সত্যজিতের জাদু দুনিয়া
হিরে মানিক জ্বলে ( পঞ্চম পর্ব) বছর পাঁচেক বয়সে মামার বাড়ি চলে আসার পর সত্যজিতের মনখারাপ করার বিশেষ কারণ ঘটেনি। বরং তাঁর ‘সোনামামা’ প্রশান্তকুমার দাশ আমুদে লোক হওয়ার কারণে মাঝে মাঝেই বায়স্কোপ, সার্কাস, কার্নিভ্যাল বা ম্যাজিক দেখার সুযোগ এসে পড়ত। সেখান থেকেই বোধহয় কিশোর সত্যজিতের মধ্যে মাথা চাড়া দিয়েছিল ম্যাজিকের শখ।
প্রথম যাঁর ম্যাজিক সত্যজিৎকে অভিভূত করেছিল, তিনি ইতালীয় জাদুকর শেফালো। তখনকার এম্পায়ার থিয়েটারে তাঁর কথা আর খেলার স্রোত ছুটেছিল একইসঙ্গে। আবার তাঁরই দলে খেলা দেখাতেন মাদাম প্যালার্মো, যিনি এই বুকনি বা ‘প্যাটার’-এর ধারই ধারতেন না। তখনও অবশ্য সত্যজিৎ জানতেন না, এই ধরনের নিঃশব্দ ম্যাজিকে হাতসাফাইয়ের বদলে থাকে যন্ত্রের কারসাজি। তবে কিছুদিন পরে এক বিয়েবাড়িতে স্টেজের সাজসজ্জা-আলো-যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়াই তাঁকে চমকে দিয়েছিল একজন বাঙালির ম্যাজিক। ফরাসে ছড়িয়ে রাখা দেশলাই কাঠি খালি বাক্সে ঢোকানো কিংবা আংটি দিয়ে রুপোর টাকা ধরে আনার খেলা সত্যজিৎকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, অনেক পরে ‘দুই ম্যাজিশিয়ান’ গল্পে এই জাদুকরকে কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। পরে ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলেও মুগ্ধতার ঘোর পেরিয়ে উঠে তাঁর নাম-ঠিকানা আর জানা হয়নি সত্যজিতের। তাঁর গল্পে অবশ্য জাদুকরের শিষ্য গুরুর দক্ষতায় মোহিত হলেও এ কথা বুঝতে ভুল করেননি যে, জনপ্রিয় হয়ে ওঠার জন্য খাঁটি ম্যাজিকের পাশাপাশিই জরুরি শেফালোর মতো চাকচিক্য। ‘নয়ন রহস্য’-এর সময় জাদুকর তরফদারকেও ফেলুদা এ কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি।
জাদুকর সুনীল তরফদারের সঙ্গে যখন তিনমূর্তির আলাপ হয়েছিল, তখন নাকি ‘ব্যাঙের ছাতার মতো ম্যাজিশিয়ান গজাচ্ছে এই পশ্চিম বাংলায়’। ‘চমকদার তরফদার’ ছাড়াও ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’-এ সূর্যকুমারের শো দেখতে গিয়ে শেষমেশ তদন্তে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল ফেলুদাকে। ফেলুদার ম্যাজিক শো দেখায় অবাক হওয়ার কিছু নেই, কারণ ফেলুদার দ্বিতীয় অভিযান ‘বাদশাহী আংটি’-তেই তোপসে জানিয়ে দিয়েছিল যে ফেলুদা তাসের ম্যাজিক ছাড়াও একটু আধটু হিপনোটিজমও জানে। লখনউতে ধীরুকাকার বাড়িতে বসে তোপসেকে তাসের ম্যাজিক শেখাতে শেখাতে ফেলুদা এ কথাও বলেছিল, ‘ইন্ডিয়ানদের আঙুল ইউরোপিয়ানদের চেয়ে অনেক বেশি ফ্লেক্সিব্ল। তাই হাত সাফাইয়ের খেলাগুলো আমাদের পক্ষে রপ্ত করা অনেক সহজ।’
হাত সাফাইয়ে রীতিমতো ওস্তাদ ছিলেন কালীনাথ রায়। শঙ্করপ্রসাদ চৌধুরীর আমন্ত্রণে পানিহাটি গিয়ে তাঁর সঙ্গে ফেলুদার পরিচয় হয়। ততদিনে ফেলুদা আর তোপসের দলে জুটে গেছেন লালমোহনবাবুও। আলাপের সঙ্গে সঙ্গেই ছদ্মবেশী পক্ষিবিদ জটায়ুর পকেট থেকে কালীনাথ বের করে ফেলেন মুরগির ডিমের সাইজের একটা মসৃণ সাদা পাথর। কে জানে, ‘জাহাঙ্গীরের স্বর্ণমুদ্রা’ লেখার সময় বাবার লেখা ‘চালিয়াৎ’ গল্পের ম্যাজিশিয়ানটির এইজাতীয় কারসাজির কথা সত্যজিতের মনে পড়েছিল কি না!
