বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

বিজ্ঞান ও ফ্যাশন – এক অন্যধারার রূপকথা

সায়নদীপ গুপ্ত Dec 9, 2020 at 10:15 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

আলো ঝলমলে র‍্যাম্পের শেষ মাথা থেকে হেঁটে আসছেন একের পর এক সুপারমডেল। কারও পোশাকে জোনাকির ঝিকিমিকি, কারও পরনে ক্যানসার আক্রান্ত কোষের বিভিন্ন পর্যায়ের রংবাহার, আবার কারও পোশাক পাহাড়ি মথের অ্যানাটমি অনুসারী। নামী ফ্যাশন উইকের দর্শক ও বিচারকমণ্ডলী মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন সেই নজরকাড়া ফ্যাশন আইডিয়ার দিকে। হাততালি আর ফ্ল্যাশবাল্‌বের ঝলকানি ভেসে আসছে মুহুর্মুহু। শো স্টপারের দু’হাত ধরে এগিয়ে আসছেন ফ্যাশন ডিজাইনার ও জীববিজ্ঞানী।

কল্পবিজ্ঞান? তা বটে। পোশাক পরিকল্পনা আর বিজ্ঞানের এই অদ্ভুত মিলমিশের এমন নাম দিলে অত্যুক্তি হবে না। তবে এই ঘটনা বাস্তবে করে দেখিয়েছেন বিজ্ঞান ও ফ্যাশন জগতের একদল উৎসাহী সাধক। সালটা ২০১৩, স্নায়ুবিশারদ ইউলি ফুয়েন্তেস-মেডেল MIT-র ম্যানেজমেন্ট শাখায় নিত্যনতুন আবিষ্কারের অর্থকরী দিক নিয়ে গবেষণা করছেন। সহসা তাঁর মাথায় এল, বিজ্ঞান এবং শিল্পকলা, দুই ক্ষেত্রেই যদিও সৃষ্টিশীলতাই শেষ কথা তবু দুটো বিভাগ সম্পূর্ণ আলাদা ভাষায় ভাববিনিময় করে। আপাত বিচ্ছিন্ন দুই মাধ্যমের এই নিগূঢ় সম্পর্ক তাঁকে এতটাই আচ্ছন্ন করে তুলল যে তিনি উঠেপড়ে লাগলেন, যদি বিজ্ঞান ও ফ্যাশন জগতের নিরলস সাধকদের এক ছাতার তলায় এনে সৃজনশীলতার এক নতুন দিগন্তের খোঁজ পাওয়া যায়। যেমন ভাবা তেমন কাজ, এক খ্যাপা গবেষক খুঁজে বের করলেন আরও তিন খ্যাপাকে – ইমিউনোলজিস্ট প্যাট্রিশিয়া টোরিগ্রসা, ফ্যাশন ডিজাইনার ক্লেয়ার হার্ভিস এবং গ্রাফিক ডিজাইনার ইসিডোরা ভ্যালডেজ। জন্ম নিল প্রোজেক্ট ডিসায়েন্স (Project Descience)। 


বিজ্ঞান ও ফ্যাশনের ক্যাটওয়াক :ডিসায়েন্স ২০১৪ ।। 

ছবি : এস্থার বেনা

ডিসায়েন্সের মূল কাজটুকু ছিল একটা ভিন্নধর্মী জুটি বানিয়ে ফেলা – একজন বিজ্ঞানী ও একজন ডিজাইনারকে নিয়ে। তারপর এমন বিভিন্ন জুটির কাজকে একটা প্রতিযোগিতার আঙ্গিনায় নিয়ে আসা, যাতে দুই ভিন্ন ধারার সৃজনশীলতা মিলে সৃষ্টি করে চরম উৎকর্ষ - জটায়ুর ভাষায় বললে, ‘হাই ভোল্টেজ স্পার্ক’! প্রাথমিকভাবে বোস্টন শহরে শুরু হলেও অচিরেই এই খ্যাপামির রেশ ছড়িয়ে পড়ল দেশের সীমানার বাইরেও। শেষ অবধি ৬১টি জুটির কাজ নিয়ে শুরু হল প্রথম পর্যায়। বিজ্ঞানীরা ডিজাইনারদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন, কোথাও ল্যাবে, কোথাও বাড়িতে, কোথাও বা ভার্চুয়াল মাধ্যমে। একের পর এক মগজাস্ত্র চর্চার ফাঁকে জন্ম নিল নিত্যনতুন আইডিয়া। মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখা কোষের গঠন, ড্রসোফিলা মাছির পুঞ্জাক্ষি, এমনকি স্নায়ুতন্তুর বিবর্তন – সবকিছু এক আশ্চর্য শৈল্পিক দক্ষতায় উঠে এল বিভিন্ন নকশার বুননে। অবশেষে ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে MIT-তে আয়োজিত হল প্রতিযোগিতার শেষ পর্যায়, পেশাদার মডেলরা এক একটি জুটির পোশাক প্রদর্শন করলেন। ভিড় উপচে পড়ল প্রেক্ষাগৃহে, অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার থেকে ২০,০০০ ভোট নিয়ে ঘোষিত হল ‘পিপল্‌স চয়েস অ্যাওয়ার্ড’। সৃষ্টিশীলতার র‍্যাম্পে হাতে হাত রেখে দৃপ্ত পদচারণা করল বিজ্ঞান ও বুননশিল্প। 

