বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

গলি থেকে রাজপথ – নোবেলজয়ীর অনন্য সফর

সিদ্ধার্থ মজুমদার Aug 10, 2021 at 2:08 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

এ এক অভাবনীয় যাত্রাপথ ও উত্থানের কাহিনি! উপন্যাস বা সিনেমার গল্পে খোঁজ মেলে এমন জীবনের। শৈশবের পাঁচটা বছরে যার কাছে রাস্তা ছিল উঠোন, খোলা আকাশই যার ছাদ – সে মানুষ কীভাবে শিক্ষা ও সমাজের মূলস্রোতে ফিরে আসতে পারে, হয়ে উঠতে পারে বিজ্ঞানের পোস্টার-বয়, সে বাস্তব কি রূপকথার চাইতে কম কিছু?

১৯৪১-এর যুদ্ধবিধ্বস্ত ইতালির গলিঘুঁজি। সেখানে এক আস্তানা থেকে আরেক আস্তানায় মাথা-গোঁজার ঠাঁই আর দুমুঠো খাওয়ার জন্যে ঘুরে বেড়ানো। কখনও একা, কখনও বা সঙ্গী আরও কিছু অনাথ বাচ্চা। ভিক্ষা করে, বাজার থেকে ফল-পাউরুটি চুরি করে কোনও কোনোদিন একবেলা খাবার জোটে। রাত নামলে ক্লান্ত, অবসন্ন শরীর খুঁজে নেয় ফুটপাথ কিংবা বোমা-বিধ্বস্ত বাড়ির মেঝে। পুলিশের চোখে পড়লে ধরে নিয়ে কখনও অনাথ আশ্রমে, কখনও হাসপাতালে পাঠিয়ে দিয়েছে। সেখানে আরও দুঃসহ অবস্থা; সারা দিনের বরাদ্দ এক কাপ কফি আর এক টুকরো পাউরুটি। অতএব পালিয়ে ফের সেই পথের জীবন। এইভাবে প্রায় সাড়ে চার বছর রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরেছে ছেলেটি। 

ছেলেটির নাম মারিও কাপেক্কি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগে ইতালির ভেরোনায় জন্ম (১৯৩৭)। বাবা লুচিয়ানো কাপেক্কি ছিলেন ইতালি এয়ার ফোর্সের একজন অফিসার, যুদ্ধ শুরুর আগেই তিনি লিবিয়ায় নিখোঁজ হয়ে যান। মা লুসি রাম্বার্গ জন্মসূত্রে আমেরিকান। তিনি ছিলেন একজন মেধাবী কবি, প্যারিসের সোরবোনে সাহিত্য পড়াতেন এবং তখনই বোহেমিয়ান কবিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু চার বছর আগে কী পরিস্থিতি হয়েছিল যার জন্য এমন পরিবার ছেড়ে রাস্তায় এসে পড়তে হল মারিওকে?

আরও পড়ুন: "I died for beauty" - সুন্দরের খোঁজে এক বিস্মৃত গণিতজ্ঞ / সিদ্ধার্থ মজুমদার

বোহেমিয়ান কবি আন্দোলনের অন্যতম অঙ্গ ছিল ফ্যাসিবাদ এবং নাৎসিবাদের বিরোধিতা। নাৎসি বাহিনীর সিক্রেট পুলিস যখন লুসিকে বন্দি করে নিয়ে যাচ্ছিল, মারিওর বয়স তখন সাড়ে চার বছর। এমন ভবিতব্য আন্দাজ করতে পেরেই লুসি আগেভাগে বিষয়-সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়ে এক পারিবারিক বন্ধুর কাছে সব টাকা গচ্ছিত রেখেছিলেন। ফলে লুসি গেলেন কনসেনন্ট্রেশেন ক্যাম্পে আর মারিও-র ঠাঁই হল সেই বন্ধুর ওয়াইন তৈরির ফার্ম হাউসে। তবে সে সুখ বেশিদিনের নয়। বছরখানেক পরে সেই পরিবার আর দায়িত্ব নিতে পারেনি মারিওর। সম্ভবত লুসির গচ্ছিত টাকা শেষ হয়ে গিয়েছিল কিংবা যুদ্ধের বাজারে আশ্রিতর জন্য খরচ করার সম্বল তাদের ছিল না। তাই মারিও বেরিয়ে এল খোলা আকাশের আশ্রয়ে। সেসময় আমেরিকান আর ব্রিটিশ সেনারা দক্ষিণ ইতালি থেকে উত্তরের দিকে এগিয়ে আসছে। কারফিউ ও ব্ল্যাক-আউটের দৈনন্দিন নিষেধাজ্ঞা ভেদ করে মাঝেসাঝে ছুটে আসে এলোপাথাড়ি বুলেট। এমনই এক বুলেট এক রাতে এসে বিঁধল মারিও-র পায়ে। সে ক্ষত তাকে বয়ে বেড়াতে হল আজীবন, এখনও। 