সত্যজিতের নিজের ম্যাজিক শেখার হাতেখড়ি হয়েছিল রাস্তায় দাঁড়িয়ে, সেই বাঙালি ভদ্রলোকের কাছেই। পরে ম্যাজিকের বই কিনে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক ম্যাজিক নিজেই অভ্যাস করেছিলেন তিনি, যেমনটা অনেক বড় বয়স পর্যন্ত ফেলুদাকেও করতে দেখেছে তোপসে। সত্যজিৎ যদিও বলেছেন এই নেশার মেয়াদ ছিল কলেজ অবধিই, কিন্তু পরবর্তীকালে তাঁর গল্পে ঘুরেফিরে ম্যাজিকের উল্লেখ দেখলে সে কথার সত্যতা নিয়ে খানিক সংশয় জাগে বইকি।
স্টেজের বদলে ফরাসে ম্যাজিক দেখাতেন সোমেশ্বর বর্মন-ও, মূলত নেটিভ স্টেটের রাজারাজড়াদের। ইংরেজিতে লেখা ভারতীয় জাদু সম্বন্ধে তাঁর সংগৃহীত তথ্য, যার নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ম্যাজিক’, সেই পাণ্ডুলিপির দাম উঠেছিল কুড়ি হাজার টাকা। পাণ্ডুলিপিটির প্রকৃত মূল্যমান যাচাই করার জন্যই ফেলুদার দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। সত্যজিতের একনিষ্ঠ পাঠকের মনে থাকা স্বাভাবিক, একই পাণ্ডুলিপির উল্লেখ পাওয়া যায় ‘মহিম সান্যালের ঘটনা’ গল্পেও। মহিম সান্যালের সংগ্রহ করা হাজারের উপর ম্যাজিক, যার মধ্যে হাত সাফাই-ই তিনশো ছাপ্পান্ন রকম, ঠাঁই পেয়েছিল সাড়ে চারশো পাতার এই ইংরেজি পাণ্ডুলিপিতে। আর দুটি গল্পেই উপস্থিত আরও অন্য একজন করে জাদুকর, যাঁর মঞ্চসজ্জার আড়াল সরিয়ে আত্মপ্রকাশ করেন প্রবীণ জাদুকরের ছেলে। ‘ইন্দ্রজাল রহস্য’-এ তিনি সূর্যকুমার ওরফে অখিল, ‘মহিম সান্যালের ঘটনা’-য় সূর্যকান্ত ওরফে অনীশ।
জাদুকর মহিম সান্যাল ছাড়াও তারিণীখুড়ো আরও একজন ম্যাজিশিয়ানের কাছে চাকরি করেছিলেন কিছুদিন। ‘তারিণীখুড়ো ও ঐন্দ্রজালিক’ গল্পের এই জাদুকরের স্টেজের নাম ছিল চমকলাল। গল্পের শেষে জানা যায় তাঁর আসল নাম সূরয সিং। তাঁর খেলার লিস্টে ছিল এমন একটা চমকপ্রদ জিনিস, যা সত্যজিতের অন্য কোনও ম্যাজিকের গল্পে পাওয়া যায় না। থট রিডিং। চোখ-বাঁধা জাদুকর দর্শকদের দিকে পিছন ফিরে বসে সিট নম্বর ধরে ধরে তাঁদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বলে যেতেন। তবে সে খেলা যতই অভিনব হোক, এ গল্পেও শেষমেশ নায়কের ভূমিকা নিয়েছে সেই আদি অকৃত্রিম হাত সাফাই।
