সফলতা নিষ্ফলতা : বুদ্ধদেব-জীবনানন্দ সম্পর্কের বাস্তব আখ্যান?
সালটা ১৯৩২। কলকাতার কোন বোর্ডিং-এর ঘরে বসে বছর তেত্রিশের এক বেকার, নিঃসঙ্গ, অন্তর্মুখী কবি খাতার পাতা ভরিয়ে চলেছেন। কী লিখছেন তিনি? স্বভাবতই এর উত্তর হওয়ার কথা ছিল কেবলই কবিতা। কিন্তু কবি ঘাড় গুঁজে চারখানা খাতা জুড়ে লিখে চললেন এক আখ্যান। যা আমৃত্যু নির্বাসিত রইল নির্জনতার অতলে। আজীবনের ‘কবি’ নামকে পেরিয়ে মৃত্যুপরবর্তীকালে যখন নানা মাত্রায় উন্মোচিত হতে থাকল তাঁর ঔপন্যাসিক সত্তা, তখন এক অসীম কৌতূহলে পাঠক গবেষক খুঁজে দেখতে চাইলেন কবির ব্যক্তিজীবনের আনাচকানাচ। কারণ এ কবি তো এক চির ‘দুরতিক্রম্য দূরত্বে’র বাসিন্দা। আর দূরের নাগাল পেতে কৌতূহল হয় বৈকি।
কালের পরিহাসে বিশ্ব তখন এক সর্বক্ষয়ী আর্থিক মন্দার শিকার। আর জীবনের পরিহাসে কবিও কর্মহীন। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত ঝরা পালক কাব্যগ্রন্থকে অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্যভূমিতে পা রাখছেন কবি জীবনানন্দ। আর তার সাথে সাথেই সম্মুখীন হচ্ছেন তীব্র সমালোচনার। যা শুরু হয়েছিল কল্লোল-এ ‘নীলিমা’ প্রকাশের পরই। সাহিত্যিক সমাজে তাঁর প্রতিভা যখন বিরাট প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে, তখনই তিনি পাশে পেলেন তাঁর থেকে এক দশকের ছোটো সমকালীন আর এক কবি বুদ্ধদেব বসুকে। প্রায় বর্মের মতো কবিকে রক্ষা করে গেলেন বুদ্ধদেব। প্রথমে প্রগতি পরে কবিতা পত্রিকায় প্রায় একক কণ্ঠে ঘোষণা করতে থাকলেন জীবনানন্দের অনন্যতা। জীবনানন্দ ১৯৩৬ সালে তাঁর ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ উৎসর্গ করছেন বুদ্ধদেব বসুকে। কারণ বুদ্ধদেবই তো প্রস্তুত করছেন পাণ্ডুলিপি, দেখে দিচ্ছেন প্রুফ। এমনই তো হয় বন্ধুতা। এমনটাই তো হতে পারত। বাংলা সাহিত্যের অন্দরমহলের কথা উঠলেই দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়াত দুই সমকালীন কবির সখ্য।
এমনটাই হত যদি না কবি ভূমেন্দ্র গুহের সম্পাদনায় জীবনানন্দের মৃত্যুর পর তাঁর ‘সফলতা নিষ্ফলতা’ উপন্যাস প্রকাশের আলো পেত। নামহীন এ উপন্যাসে জীবনানন্দ তৈরি করছেন নিখিল ও বাণেশ্বর এই দুই কবিযশোপ্রার্থী যুবকের আভ্যন্তরীণ সম্পর্কের তির্যক সমীকরণ। সম্পাদক ভূমেন্দ্র গুহ-ই এ রচনার নামকরণ করছেন। তাঁর মতে, নিখিল চরিত্রে কবির আপন জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে প্রতি পরতে। সেই সঙ্গে বহু প্রমাণ ও তথ্যাদিসহ পেশ করতে চাইছেন,বাণেশ্বর আসলে বুদ্ধদেবই। যদিও কেতকী কুশারী ডাইসন তাঁর ‘তিসিডোর’ রচনার দীর্ঘ পরিসরে জানাচ্ছেন, বাণেশ্বরকে বুদ্ধদেব বসু বলে প্রোজেক্ট করার ক্ষেত্রে ভূমেন্দ্র গুহের মাত্রাতিরিক্ত জোরারোপ যথোপযুক্ত নয়।
এবার আসা যাক উপন্যাস প্রসঙ্গে। এ উপন্যাসে নিখিল বয়সে বাণেশ্বরের চেয়ে বড়ো। কিন্তু সাহিত্যিক খ্যাতির নিরিখে বাণেশ্বর এগিয়ে। বাণেশ্বর নানারকম বইপত্র লিখে নাম ও যশ উভয়ই করায়ত্ত করেছে ইতিমধ্যে। উপন্যাসে এই বাণেশ্বর সম্পর্কে নিখিল সহৃদয় তো নয়ই, ক্ষেত্রবিশেষে অশোভন। যদিও নিখিল স্বীকার করে একসময় বাণেশ্বরের মতো ডিভোশন নিয়ে তার লেখা কেউ পড়েও দেখে নি। স্বীকার করে, "বাণেশ্বরের মনের ভিতর হিংসা খুব কম"। দীর্ঘ বিবরণে এ-ও জানায় কোন কোন পথে বাণেশ্বর তাকে সাহায্যের চেষ্টা করেছে। তা সত্ত্বেও বাণেশ্বরের প্রতিভা, কেবল প্রতিভা কেন তার জীবনযাত্রা, কর্মোদ্যোগ, সপ্রতিভতা সবকিছুকেই নিখিল এক অন্তর্লীন দাঁড়িপাল্লায় মেপে গেছে গোটা উপন্যাস জুড়ে।
