ফিচার

ক্রান্তীয় উদ্ভিদের আজব খিদে

সায়নদীপ গুপ্ত July 6, 2023 at 4:52 am ফিচার

গাছেরা কী খায়? নিচু ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরাও গড়গড় করে এর উত্তর দিয়ে দেবে – ওই তো, সূর্যের আলো, বাতাসের কার্বন ডাই-অক্সাইড, আর মাটি থেকে শুষে নেওয়া জল। এই দিয়ে পাতার রান্নাঘরে ক্লোরোফিলের উনুনে চাপিয়ে দিলেই হল, গাছের খাওয়ার জন্য গ্লুকোজ তৈরি। হাইস্কুলের ছাত্রছাত্রী হলে একটু ভারিক্কি চালে বলবে, উঁহু, তার সঙ্গে পুষ্টির জন্য অত্যাবশ্যক কিছু খনিজ পদার্থও লাগবে, যেমন পটাসিয়াম, নাইট্রোজেন ইত্যাদি। এসব অবশ্য জল-বাতাস থেকেই জোগাড় হয়ে যাবে। এই নিয়মের বাইরে কি কিছু নেই? আছে বৈকি, পতঙ্গভুক উদ্ভিদ! তাদের আবার পরিবেশ থেকে সবরকম দরকারি খনিজ পুষ্টি মেলে না, অতএব প্রকৃতি তাদের শিকারি হওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছে। এছাড়া গাছেদের খাদ্যাভ্যাসে খুব একটা বৈচিত্র্য নেই।

সত্যি? যদি বলি এমন গাছের কথা, যে এমনিতে আর পাঁচটা গাছের মতই নিরীহ, শুধু হঠাৎ ইচ্ছেমতো মাংসাশী হয়ে যায়! আবার সে ইচ্ছে মিটে গেলে ফেরত চলে আসে পুরনো গোবেচারা অভ্যাসে! পশ্চিম আফ্রিকার সিয়েরা লিওন অঞ্চলে বেড়ে ওঠা ট্রাইফায়োফাইলাম এমনই এক আজব গাছ। 

বিশ্বে মোটামুটি কুড়িটা প্রজাতির পতঙ্গভুক গাছের দেখা মেলে, তার মধ্যে একটি হল ট্রাইফায়োফাইলাম। সাধারণত সব প্রজাতিতেই একাধিক সদস্য থাকে, তবে ট্রাইফায়োফাইলামের সদস্য একটিই – পোশাকি নাম ট্রাইফায়োফাইলাম পেল্টাটাম। দেখতে-শুনতে ইনি একেবারেই লতানো গাছ, অন্যান্য বড়ো গাছের শরীর আঁকড়ে বেড়ে ওঠেন। লাতিনে ফাইলাম শব্দের অর্থ পাতা আর ট্রাই মানে তিন, আক্ষরিক অর্থেই এই গাছে ছোটো থেকে বড়ো হওয়ার মধ্যে তিন রকম পাতা দেখা যায়। শৈশবে তার পাতাগুলো হয় গড়ার দিকে সরু আর আগার দিকে চওড়া। যত সে লম্বা হয়, তার পাতার আগায় দুটো ছোটো ছোটো আঁকশির মতো উপাঙ্গ তৈরি হয়, যাতে অবলম্বন আঁকড়ে আলোর দিকে বৃদ্ধি সহজতর হয়। এরা জন্মগতভাবেই সালোকসংশ্লেষ করে নিজেদের খাবার জোগাড় করে নিতে সক্ষম। তাও বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে এদের মধ্যেই কেউ কেউ আরেক ধাপ এগিয়ে যায়, তাদের পাতা ভরে ওঠে স্ফীত, গ্রন্থিময় ক্ষুদ্র থলিতে, তাতে ভরা থাকে একধরনের স্বচ্ছ, আঠালো তরল যা পোকাদের ফাঁদে ফেলে হজম করতে সক্ষম। 

এই “বিশেষ বিশেষ” ক্ষেত্রগুলো যে কী, সেটাই বিজ্ঞানীরা এতদিন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। উদ্ভিদ তো আর আমার-আপনার মতো “রোজই তো ডালভাত খাই, আজ একটু পাঁঠার মাংস খাব” বলতে পারে না, অন্তত তেমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। তাহলে ঠিক কোন কারণে ট্রাইফায়োফাইলাম সালোকসংশ্লেষ ছেড়ে পোকামাকড়ের দিকে ঝুঁকে পড়ে? কী এমন চাহিদা যা মিটলে আবার সে ফিরে যায় নিরীহ নিরামিষ ভোজনে? বিজ্ঞানীরা বহুদিন ধরে ভেবেছেন এর মূলে হয়ত আছে নাইট্রোজেনের অধিক চাহিদা, সে জিনিস বাতাস থেকে বেশি পাওয়া যায় না তাই প্রাণিজ খাবারই ভরসা। ভেবেছেন, কারণ বাস্তবে পরীক্ষা করে দেখার কাজটা ছিল বেশ কঠিন। এমনই বেখাপ্পা পরিবেশে এ গাছ জন্মায় যাকে কিছুতেই, গ্রিন-হাউস কিংবা গবেষণাগার, কোথাও বানিয়ে নেওয়া যাচ্ছিল না। অতি সম্প্রতি জার্মানির লিবনিজ ও ওয়ার্জবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইদল বিজ্ঞানীর অক্লান্ত পরিশ্রমে সে কাজ উতরেছে। গবেষণাগারের চৌহদ্দিতেই লকলক করে বেড়ে উঠেছে এই খ্যাপা উদ্ভিদ। তারপর জন্মাবধি তাদের রাখা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে। কারও মাটিতে পটাসিয়াম কম তো কারও মাটি ফসফরাস শূন্য। এমন নানাবিধ গোষ্ঠীতে ভাগ করে নজর রাখা হল, কাদের পাতায় মাংসাশী হওয়ার প্রয়োজনীয় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। দেখা গেল, যেসব ট্রাইফায়োফাইলাম বেড়ে ওঠার সময়ে উপযুক্ত পরিমাণ ফসফরাস পায়নি, তারাই পোকা ধরার ফাঁদ বানিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছে। ফসফরাস এমনই এক যৌগ যা না থাকলে জীবদেহে ডিএনএ বানানোর কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। এহেন গুরুত্বপূর্ণ যৌগটি মাটি থেকে না পেয়ে কেউ যদি রাগের মাথায় খানকতক পোকা মারতে বেরিয়ে পড়ে, তাকে কি আর দুচ্ছাই করা যায়, বলুন? পেটের জ্বালা যে বড়ো জ্বালা! 

শুধু প্রকৃতির বৈচিত্র্যের দিকে তাকিয়ে নত হতে হয়। এই গ্রহে কয়েকহাজার বছর কাটিয়ে ফেলার পরেও, নিজেরা খেয়োখেয়ি করে গ্রহটার বারোটা বাজানোর পথে কয়েক পা এগিয়েও, এখনও আমরা এর সবটুকু আশ্চর্যকে চিনতে পারলাম না।

......... 

তথ্যসূত্র : Carnivory on demand: phosphorus deficiency induces glandular leaves in the African liana Triphyophyllum peltatum, New Phytologist, 2023. 


#carnivorous plants #Triphyophyllum peltatum #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

44

Unique Visitors

182956