যুদ্ধের শেষে সৌভাগ্যক্রমে নাৎসি বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত হল লুসি। প্রায় বছরখানেক হন্যে হয়ে খোঁজ করার পরে ছেলের সঙ্গে দেখা হল মায়ের। সারি-সারি অসুস্থ, অনাথ রোগীদের শয্যার মাঝে মারিও-র সঙ্গে তার মায়ের যেদিন দেখা হচ্ছে সেদিনটি ছিল মারিওর ন-বছরের জন্মদিন। জ্বর আর অপুষ্টিজনিত দুর্বলতায় শরীর তখন এতটাই কাবু যে একবছর হতে চলল, কিন্তু অন্যান্যবারের মতো হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাওয়ার জোরটুকুও নেই। রাস্তায় অচৈতন্য হয়ে পড়েছিল, নেহাত কোনও এক সহৃদয় ব্যক্তি হাসপাতাল অবধি পৌঁছে দিয়ে গেছিলেন, তাই এই যাত্রায় রক্ষে! একটু সুস্থ হলে ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে করে রোম এলেন লুসি। ছেলের পরিচর্যায় সঁপে দিলেন নিজেকে। মারিওর এক কাকা পদার্থবিদ, আমেরিকায় থাকতেন। তাঁর অর্থসাহায্য সম্বল করে ছেলেকে নিয়ে আমেরিকা পাড়ি দিলেন। এত বছরের বন্দি জীবনের অত্যাচারে শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি নিজেও। তাই সেখানে মারিওর দায়িত্ব নিলেন কাকা ও কাকিমা। কোয়েকার কমিউন স্কুলে ভর্তি করা হল মারিওকে। 

শুরুটা খুবই কঠিন ছিল। ন-বছর বয়সে প্রথম স্কুলের সঙ্গে পরিচয়; না জানে সে ইংরেজি বলতে বা লিখতে, না আছে সামাজিক শিষ্টাচারের ন্যূনতম ধারণা। তাছাড়া অত কম সময়ের মধ্যে যুদ্ধকালীন ইতালির ভয়াবহতার থেকে বেরিয়ে আসাও সহজ  ছিল না। বহু রাত্রি ঘুমের ঘোরে ছটফট করে মারিও। যন্ত্রণায় কাৎরাতে থাকে বিছানায় শুয়ে, আতংকে চিৎকার করে ওঠে। তবু কাকা-কাকিমার সাহচর্যে সে বাধাও অতিক্রান্ত হল এক সময়।

কেমিস্ট্রি ও ফিজিক্স নিয়ে স্নাতক হয়ে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে বায়োফিজিক্সে পিএইচডি করলেন মারিও। সেখানে তিনি ডিএনএ-র আণবিক গঠনের আবিষ্কারক নোবেলজয়ী জেমস ওয়াটসনের গবেষণাগারে কাজ করার সুযোগ পেলেন। পরে হার্ভার্ড ছেড়ে কাজে যোগ দেন ইউটা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ‘জিন টার্গেটিং’ এর কাজে সম্ভাব্য সাফল্য সম্পর্কে কাপেক্কির যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল। তাই নিয়ে গবেষণা করার জন্যে ১৯৮০ সালে প্রোজেক্ট লিখে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকান সরকারি প্রতিষ্ঠান ‘ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অফ হেলথ’-এ (এনআইএইচ)। অথচ এনআইএইচ-এর রিভিউয়ার কমিটি জানিয়ে দেন যে ‘একাজ গবেষণার যোগ্য নয়’। আশাহত কাপেক্কি হাল ছাড়লেন না, অন্য প্রোজেক্টের টাকা থেকে তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে গেলেন।

আরও পড়ুন : নক্ষত্রপুঞ্জের বিভা হয়ে আছেন প্রথম ভারতীয় মহিলা পদার্থবিদ / অনিন্দ্য পাল

