বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

ট্যাডপোল থেকে ডেডপুল – খোঁড়া ব্যাঙের ঠ্যাং গজানোর ম্যাজিক

সায়নদীপ গুপ্ত Mar 15, 2022 at 4:15 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আপনার বাড়ির সবচাইতে ক্ষমতাবান বাসিন্দাটি কে? বিবাহিত পুরুষমাত্রেই জনান্তিকে স্ত্রী-এর দিকে ইশারা করবেন, স্ত্রী হয়তো ইশারা করবেন তাদের ছানাটির দিকে কিন্তু আসলে এগুলো কোনোটাই ঠিক নয়। ঠিক উত্তর হল, টিকটিকি।

ভেবে দেখুন, এই এক প্রাণী যে বাথরুম অধিকার করে থাকলে আপনি মোটেই স্বস্তিতে থাকেন না। মহিলাকুলের একটা অংশ তো সিরিয়ালের শাশুড়ির থেকে এদেরকেই বেশি ভয় পান। শুধু তাই নয়, টিকটিকি এক অর্থে সুপারহিরোদের সমান। আপনি তাকে লক্ষ করে আঘাত হানলেন, সে দিব্যি নিজের লেজ খসিয়ে চম্পট দিল। ভাবখানা এমন, যেন সান্ত্বনা পুরস্কার দিয়ে গেল! কয়েকদিন বাদে তাকে আবার আপনি খুঁজে পাবেন টবের পিছনে বা জানলার উপরে, দিব্যি লেজ বাগিয়ে বসে আছে। প্রকৃতিতে আরও কিছু সরীসৃপ, উভচর গোত্রের প্রাণীর মধ্যে এই ক্ষমতা দেখা যায় বটে, যেমন ব্যাঙাচি ও স্যালাম্যান্ডার, কিন্তু সুখের বিষয়, তারা আমার-আপনার বাড়িতে এভাবে গেঁড়ে বসে থাকেন না। শত্রুকে বিভ্রান্ত করার এ এক আশ্চর্য কায়দা, পোশাকি নাম অটোটমি (autotomy)। মাঝে মাঝে মনে হয় না, আমাদেরও এমন ডেডপুল-সম ক্ষমতা থাকলে কী ভালোই না হত? দুর্ঘটনায় অঙ্গহানি হলে হাহাকার তো করতে হতই না, বরং চাইলে অপছন্দের নাক বা কান ইচ্ছেমতো ঝেড়ে ফেলে আবার গজিয়ে নেওয়া যেত। 

আকাশকুসুম ভাবনা। নিঃসন্দেহে তাই। প্রকৃতি এমন ক্ষমতা দিয়েছে শুধুমাত্র মনুষ্যেতর প্রাণীদের, প্রতিকূলতার সঙ্গে যুঝতে। এই যে স্যালাম্যান্ডার আর ব্যাঙাচির কথা বললাম, তারা টিকটিকির থেকেও একটু এগিয়ে। শুধু আত্মরক্ষার খাতিরে লেজটুকু খসানো নয়, হাত-পায়ের অংশবিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তারা গজিয়ে ফেলতে পারে। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, ব্যাঙাচি থেকে পূর্ণবয়স্ক ব্যাঙে পরিণত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ক্ষমতাও চিরতরে লোপ পায়। মানুষের মধ্যেও যে এমন ক্ষমতা নেই তা কিন্তু নয়। অবাক হচ্ছেন? জেনে রাখুন, আপনার যকৃৎ বা লিভার নিজে থেকেই পঞ্চাশ শতাংশ অবধি ক্ষয়ক্ষতি সামলে নিজের পুনরুৎপাদন করতে সক্ষম। এর জন্য প্রয়োজন স্টেম কোশ, যা কিনা ভ্রূণ থেকে অঙ্গ বিকশিত করার কায়দাতেই ক্ষতিগ্রস্ত অংশে পুনরুজ্জীবন দান করবে। তবে বাকি অঙ্গে এমনটা হয় না কেন? সেখানে স্টেমকোশ নেই যে; উপরন্তু আছে স্নায়ুতন্তু! স্নায়ুকোশ এমনই বিষম বস্তু, যে প্রায় সর্বকর্ম নিয়ন্ত্রক অথচ একটা বয়সের পরে বিভাজিত হয়ে সংখ্যাবৃদ্ধির ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত। কাজেই কাটা হাত গজাতে গেলে গোটা শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াটার ঘাড় ধরে ঘুরপাক খাওয়াতে হবে। আর ঠিক সেই কাজটাই করে দেখিয়েছেন বিজ্ঞানীরা, খোঁড়া ব্যাঙের শরীরে গজিয়ে দিয়েছেন আস্ত ঠ্যাং! 