ম্যাজিকের অন্যতম অঙ্গ হিপনোটিজম বিষয়ে ফেলুদার অল্পস্বল্প জ্ঞান ছিল, তবে প্রোফেসর শঙ্কু বিস্তর গবেষণা করেছেন হিপনোটিজম নিয়ে। কে জানে, বন্ধু ক্রোলের সংস্পর্শে এসেই তাঁর এ বিষয়ে আগ্রহ জন্মেছিল কি না! গোটা ইয়োরোপে জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী মানুষ ক্রোলের মতো আর দ্বিতীয় কাউকে পাওয়া যাবে না বলেই বিশ্বাস ছিল শঙ্কুর। একশৃঙ্গ অভিযানের আগে মেক্সিকো থেকে বোর্নিও পর্যন্ত এগারোটি দেশের ম্যাজিকের সাহায্যে ভবিষ্যৎ গণনা করেছিলেন ক্রোল। এই অভিযানেই, থোকচুম গুম্ফায় ঢুকেই নাকি তিনি ‘তিব্বতি ম্যাজিকের গন্ধ’ পেয়েছিলেন। অবশ্য সে গুম্ফার উপকরণ নিয়েই পরে যখন তাঁদের আকাশে ওড়া সম্ভব হল, সে ঘটনাকে ‘ম্যাজিক’ বললে অত্যুক্তি হয় না মোটেই।
সম্মোহিত করার উদ্দেশে ফেলুদাকে মঞ্চে ডেকে জাদুকর তরফদার যেমন অপ্রস্তুত অবস্থায় পড়েছিলেন, সেই একই ঘটনা ঘটেছিল সত্যজিতের গিরিডি-নিবাসী বাঙালি বৈজ্ঞানিকের গল্পেও। ঘটনাস্থল ছিল হংকং। ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও চী-চিং’ গল্পে চিনে জাদুকর চী-চিং অবশ্য এই অপমানের শোধ তুলতে ছাড়েননি। ফেলুদাকে যেমন ম্যাজিক শো দেখতে গিয়ে বারবার তদন্তে জড়িয়ে পড়তে হয়েছে, দেখা যাচ্ছে প্রোফেসর শঙ্কুর ক্ষেত্রেও ম্যাজিক শো দেখার অভিজ্ঞতা বিশেষ সুখকর হয়নি। চী-চিং ছাড়াও তাঁকে রীতিমতো নাকাল করেছিলেন আর্গাস। পোষা কাক কর্ভাসকে নিয়ে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে বক্তৃতা দেওয়ার সূত্রে শহরের প্লাজা থিয়েটারে দ্যেমিনগো বার্তেলেমে সারমিয়েন্তো ওরফে আর্গাস-এর শো দেখতে হাজির হয়েছিলেন প্রোফেসর শঙ্কু। ইনিও বিভিন্ন পাখিকে কাজ শিখিয়ে ম্যাজিকের কাজে লাগাতেন, আর সেই কারণেই তাঁর চোখ পড়েছিল শঙ্কুর হাতে ‘মানুষ’ কর্ভাস-এর প্রতি। এহেন তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও জাদুর প্রতি শঙ্কুর একটা খোলা মন ছিল, কারণ তিনি মনে করতেন, ‘উঁচু দরের জাদুকর মাত্রেই বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হয়।’ অবশ্য, বাগদাদে হাসান অল্ হাব্বালের দৌলতে ‘চিচিং ফাঁক’ মন্ত্রে গুহার দরজা খোলা এবং ‘জাদুকরশ্রেষ্ঠ’ গেমাল নিশাহির অল্ হারারিৎ-এর আশ্চর্য বাক্সে বন্দি ঐতিহাসিক বায়স্কোপ প্রত্যক্ষ করার পর এ কথা না বলে উপায় কী! পাঁচ হাজার বছর আগের সুমেরীয় জাদুকর যে একালের বৈজ্ঞানিকদের কৃতিত্বকে ছাপিয়ে গেছিলেন অতদিন আগেই!