সেই মারিয়া কাপেক্কিকে আজ সকলে চেনে একজন কীর্তিমান জিন গবেষক হিসেবে। ১৯৮৯ সালে প্রথমবার প্রাণীদেহের জিন প্রয়োজনমাফিক নিষ্ক্রিয় বা পরিবর্তিত করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে ইঁদুরের দশ হাজার বিভিন্নপ্রকার জিন কাটাছেঁড়া করে পরীক্ষানিরীক্ষা চালান। ‘নক্‌ড-আউট মাউস’ তথা ‘জিন টার্গেটিং’ ক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ। ‘নক্‌ড-আউট মাউস’ জেনেটিক রিসার্চে মডেল হিসেবে দারুণ গুরুত্বপূর্ণ। ইঁদুরের দেহকোশের এক বা একাধিক নির্দিষ্ট কার্যকরী জিনকে নিষ্ক্রিয় বা পরিবর্তিত করে (নক্‌ড আউট) এই মডেল তৈরি করা হয়ে থাকে। এইভাবে সৃষ্ট ‘জিন-নিষ্ক্রিয়’ করা ইঁদুর নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা বিশেষ-বিশেষ জিনের কার্যকারিতা সম্পর্কে জানতে পারেন। এছাড়া ‘নক্‌ড-আউট’ ইঁদুরে এমন কিছু রোগ তৈরি করা হয়, যে রোগ মানুষেরও হয়ে থাকে। ইঁদুরের ওই নির্দিষ্ট রোগ তৈরি এবং তা থেকে রোগ উপশমের পন্থা তথা সম্ভাব্য চিকিৎসার খোঁজ এই গবেষণার মাধ্যমে উঠে আসে। কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, ইঁদুর নিয়ে কেন? কারণ, ইঁদুরের শরীরের ভেতরে যে সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ রয়েছে, মানুষের শরীরেও তা একই রকমের। তাছাড়া মানুষের জিনগুলির সঙ্গে ইঁদুরের জিনের মিল প্রায় পঁচানব্বই শতাংশ। এইভাবে ইঁদুরের ‘জিন নক্‌ড-আউট’ মডেল থেকে জিনঘটিত বেশ কিছু রোগ যেমন হার্টের বিভিন্ন অসুখ থেকে সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমের সমস্যা, ডায়াবেটিস, ক্যানসার এবং সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদি রোগের চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্য পাওয়া গেছে। এই প্রযুক্তির বিপুল কার্যকারিতার ফলে ‘জিন ম্যানিপ্যুলেশন’ বা জিনগত কাটাছেঁড়া করা হয়ে উঠেছে আরও সহজসাধ্য। মানবকল্যাণের জন্য এই কাজের গুরুত্ব অসীম। এই যুগান্তকারী কাজ আধুনিক জিন গবেষণা ও বায়ো-মেডিসিন বা জৈব-চিকিৎসাবিজ্ঞান বিভাগের সবক্ষেত্রেই খুলে দিয়েছে নানান নতুন দিগন্ত। এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য কাপেক্কি পেয়েছেন অনেক সম্মান ও পুরস্কার। ২০০৭ সালে পেয়েছেন মেডিসিন ও ফিজিয়োলজি বিভাগের নোবেল পুরস্কার। এরপরেই ঘটে আরও এক অদ্ভুত ব্যাপার। নোবেল প্রাপকের নাম এবং পদবী দেখে অস্ট্রিয়ায় থাকা এক মহিলা মারিও-র সঙ্গে যোগাযোগ করেন; জানা যায় যে তিনি মারিওর সৎ বোন, একই মায়ের গর্ভজাত। আরও একবছর পরে ভাই-বোনের সাক্ষাৎ হয়।

এক জীবনে কত কিছুর সাক্ষী মারিও কাপেক্কি!

এই সাফল্য সত্যিই অভাবনীয় ও বিস্ময়কর। যাঁর শৈশবের ঠিকানা ছিল রাস্তা, যাঁর প্রতিটি দিন কেটেছে দারিদ্র্য ও রোগাক্রান্ত অবস্থায়, দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে ভিক্ষা ছাড়া যাঁর কোনো উপায় ছিল না, সেই শূন্য থেকে শুরু করা ছেলে যখন নোবেল পুরস্কার পায় তখন মনে হয় এ যেন কোনও অলৌকিক ব্যাপার! ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হলে রাস্তাতেই জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা যাঁর, জীবন তাঁকে ওই রাস্তা থেকে তুলে এনে বিজ্ঞানের রাজপথে রাজপ্রাসাদের অধিবাসী করেছে। জীবন এরকমই চমকপ্রদ, এরকমই আশ্চর্যের।  

.............................



#বিজ্ঞান #জিন প্রযুক্তি #জিন নক-আউট #মারিও কাপেক্কি #সিদ্ধার্থ মজুমদার #জেমস ওয়াটসন #ডিএনএ #চিকিৎসাবিজ্ঞান #মাউস মডেল #নোবেল পুরস্কার #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

64

Unique Visitors

215851