এবার ফেরা যাক জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনে। ১৯৩২ সাল নাগাদ তিনি ডায়রিতে লিখছেন – “An unsuccessful man, a failure, an unemployed kicked; Show the least success and you will be fawned”। ১৯৩০ সালে লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহের পরপরই তিনি দিল্লির রামযশ কলেজের চাকরি হারাচ্ছেন। এরপর দীর্ঘ পাঁচ বছর কবি বেকার। এই সময়ে তাঁর প্রকাশিত কবিতাও মাত্র একটি। পরিচয়-এ 'ক্যাম্পে' প্রকাশের পরেও জুটছে কেবল পাহাড়প্রমাণ বক্রোক্তি। ভাই অশোকানন্দ আবহাওয়া দপ্তরে চাকরি নিচ্ছেন আর কবি কলকাতার বোর্ডিং-এ পালিত হচ্ছেন ভাইয়ের অর্থে। ভুলে গেলে চলবে না উপন্যাসে বেকার নিখিলও কলকাতার বোর্ডিং-এ থেকে কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা চালায়। আর তার সংস্থান সুনিশ্চিত করে অফিস-চাকুরে ভাই।
বেকারত্বের যন্ত্রণা, সাহিত্যিক খ্যাতির নিষ্ফল প্রচেষ্টা জীবনানন্দকে চরম মানসিক শাস্তি দিয়ে গেছে এই গোটা পর্ব জুড়ে। তাঁর কবিতা কেবলই বিরূপ প্রতিক্রিয়া কুড়িয়েছে পাঠক ও সাহিত্যিক মহলে। কেবল অতন্দ্র প্রহরীর মতো বুদ্ধদেবই থেকেছেন তাঁর পাশে, 'শনিবারের চিঠি'-র জবাব দিয়েছেন সোচ্চার কণ্ঠে। ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন ‘বাংলা কবিতার ভবিষ্যৎ’ প্রবন্ধে। সফলতা নিষ্ফলতা জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের কোন ডায়েরি নয়। তা নিঃসন্দেহে সৃজনশীল রচনা। তা সত্ত্বেও ব্যক্তিজীবনের ছায়াপাতকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা যায় না। কেতকী কুশারী ডাইসন মনে করছেন, উপন্যাসে নিখিল ও বাণেশ্বরের সম্পর্কের যে রসায়ন তাতে ‘স্ট্যাটাস অ্যাংজাইটি’ প্রকাশ পায়। গোটা জীবন জুড়ে যে নিরাপত্তাহীনতার বোধ জীবনানন্দকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়িয়েছিল, তা-ই আরোপিত নিখিল চরিত্রে। আর এই বোধের তাড়নাই নিখিলকে বাণেশ্বরের প্রতি অশোভন ঈর্ষায় মাতিয়ে তোলে। কেতকী একে ব্যাখ্যা করছেন মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ য়্যুংয়ের ‘শ্যাডো’ তত্ত্ব দিয়ে। তিনি লিখছেন- "জীবনানন্দের ছায়াসত্তার মধ্যে যতরকমের নঞর্থক অনুভূমি জমে উঠেছিল- অতৃপ্তি, অযাপিত জীবন, অভিমান, ক্রোধ, ঈর্ষা, চেয়ে না পাওয়া, আশাভঙ্গ, অক্ষমতার গ্লানিবোধ- সব যেন তূণ থেকে বাণের মতো একটা একটা করে নামিয়ে তার স্বহস্তে প্রস্তুত কুশপুত্তলিকার দিকে ছুঁড়ে মেরেছেন। আর যাকে সুপরিকল্পিত ভাবে এতগুলো বাণের লক্ষ্য করেছেন,শাণিত বিদ্রুপে তারই নাম রেখেছেন বাণেশ্বর"।
‘কবিতা ছাড়া অন্য সবক্ষেত্রে নিঃশব্দ’-এক কবি চারটি খাতা জুড়ে সশব্দে সোচ্চারে নিজের যা কিছু না পাওয়ার হিসেব মেলে ধরলেন। বাক্সবন্দী করে রেখে গেলেন কোন এক সুহৃদের প্রতি একরাশ অসন্তোষ। এ অসন্তোষ কতটা সমীচীন তার হিসেব করা সহজ নয়। আপাতভাবে জীবনানন্দের এহেন মনোভঙ্গি অসঙ্গতই মনে হতে থাকে। কিন্তু এ কবির অবচেতনে যে জটিল, স্তরান্বিত, ব্যতিক্রমী, অনিশ্চয়তাবোধে আক্রান্ত, একাকীত্বতাড়িত সত্তার বাস, সেদিকে নজর দিলে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করতে বড় মায়া হয়। কারণ কবি তো নিজেই সেই অমোঘ প্রশ্ন রেখে গেছেন- "আমার নিজের মুদ্রাদোষে/আমি একা হতেছি আলাদা?"
#Buddhadeb Basu #বুদ্ধদেব বসু #জীবনানন্দ দাশ #সফলতা নিষ্ফলতা #উপন্যাস #Novel #Relationship #Jibananda Das #বিদিশা বিশ্বাস