ফিচার

বিদেশি আমোদে স্বদেশি পুজো

সায়নদীপ গুপ্ত Oct 5, 2021 at 11:14 pm ফিচার

এক হিসেবে, ভারত আর বাংলাদেশ বাদে, বিশ্বের সবকটি মহাদেশ মিলিয়ে প্রায় ছত্রিশখানা দেশে দুর্গাপুজো হয়। বাঙালি যেখানে গেছে, এই একটুকরো কলকাতা নিজের কলজের মধ্যে করে নিয়ে গেছে। শুধু কি তাই? জায়গা বিশেষে অবাঙালিরাই মায়ের পুজোর ধারাটি বজায় রেখেছেন। নিরামিষ দিয়ে নবমী নিশিযাপন বাঙালির শাস্ত্রে অধর্ম কিনা তাই নিয়ে তর্ক হতেই পারে, তবে পুজোর জৌলুসে তাতে ঘাটতি পড়ে না। হলই বা বিদেশের মাটি, শনি-রবি জোড়া কাটাছাঁটা পুজো, তবু ধুনুচি নাচে কিংবা হাতিবাগান-ফেরত শাড়ির বাহারে একে অন্যকে টেক্কা দেওয়ার ধারাটি অব্যাহত। নেহাত সেখানে তুল্যমূল্য বিচার করে সিমেন্ট কোম্পানির শারদ অর্ঘ্য দেওয়ার চল নেই; থাকলে, ম্যানচেস্টার থেকে মিশিগান অবধি দ্বিতীয় ঠান্ডা যুদ্ধ বেধে যেত! ধুনুচি হাতে আমেরিকান পুঙ্গবের নৃত্য অথবা জার্মান ললনার বিস্মিত দৃষ্টি, সবটাই এখন গা-সওয়া। তবে এই যে জৌলুসের টক্কর, এও কিন্তু এক অর্থে তাদেরই অবদান। সাহেবদের পাল্লায় পড়েই বঙ্গভূমের পুজোয় খাজনার চাইতে বিকট বাজনার আয়োজন হত বেশি। ব্যাপারটা তবে খানিক খোলসা করা যাক?

কলকাতার পুজোর ইতিহাস ঘাঁটতে বসলে পিছিয়ে যেতে হবে প্রায় শ-পাঁচেক বছর। আর কলকাতার কথা এলেই সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার বচ্চন-সম উচ্চতায় “হাম যাঁহা পে খাড়ে হোতে হ্যায়...” বলে চলে আসবেন, এক্ষেত্রেও তার অন্যথা নেই! সম্ভবত বড়িশায় তাঁদের পারিবারিক পুজোটিই ১৬০০ সালের আশেপাশে এই উৎসবের গোড়াপত্তন করে। আর মোটামুটি তারও তিনশো বছর পরে ভবানীপুরের সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার তরফে বারোয়ারি পুজো শুরু হয়। মাঝের এই তিন দশক ধরে কলকাতার দুর্গাপুজো পারিবারিক পরিসর থেকে বাবুয়ানির বোলবোলাওয়ের এক আশ্চর্য বিবর্তনের সাক্ষী। এই বিবর্তন গতি পেয়েছিল পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পতনে আর স্তিমিত হয়ে এসেছিল দেশীয় অর্থনীতিতে মন্দা আর দুর্ভিক্ষের প্রভাব বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে। 

পলাশির যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের জয়লাভের ফলে যে বঙ্গসন্তানের প্রভূত সমৃদ্ধি ঘটেছিল, তিনি নবকৃষ্ণ দেব। উত্তর কলকাতার পুজো পরিদর্শনে বেরিয়ে যে সাবেকি পুজোতে সেলফি তোলা বাঙালির অবশ্যকর্তব্য, সেই শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। যুদ্ধের আগে ছিলেন কোম্পানির মুনশি, যুদ্ধের পরে হলেন সুতানুটির তালুকদার। সিরাজের ধনসম্পদের ভাগ তো পেলেনই, উপরন্তু ১৭৬৬ সালে পেলেন নতুন খেতাব – মহারাজ নবকৃষ্ণদেব বাহাদুর। এ হেন জমকালো প্রাপ্তিযোগ যাঁদের দৌলতে, তাঁদের তুষ্ট না করলে কি চলে? ক্লাইভ চাইলেন পলাশি বিজয় উদযাপন করতে, এদিকে কলকাতায় তখন না আছে সেন্ট পল্‌স, না আছে পার্ক স্ট্রিট! মুশকিল আসান হলেন নবকৃষ্ণ, ক্লাইভকে বুদ্ধি দিলেন যিশুপুজোর বদলে দুর্গাপুজোয় নিবেদন জানানোর, ঈশ্বর তো একই! 