কিন্তু কী পাওয়া গেল এই হট্টমেলার শেষে? ঝলমলে পোশাক? বাহারি বিনোদন? বিজ্ঞানের বাজারদর বাড়ল বুঝি? সব উত্তরের এক সুন্দর নির্যাস মেলে এস্থার বেনার লেখায়। 


প্রোস্টেট কার্সিনোমার ক্রমবিকাশ : গ্ল্যান্ড, হিস্টোলজি ও নকশা ।। ছবি: এস্থার বেনা

এস্থার বেনা ম্যাঞ্চেস্টার ইন্সটিটিউটের এক নবীনা ক্যানসার গবেষক। বোস্টনে এক বন্ধুর বাড়িতে বারবিকিউ পার্টির সময় তিনি প্রথম ডিসায়েন্স প্রোজেক্টের কথা শোনেন এবং শোনামাত্র হেসে উড়িয়ে দেন। শেষ অবধি খানিকটা হালকা চালেই অংশগ্রহণ করেন। তাঁর ফ্যাশন ডিজাইনার সহযোগী অ্যারিয়েলের সঙ্গে নিরন্তর আলোচনায় ধীরে ধীরে প্রোস্ট্রেট ক্যানসারের বিভিন্ন পর্যায়ের গঠনগত ক্রমবিবর্তন উঠে আসতে থাকে কাপড়ের রঙে, তন্তুর গড়নে। কার্সিনোমার বিভিন্ন পর্যায়ে গ্ল্যান্ডের বিভিন্ন আকৃতি, বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় বদল ইত্যাদিকে তুলে ধরার জন্য কাপড়ের রঙে, গঠনে, আয়তনে চলতে থাকে নানা কারিকুরি। অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে হতে এস্থার বুঝতে পারেন, যেসকল বদগুণ একজন বিজ্ঞানীকে তাড়িয়ে বেড়ায় জীবজগতের রহস্য উন্মোচনের তাগিদে, সেই সবকিছুই একজন ফ্যাশন রূপকারকে মাতিয়ে রাখে তাঁর নিত্যনতুন শিল্পকর্মে – কৌতূহল, কল্পনা আর নতুন কিছু সৃষ্টির ইচ্ছা। এই দুই জগতের মানুষ যখন একত্রে সৃষ্টির উল্লাসে সামিল হন, তাঁদের বহুবিধ দক্ষতাকে এই সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি এক অন্য মাত্রা দেয়। কী পোশাক তৈরি হল বা বিজ্ঞান কী পেল, সেই প্রশ্ন এখানে গৌণ। যে নতুন চিন্তাধারার জন্ম হল এই অসম সৃজনক্ষমতার মিলনে, তা বিজ্ঞানকে দৈনন্দিন জীবনের নান্দনিকতায় সম্পৃক্ত করে।  ইউলি মেডেলও তো এমনটাই চেয়েছিলেন; ফলাফলের তুলনায় প্রক্রিয়াতেই বেশি আগ্রহী ছিলেন তিনি। বিজ্ঞানী ও শিল্পীদের পারস্পরিক ধারণা বিনিময়ের ভাব ও ভাষা বিশ্লেষণ করে ক্রমাগত অস্পষ্ট করে তুলেছেন দুই মাধ্যমের সীমারেখা। তবু তার মাঝেও কি উঁকি দিয়ে যায়না ব্যক্তিগত আশা আকাঙ্ক্ষা? বিজ্ঞানের তুলনায় ফ্যাশন জগত অনেক বেশি নজরকাড়া, অনেক বেশি প্রচার অভিমুখী। তাই তার মাধ্যমে বিজ্ঞানের হাজারো সৃষ্টির সৌন্দর্য্যকে গবেষণাগারের আগল খুলে পেশা ও বয়স নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লোভ সংবরণ করাও কঠিন। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার অ্যাঞ্জেলা চ্যাং একথা একবাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন। সহযোগী শিল্পী হ্যারি উমেনের শিল্পভাবনা এবং নিজের কারিগরি দক্ষতার উপর নির্ভর করে তিনি ছকে ফেলেন বুনন ও বৈদ্যুতিন শিল্পের এক অসাধারণ মেলবন্ধন, Luminar Firefly Dress, যার মূল ভাবনা জোনাকির ঝিকিমিকি ঘিরে। এই কাজে তাঁদের সাহায্য করেন পোশাক প্রস্তুতকারক ডেবোরা ক্যাল্ডওয়েল এবং প্রযুক্তিবিদ হাওয়ার্ড এগলোস্টেইন। অ্যাঞ্জেলার মতে, নিজের ছকভাঙ্গা চিন্তাগুলো ল্যাবরটরির চার দেওয়ালের বাইরে এনে জনসাধারণের স্বীকৃতি ও সমাদর পাওয়ার সুযোগটাই একটা মস্ত বড় অনুপ্রেরণা। 

