলের বাড়িতে অতিথি হয়েছেন তাঁরা। অন্যান্য পদের সঙ্গে এক জামবাটি কাঁকড়ার ঝোল।
“অন্যসব তরিতরকারি সরিয়ে রেখে কাঁকড়ার ঝোলের বাটিটা টেনে নিয়ে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনি। বাটিটা নিঃশেষ করে হুঁশ হল আমাদের দিকে তাকাবার।
... ততক্ষণে উকিল-গিন্নী বিভূতিদার নিঃশেষিত বাটিটা আবার কাঁকড়ার ঝোলে ভরে দিলেন। বিভূতিদার দিক থেকে আপত্তির কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
... দ্বিতীয় বাটি শেষ করার পর গৃহকর্ত্রী যখন তৃতীয়বার কাঁকড়ার ঝোলে বাটি ভর্তি করবার জন্য এগিয়ে এলেন— বিভূতিদা তখন একটা কাঁকড়ার আস্ত খোল মুখে পুরে চিবোতে চিবোতে মৃদুস্বরে বললেন— ‘আমায় আর কেন।’ অগত্যা আবার বাটি ভর্তি হল, বিভূতিদা নিশ্চিন্ত মনে কাঁকড়া চিবোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।”
মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়নি, বলাই বাহুল্য। তিনদিন বিছানা থেকে উঠতে পারেননি বিভূতিভূষণ।
সাহিত্যিকদের গুরুভোজনের প্রসঙ্গে ‘সম্পাদকের বৈঠকে’-র আরও একটা গল্প না বলে উপায় নেই। এ গল্পের চরিত্র ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক জলধর সেন। ব্যক্তিগত প্রয়োজনে তিনি একবার লালগোলার রাজা যোগেন্দ্রনারায়ণ রায়ের অতিথি হয়েছিলেন। লালগোলায় পৌঁছে বিপুল জলযোগের পর যখন জানতে চাওয়া হল রাতে তিনি কী খেতে চান, জলধর সেন সবিনয়ে জানান, “বিশেষ কিছু করবেন না— খান কুড়ি খাঁটি গব্যঘৃতে ভাজা লুচি, তার সঙ্গে কিছু মাংস। ভাজাভুজি দু-চার রকম করলেও করতে পারেন। আলু-ফুলকপি দিয়ে একটা নিরামিষ তরকারি। এখানকার গলদা চিংড়ি শুনেছি খুব ভাল। চিংড়ির একটা কালিয়া গরম গরম লুচি দিয়ে মন্দ লাগবে না, তার সঙ্গে মুখ মারবার জন্যে আনারসের চাটনি থাকলেও থাকতে পারে। সবশেষে একবাটি ঘন দুধ, ক্ষীর বললেও বলতে পারেন। খাওয়ার শেষে একটা কিছু মিষ্টি খাওয়া আমার বহুদিনের বদভ্যাস। সঙ্গে মর্তমান কলা একটা দিলেও দিতে পারেন। কিন্তু আমার বিশেষ অনুরোধ বেশী কিছু আয়োজন করবেন না। দেখতেই তো পাচ্ছেন— বয়স হয়েছে, তাই রাত্রির খাওয়া একেবারে কমিয়ে দিয়েছি।”
এ তো গেল নিতান্ত প্রাকৃত মানুষের কথা। বাঙালির ঔদরিকতার পরম্পরা কিন্তু চলে আসছে প্রাচীন কাল থেকেই। আমিষের গন্ধ না থাকলেও, শ্রীক্ষেত্রে সার্বভৌম ভট্টাচার্যের বাড়িতে স্বয়ং চৈতন্যদেবের আহারের নমুনা দেখা যাক। উৎস কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’।
“দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,
মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।
দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী নাফরা,
মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকেরা।
ফুল বড়ি ফল মূলে বিবিধ প্রকার,
বৃদ্ধ কুষ্মাণ্ড বড়ির ব্যঞ্জন অপার।
নব নিম্ব পত্র সহ ভ্রষ্ট বার্তকি,
ফুল বড়ি, পটোল ভাজা কুষ্মাণ্ড মানচাকী।”
এও নাহয় বিশেষ ভোজের আয়োজন। চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে কালকেতুর রোজকার খাওয়াদাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী:
“মুচুড়িয়া গোফ দুটা বাঁন্ধে নিঞা ঘাড়ে
এক শ্বাসে তিন হান্ডি আমানি উজাড়ে।
চারি হাঁড়ি মহাবীর খায় খুদ-জাউ
সুপ ছয় হাঁড়ি তায় মিসাইয়া লাউ।
বুড়ি দুই তিন খায় আলু ওল পোড়া
সারি-কচু ঘণ্টে মিশা করঞ্জা আমড়া।
অম্ল খাইয়া মহাবীর জায়ারে জিজ্ঞাসে
রন্ধন কর্যাছ ভাল আর কিছু আছে।
আনিঞাছি হরিণ দিআ দধি এক জাড়ি
তাহা দিআ খাও বীর ভাত তিন হাঁড়ি।”
আজকের ডায়েট-সচেতন আর জিম-পরায়ণ বাঙালিকে দেখে সেদিনের খাদ্যরসিক বাঙালির আঁচ পাওয়া মুশকিল। যে বাঙালির বেশি কিছু থাক না থাক, দুধ-মাছ-ভাতের অভাব ছিল না। ‘অশনি সংকেত’ উপন্যাসে মতি মুচিনী মারা যাওয়ার দৃশ্যে মনে পড়ে, '...অনাহারে মৃত্যু এই প্রথম, এর আগে কেউ জানত না বা বিশ্বাসও করে নি যে অনাহারে আবার মানুষ মরতে পারে। এত ফল থাকতে গাছে গাছে, নদীর জলে এত মাছ থাকতে, বিশেষ করে এত লোক যেখানে বাস করে গ্রামে ও পাশের গ্রামে, তখন মানুষ কখনো না খেয়ে মরে?' নদীমাতৃক আর শস্যশ্যামল বাংলাদেশের মানুষ বিশ্বযুদ্ধের কালোবাজারে পা রাখার আগে দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় র্যাশনিং-এর কথা ভাবতেও পারেনি। তবে, উদর বিষয়ে এহেন উদারতা সব ক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিতও ছিল না। যে ভোজনক্ষমতা বিয়ের অনুষ্ঠানে কন্যাপক্ষকে অপদস্থ করার কাজে লাগত, তাকে কি আর ‘বিলাস’ বলে উপভোগ করা যায়!
ঋণ: পাকরাজেশ্বরঃ ও ব্যঞ্জনরত্নাকর, সম্পা. শ্রীপান্থ, সুবর্ণরেখা