ব্যাস, রাতারাতি নিজের রাজবাড়ির ভোল বদলে ফেললেন নবকৃষ্ণ। গড়ে তুললেন উত্তরের ঠাকুরদালান, লাগোয়া নাচঘর। বিদেশি মার্বেল, ঝাড়লন্ঠন, দেওয়ালগিরিতে সেজে উঠল নতুন বসত। একচালার প্রতিমার গায়ে উঠল সোনার গয়না, মাথায় সোনার চাঁপা ও মুকুট, মা সাজলেন জার্মানি থেকে আনা রাংতায়। সপ্তমীর সকালে ফোর্ট উইলিয়াম থেকে স্কটিশ ব্যান্ড এনে কলাবউ স্নান করানো হল। শোনা যায় এই পুজো নাকি মাসাধিক কাল ধরে চলেছিল। স্বয়ং ক্লাইভ সেই পুজোয় একশো-এক টাকা দক্ষিণা দিয়ে অঞ্জলি নিবেদন করেছিলেন, তাঁর মন রাখতে বসেছিল বাইজি নাচের আসর, ছুটেছিল মদের ফোয়ারা। আর এই ঘটনা থেকেই ইংরেজ-অনুগ্রহপ্রার্থী একপ্রকার কর্তাভজা তাঁবেদার সম্প্রদায় জন্ম নিল, যাঁদের হাত ধরে দুর্গাপুজোয় ইংরেজ তথা ফিরিঙ্গিদের প্রবেশ ঘটল আর দেখা দিল লাগামছাড়া ইন্দ্রিয়সুখের উদযাপন। নবকৃষ্ণ দেব ছাড়াও এর পুরোভাগে ছিলেন দর্পনারায়ণ ঠাকুর, রামহরি ঠাকুর, নারায়ণ মিত্র, কেষ্টচাঁদ মিত্র, প্রাণকৃষ্ণ সিংহ প্রমুখরা। এঁদের বাড়ির দুর্গাপুজো হয়ে উঠেছিল সাহেবপুজোর নামান্তর। বিলাসব্যাসনে খামতি তো ছিলই না, বরং কত লক্ষ টাকা যে তাতে খরচ হত তার একটা ধারণা মেলে প্রিন্স সলাটকক নামক এক শিল্পীর তুলিতে। ক্লাইভপুজোর সেই জাঁকজমকে তিনিও ছিলেন অন্যতম আমন্ত্রিত। শোভাবাজারের ঠাকুরদালানে সপরিবারে দুর্গা, দেশি সাজে সুসজ্জিত মহারাজ-যুবরাজ, সাহেব-মেম, বাইজি নাচের আসর – সবকিছুই নিপুণভাবে তিনি তুলে ধরেছেন তাঁর ক্যানভাসে। 


তবে বিদেশিদের চোখে দুর্গাপ্রতিমার সার্বিক বর্ণনা প্রথম মেলে সম্ভবত আঠারো শতকের শেষে এক বেলজিয়ান চিত্রকরের ছবিতে। একচালার প্রতিমায় দশভুজার দুই পাশে শুধু লক্ষ্মী আর সরস্বতী, সামনে ঝুঁকে দুই পুরোহিত পুজোর আয়োজন করছেন। ছবিতে বাহ্যিক আড়ম্বর যেমন নেই, তেমনই নেই দুর্গাপ্রতিমার স্নেহময়ী আদল। তবে এহ বাহ্য, এর আগে জন হলওয়েল সাহেব তাঁর বইতে দুর্গামূর্তির যা বর্ণনা দিয়েছেন, তা পড়লে খানিক ভিরমি খেতে হয় বৈকি! দুর্গা, শিব, তাঁদের ছেলেমেয়ে অবধি ঠিক ছিল, হঠাৎ কোত্থেকে হনুমানের পিঠে চেপে থাকা রামচন্দ্রও জোগাড় করেছেন! ইনিই সেই হলওয়েল, যাঁর লেখা বই থেকে সিরাজদৌল্লার নামে অন্ধকূপ হত্যার মিথ্যে জন্ম নিয়েছিল। তাই তাঁর কলমকে কতখানি ভরসা করা উচিত তা নিয়ে খানিক ধন্দ থেকেই যায়। 

