লেখা আদায় করতে 'অপহরণ' করা হয়েছিল শরৎচন্দ্রকে
‘মানুষের অত্যন্ত সাধের বস্তুই অনেক সময় অনাদরে পড়িয়া থাকে। .… যাহাকে সবচেয়ে বেশি দেখিতে চাই, তাহার সঙ্গেই দেখা করা ঘটিয়া ওঠেনা, যাহাকে সংবাদ দেওয়া সর্বাপেক্ষা প্রয়োজন, সেই-ই আমার চিঠির জবাব পায় না।’
তার কারণ ক্ষেত্রবিশেষে স্রেফ আলসেমি। আর এই আলসেমির সাজা যে কী সাংঘাতিক হতে পারে, এই লেখাটি লেখবার সময়ই তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সে ঘটনা ভারী মজার।
৪ নম্বর বাজে শিবপুর ফার্স্ট বাই লেনের বাড়ির বৈঠকখানা ঘরে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতেন ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় সম্পাদক জলধর সেন। উদ্দেশ্য শরৎ বাবুর কাছ থেকে ধারাবাহিক কিস্তির লেখা আদায়। কিন্তু শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কাছ থেকে লেখা আদায় করা মোটেই ছেলেখেলা নয়। সে রীতিমত সাধ্য সাধনার ব্যাপার। এমনই আলসে মানুষ ছিলেন শরৎবাবু। পত্রিকার সম্পাদকেরা বছরের-পর-বছর ধর্ণা দিয়ে অবশেষে লেখা পেয়েছেন তাঁর কাছ থেকে এমন দৃষ্টান্তও আছে। এমনই এক নাছোড়বান্দা সম্পাদকের হাতে একবার শরৎচন্দ্রকে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হতে হয়।
‘বিজলী’ পত্রিকার সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকার একটা লেখা পাবার আশায় টানা দু বছর ধরে সপ্তাহে অন্তত একবার করে তাঁর বাড়ি এসে ধর্ণা দিচ্ছেন। কিন্তু শরৎচন্দ্রও যেমন-তেমন আলসে নন! ফলত নলিনীকান্ত কে শেষমেশ এক জোরদার ফন্দি আঁটতে হল। একদিন তিনি কাতরভাবে শরৎবাবুর কাছে এসে বললেন -“দাদা,এই সম্পাদকী করে যা মাইনে পাই,তাতে সংসার চলে না,তার জন্য প্রাইভেট টুইশনী করতে হয়। শুনলাম রামকৃষ্ণপুরে একটি টুইশনী খালি আছে। শুনেছি তিনি আপনার খুবই পরিচিত।আপনি দয়া করে যদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের একটু বলে কয়ে দেন।” এমন কাতর আবেদন শরৎচন্দ্র ফেলতে পারলেন না। নলিনীকান্তকে নিয়ে চললেন রামকৃষ্ণপুর। বাড়ির সামনে বড় রাস্তার উপর থেকে ট্যাক্সিতে চড়ে বসেছেন দুজনে। ট্যাক্সি চলতে শুরু করেছে। হঠাৎ শরৎচন্দ্রের খেয়াল হলো ট্যাক্সি রামকৃষ্ণপুর ছাড়িয়ে হাওড়া ব্রিজের উপরে। গাড়ি কোথায় চলেছে কিছুই বুঝতে পারছেন না। নলিনীকান্তও মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন। অবশেষে ট্যাক্সি এসে থামল পটুয়াটোলা লেনের একটা বাড়ির সামনে। নলিনীকান্ত শরৎচন্দ্রকে কোন রকমে এনে তুললেন সেই বাড়ির দোতলার এক কামরায়। শরৎবাবুর তখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। একখানি চেয়ারে তাঁকে বসানো হল। সামনের টেবিলে রাখা আছে দু'খানি টোস্ট,দুটো ডিম,এক পেয়ালা চা,এক প্যাকেট সিগারেট,একটি দেশলাই,একখানা রাইটিং প্যাড ও দোয়াত কলম। শরৎবাবু কিছু বুঝে ওঠার আগেই নলিনীকান্ত ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে থেকে তালা দিয়ে সরে পড়লেন। যাবার আগে বলে গেলেন, লেখা দিলে তবেই নিষ্কৃতি।
আরও পড়ুন:মেয়েদের পোশাক নিয়ে মন্তব্যের কারণে কমিউনিস্টদের আক্রমণ করেছিলেন উৎপল দত্ত/তোড়ি সেন
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রায় জোর করে তুলে এনে সেদিনের মত লেখা আদায় হয়েছিল বৈকি। প্রায় তিন ঘন্টা পরে চিৎকার করে দরজা ধাক্কা দিয়ে নলিনীকান্তকে ডেকে এনে তার হাতে ধরিয়ে দেন এক অপূর্ব ভ্রমণকাহিনি। লেখাটির নাম দেন ‘দিন কয়েকের ভ্রমণকাহিনী’।
কৃতজ্ঞতা :
শরৎচন্দ্র, গোপাল চন্দ্র রায়, আনন্দ পাবলিশার্স ২০০৩