দশম শতাব্দীর আরবি অ্যালকেমিস্ট জবীর ইব্ন হায়ান বা আরও তিনশো বছর পরের মানুয়েল সাভেদ্রার কৃত্রিম উপায়ে সোনা তৈরিকে অনেকেই ম্যাজিক ভাবতে পারে, তবে তাঁরা মন্ত্রতন্ত্রের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বিজ্ঞানকে। এই ‘সুবর্ণ সুযোগ’-এই শঙ্কুর দেখা হয়েছিল রিউফাস এইচ. ব্ল্যাকমোরের সঙ্গে, যিনি ম্যাজিক জানার পাশাপাশি একটা বইও লিখেছিলেন ‘ব্ল্যাক আর্ট অ্যান্ড হোয়াইট ম্যাজিক’ নামে। সোনা ছাড়াও একবার কৃত্রিম উপায়ে হিরে বানানোর সুযোগ হয়েছিল প্রোফেসর শঙ্কুর, যার ফর্মুলা এসেছিল সাড়ে তিন হাজার বছর আগেকার মিশরীয় পুরোহিত ও জাদুকর নেফ্রুদেৎ-এর লেখা প্যাপাইরাস থেকে। পুরোহিত আর জাদুকরের এহেন কম্বিনেশনে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ এই গল্পের প্রায় বছর তিরিশ আগেই দুই ফরাসি ভদ্রলোক লিখে ফেলেছেন খ্রিস্টপূর্ব ৫০ সালের এক পুরোহিতের কথা, যাঁর জাদু পানীয়ের দৌলতে প্রবল পরাক্রমশালী জুলিয়াস সিজারের আগ্রাসনের মুখে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিল এক ছোট্ট গল গ্রাম। টিনটিন কমিকসের একনিষ্ঠ পাঠক সত্যজিতের হাতে অ্যাসটেরিক্স কমিকস এসে পৌঁছয়নি বা গেটাফিক্স-এর কার্যকলাপ সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন না, এ কথা ভাবারও কারণ নেই, কারণ ১৯৬১ সালেই ইংরেজি ভাষার হাত ধরে বিশ্ব পরিক্রমায় বেরিয়ে পড়েছিল অ্যাসটেরিক্স।
তবে সত্যজিতের গল্পে যতই নামকরা জাদুকরদের দেখা পাওয়া যাক না কেন, তাঁদের টেক্কা দিয়ে গিয়েছেন এক সাধারণ মানুষ। ধৈর্য, অধ্যবসায় এবং পৈতৃক সম্পত্তি কোনোটাই না থাকায় ম্যাজিককে পেশা হিসেবে নেওয়ার সুযোগ হয়নি তাঁর। কিন্তু একসঙ্গে হাজার-দুহাজার লোককে সুকৌশলে ‘ধাপ্পা’ দেওয়ার আর্ট যাকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল, সেই ‘ব্রামা দ্য গ্রেট’ ওরফে সমরেশ ব্রহ্মর বই লুকিয়ে রেখে তাকে বানিয়ে-তোলা খোলসের বাইরে নিয়ে আসার কৌশল যে মানুষটি দেখাতে পেরেছিলেন, তাঁর সামনে ম্যাজিশিয়ানের ট্যাম-ও-শ্যান্টার না খুলে উপায় আছে!
আর লুকিয়ে রাখা বইটি? চার্লস ওয়েকম্যানের ‘হিস্ট্রি অফ ম্যাজিক’!
*[কভারে সত্যজিত রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে।] ** [কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস।]
#হিরে মাণিক জ্বলে #নিবন্ধ সিরিজ #রণিতা চট্টোপাধ্যায় #সত্যজিৎ রায়