রবার্ট ক্লাইভের পরে আরেক লর্ডের আগমনে শোভাবাজার রাজবাড়ির দুর্গোৎসব অন্য মাত্রা পেয়েছিল। তিনি হলেন উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক। ১৮২৯ সালে রাজা শিবকৃষ্ণ ও কালীকৃষ্ণ দেবের আতিথেয়তায় নবমী নিশিতে সস্ত্রীক বেন্টিঙ্ক পাত্র-মিত্র সমেত পদধূলি দিলেন সেই পুজোতে। তাঁদের সম্মানার্থে চণ্ডীপাঠের আসরে বিলিতি গড়ের বাদ্যিতে বাজানো হল “গড সেভ দ্য কিং”। তবে শুধু কি এক মাঘেই শীত বিদায় নেয়? এ তরফের নিমন্ত্রণ রাখলে, সাড়া দিতে হয় ও তরফের ডাকেও, বিশেষত তা যদি হয় রাজা নবকৃষ্ণের পালিত পুত্র গোপীমোহন দেবের। শোভাবাজার রাজবাড়ির খোঁজে গেলে মুখোমুখি যে আরেক তরফের বাড়ি মেলে, ইনি তার সর্বময় কর্তা। সে বাড়িতে লর্ড বেন্টিঙ্ক মোহিত হলেন বাইজি নাচের রূপরসগন্ধ আস্বাদনে। গোপীমোহনের ছেলে রাধাকান্ত দেব ছিলেন আরও এক কাঠি সরেস। বিলিতি খানা, বিলিতি গীতবাদ্য ও মদের সঙ্গে সঙ্গে তিনি হাজির করেছিলেন পিটার নামের এক বিদেশি সাহেবের ট্র্যাপিজের কারিকুরি! রাজবাড়ির ঠাকুরদালানে সেই দলের জিমন্যাস্টিক কসরত দেখিয়ে তিনি অতিথিদের তাক লাগিয়ে দিলেন। তারপর ফেললেন তুরুপের তাস, দেশি নর্তকীর বদলে মেম বাইজি! কবি ঈশ্বর গুপ্ত ‘দৈনিক প্রভাকর’-এ তীব্র ব্যঙ্গ করে লিখলেন – 

  • “পূজাস্থলে কালীকৃষ্ণ, শিবকৃষ্ণ যথা
  • যিশুকৃষ্ণ নিবেদিত মদ্য কেন তথা?
  • রাখ মতি রাধাকান্ত রাধাকান্ত পদে,
  • দেবীপূজা করি কেন টাকা ছাড় মদে?”

বুঝ জন যে জান সন্ধান!

তবে এসবের মধ্যে উল্টোপুরাণ যে কদাচিৎ শোনা যেত না, তা নয়। এমনই একজনের কথা দিয়ে লেখা শেষ করি। তিনি জন চিপ্‌স, বীরভূমের কুঠিয়াল। থাকতেন অধুনা শান্তিনিকেতনের কাছেই সুরুলে। কোম্পানির ব্যবসা দিব্যি সামাল দিলেও তাঁর নিজের ব্যবসা কিছুতেই জমছে না। শেষটায় দেওয়ানের পরামর্শে করলেন দুর্গাপুজো, সুরুলের সব গ্রামবাসীদের ডেকে ভোজ খাওয়ালেন। তারা তো সাহেবের কাণ্ড দেখে অবাক। সাহেব নিজেও কম অবাক হলেন না যখন পরের বছর থেকে তাঁর ব্যবসা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। সেই থেকে আমৃত্যু সাহেবের কুঠিতে দুর্গাপুজো হয়েছে। জাঁকজমক? প্রতিমা আর পুরোহিতের খরচ সতেরো টাকা, কুঠির সব প্রজাদের অষ্টমীতে পাত পেড়ে খাওয়াতে আর নতুন কাপড় দিতে খরচ তেত্রিশ টাকা। চিপ-ই বটে! 

মায়ের কাছে সন্তানের ভালো চাইতে টাকা ওড়ানোর দরকার পড়ে নাকি? 


************************************** 

ঋণস্বীকার: ১) বাংলার দুর্গোৎসব, নির্মল কর 

২) ফিরিঙ্গিদের চোখে দুর্গাপুজো, শ্যামলকান্তি চক্রবর্তী

৩) সেকাল আর একাল, রাজনারায়ণ বসু 

৪) স্মৃতির পুজো, শ্রীপান্থ

*************************************** 

অলংকরণ: বিদিশা বিশ্বাস 

চিত্র সম্পাদনা: অর্পণ দাস

*************************************** 

#দুর্গাপুজো #কলকাতা #প্রথম পুজো #শোভাবাজার রাজবাড়ি #রবার্ট ক্লাইভ #নবকৃষ্ণ দেব #বারোয়ারি পুজো #ফিরিঙ্গি #বাংলা #সিরাজদৌল্লা #পলাশির যুদ্ধ #ফিচার #সায়নদীপ গুপ্ত #বাংলা পোর্টাল #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #web portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

9

Unique Visitors

214971