গবেষণাগারে জেনোপাস ব্যাঙের কাটা পায়ের পুনরুজ্জীবনের প্রক্রিয়া 

টাফ্টস্‌ বিশ্ববিদ্যালয় আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা মিলে অতি সম্প্রতি এই সাংঘাতিক কান্ডখানা ঘটিয়েছেন। এই কাজে তারা ব্যবহার করেছেন এক পাঁচমিশালি মিশ্রণ – আলাদা আলাদা পাঁচটি ড্রাগের ককটেল। শরীরের কোনও অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সেই জায়গায় জ্বালা-যন্ত্রণা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। চামড়া ক্রমশ মোটা হয়ে ঢেকে ফেলে ক্ষতটুকু আর চারপাশের কিছুটা অঞ্চল জুড়ে কিছুটা কর্মবিরতি ঘোষিত হয়, যাতে শরীর ওই ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার সময় পায়। এই পাঁচমিশালি ড্রাগ ঠিক এই স্বাভাবিক কাজগুলোকেই চাঁদমারি বানিয়ে ধেয়ে গেছে। ক্ষতের প্রদাহ (inflammation) কমানো, ত্বকের কোলাজেন বৃদ্ধি আটকানো থেকে নতুন পেশি, রক্তনালী ও স্নায়ুতন্তুর বৃদ্ধি উসকে দেওয়া – এইসবটুকুই তারা করেছে নিপুণ দক্ষতায়। তবে এ তো আর লোকাল ট্রেনে বিক্রি হওয়া মহৌষধি নয় যে “কাটা অংশে দুই ফোঁটা ঢালিলেই চমক”, তাই বিজ্ঞানীরা এই ওষুধ ব্যবহার করার জন্য এক অভিনব উপায় বের করেছেন। রেশমতন্তু (silk fiber) থেকে মূল প্রোটিন উপাদানগুলো আলাদা করে নিয়ে তাই দিয়ে বানিয়েছেন একধরনের সিলিকন খাপ। সিল্ক প্রোটিনের জালিকার মধ্যে সেখানে আটকে থাকে পাঁচমিশালি ম্যাজিক, আর একবার কাটা অংশে খাপখানা পরিয়ে দিলেই অতি ধীরে ধীরে এক একটি ড্রাগ বেরিয়ে এসে তাদের কেরামতি দেখাতে শুরু করে। এমন খাপের একটা জম্পেশ নামও আছে – বায়োডোম (BioDome)। শুধুমাত্র ওষুধ লেপনের ধাত্র হিসেবেই নয়, বায়োডোমের কাজ আরও গুরুত্বপূর্ণ – কাটা অংশের চারপাশে সে তৈরি করে মাতৃজঠরের মতো অ্যামনিওটিক পরিবেশ! এ এক এমন আশ্চর্য জগত, যেখানে ভ্রূণ থেকে সবরকম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকশিত হয়, গোটা বিবর্তনের সিন্ধু প্রতিফলিত হয় একটি শিশুর বিন্দুতে। নষ্ট হয়ে যাওয়া অঙ্গের পুনরুৎপাদন এবং পুনরুজ্জীবন তো আসলে সেই প্রক্রিয়ারই নামান্তর। বিজ্ঞানীরাও সেই অভিমুখেই এগিয়েছেন। গবেষণার জগতে এই কাজ রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দেওয়ার মতো। সেই দিন হয়তো আর খুব দূরে নেই, পকেটে রেস্ত থাকলে আপনিও অঙ্গহানির দুশ্চিন্তামুক্ত হবেন সহজেই। তবে হ্যাঁ, কাটা অঙ্গের প্লাস্টিক সার্জারির চলতি প্রক্রিয়ার মতো এখানেও সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বায়োডোম বসাতে না পারলে অঙ্গটির ভাগ্যে ডোমের হাতে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

আপাতত বিজ্ঞানীরা ব্যস্ত দুটি কাজ নিয়ে – এক, স্তন্যপায়ীদের ক্ষেত্রেও এমন চিকিৎসা পদ্ধতি কাজ দেয় কিনা তা দেখা এবং দুই, পাঁচমিশালি মিশ্রণটিতে অদল-বদল করে পুনরুজ্জীবিত অঙ্গের আরও উন্নতসাধন করা। পরীক্ষাগারে ব্যবহৃত ব্যাং-বাবাজির দেহে জন্ম নেওয়া এই ঠ্যাংটি স্বাভাবিক কাজকম্মো করতে এবং উত্তেজনায় সাড়া দিতে দিব্যি সক্ষম, তার পেশিকলা, অস্থিকলা সবই মজবুত তবে গঠনে একেবারে জন্মগত পায়ের মতো পরিপূর্ণ নয়। 

ওটুকু খামতি বোধহয় থেকে যাওয়া ভালো। মানুষ প্রকৃতির সমান দক্ষ হলে জীবজগতের কপালে দুঃখ আছে। 

...................................................................................................................................................

তথ্যসূত্র: 

Acute multidrug delivery via a wearable bioreactor facilitates long-term limb regeneration and functional recovery in adult Xenopus laevis, Science Advances, 2022


#সিলি পয়েন্ট #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #সায়নদীপ গুপ্ত #বাংলা পোর্টাল #regenerative medicine #organ regeneration #silly point #science

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

29

Unique Visitors

219143