ফ্যাশন জগতের শিল্পীরাও এমন নতুন ধরনের কাজে উপকৃত হন, তাঁদের কল্পনাজগত আরও পুষ্ট হয়। সম্প্রতি ২০১৯ সালে কানাডার গবেষক মাইকেল কোবর ও তাঁর সহকর্মীরা ভ্যাঙ্কুভার কমিউনিটি কলেজের ফ্যাশন স্কুলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁদের গবেষণার মূল নমুনা, ড্রসোফিলা মাছিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ফ্যাশন আইডিয়া গড়ে তোলেন এবং তাঁদের সেই কাজ অভূতপূর্ব সাড়া জাগায় ভ্যাঙ্কুভারের শিশু ফ্যাশন প্রদর্শনীতে। বিজ্ঞানীরা জানতেন, মিউজিক ফেস্টিভ্যাল বা ফ্যাশন উইকের মত কোন উৎসবমুখর জায়গায় নিজেদের কাজ নিয়ে যেতে পারলে বিজ্ঞান সম্পর্কে সাধারণ সচেতনতা এবং উৎসাহ অনেকটাই বাড়ানো যাবে। কিন্তু ফ্যাশন ডিজাইনারদের কাছেও যে এই কাজ এক নতুন শিল্প আঙ্গিকের জন্ম দেবে, এতটা তাঁদের ভাবনায় আসেনি। যদিও এই ব্যাতিক্রমী ভাবনার সূত্রপাত হয়েছে আগেই। ১৯৯৭ সালেই স্কটল্যান্ডের জীববিজ্ঞানী কেট স্টোরির বোন, ফ্যাশন রূপকার হেলেন স্টোরি, তাঁর দিদির গবেষণার বিষয়, ভ্রূণের বৃদ্ধি ও ক্রমবিকাশকে মডেল করে এক অনন্য ফ্যাশন ভাবনার জন্ম দেন। পরবর্তীকালে তেল আভিভ, ইজরায়েল, সাংহাই, চীন বিভিন্ন দেশে তাঁর এই ভাবনা প্রভূত সমাদর পায়। শুরুটা তাঁদের হাতে হলেও এই মেলবন্ধনকে আরও ব্যাপ্তি দেওয়ার রূপকার নিঃসন্দেহে ইউলি ফুয়েন্তেস-মেডেল। উদ্দেশ্য যাই হোক, এমন নিত্যনতুন খ্যাপামি আছে বলেই, বিজ্ঞান ও শিল্পের জগতে রহস্যের কোন কমতি নেই, সৌন্দর্য্যের কোন খামতি নেই। 

তথ্য ও চিত্র সূত্রঃ 

(১) Science and society: Art and science collaborations in the United Kingdom, Stephen Webster, Nature Reviews Immunology

(২) Fashion Descience Project, Leila Vibert-Stokes, Lancet Oncology 

(৩) When tumours meet fashion, Esther Baena, Occam’s Corner 



কভার ছবি : চার্লি লিমে

#বাংলা #বিজ্ঞান #পপুলার সায়েন্স #Fashion Descience

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

27

Unique Visitors

214993