আনুষ্ঠানিক ও ফরমায়েশি কবিতা লেখার ব্যবসা ফেঁদেছিলেন সজনীকান্ত দাস
বাঙালি যুবক। নেশায় কলমজীবী। স্কটিশ চার্চ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেও তাঁর খাতাভর্তি কবিতার মকশো। মেডিকেল কলেজে পড়ার সুযোগ পেয়েও সে সুযোগ ছেড়ে দিলেন মামাতো ভাইয়ের জন্য। বিয়ের পর ঘরজামাই হয়ে থাকবেন না বলে স্বেচ্ছায় বেছে নিলেন অনিশ্চিত জীবন। তারপর প্রাইভেট টিউশন থেকে রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে শুনে ‘পশ্চিম যাত্রীর ডায়রি’-র অনুলিখন - এ সব কিছুই ক্রমে ক্রমে জড়ো হল তাঁর কর্ম-অভিজ্ঞতার ঝুলিতে।
ভাবছেন কি কার জীবনের এ হেন রঙিন বৈচিত্র্যভরা আখ্যান? এই লেখক হলেন স্বনামধন্য সজনীকান্ত দাস, শনিবারের চিঠির বিখ্যাত (বা কুখ্যাত) সম্পাদক হিসেবে সাহিত্যপ্রেমী আপামর বাঙালির কাছে যিনি অতিপরিচিত। সম্পাদক সজনীকান্তকে নিয়ে নানা কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি তো অনেকেরই জানা। তবে সম্পাদক হওয়ার আগে তাঁর ঈষৎ বোহেমিয়ান জীবনের গল্পও কম কৌতুককর নয়।
ছেলে বিপ্লবী হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় সজনীকান্তের পিতা তাঁকে প্রেসিডেন্সি কলেজ ছাড়িয়ে ভর্তি করেছিলেন বাঁকুড়ার ওয়েসলিয়ান মিশনারি কলেজে। এতে অত্যন্ত মনঃক্ষুণ্ণ সজনীকান্তের রোখ চেপে যায়। আই.এস.সি-তে ভালো ফল করে ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। এই কলেজেই ক্লাস করতে করতে সজনীকান্ত লিখলেন -“দুলিয়ে বেণী চলে আমার আগেকি ভাবে আহা, বুকের মাঝে জাগেও তার পায়ে চলার তালে তালেউঠিনু গান গাহি।”
পড়াশুনায় তেমন মন না থাকলেও বুদ্ধির জোরে তিনি ভালো ফল করেছেন প্রায় সবসময়েই। বারবার বদলেছেন কলেজ। কারণ? কখনো তাঁর বিদ্রোহী একরোখা স্বভাব, কখনো আবার দারিদ্র্য। বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য ভর্তি হলেও হোস্টেলে আমিষ নিষেধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় বিতাড়িত হন। সায়েন্স কলেজে এম.এস.সি পড়েছিলেন ফিজিক্স নিয়ে। যদিও টাকার অভাবে শেষ পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠেনি।
এসময়ে অর্থাভাব তাঁর নিত্যসঙ্গী ছিল। মেসের খরচ চালাতে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে পুরোপুরি মন দিলেন লেখালিখির কাজে। ইতিমধ্যে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের পুত্র অশোক চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগে প্রকাশিত হতে শুরু করেছে ‘শনিবারের চিঠি’। সজনীকান্ত হয়ে উঠলেন সেই পত্রিকার আড্ডার অন্যতম সদস্য।
তখনো অনিশ্চয়তা কিন্তু তাঁর পিছু ছাড়েনি। টাকার অভাবে মেস ছাড়লেন। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের অনুমতি নিয়ে থাকতে শুরু করলেন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে বিশ্বভারতী কার্যালয়ের একটি ছোট্ট অব্যবহৃত ঘরে। শর্ত একটাই - রবীন্দ্রনাথের বইয়ের প্রুফ তাঁকে দেখে দিতে হবে। পরে ‘পশ্চিমযাত্রীর ডায়রি’-র কাজ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী পত্রিকা তাঁকে নিয়োগ করেছিল প্রুফ রিডার হিসেবে। মাইনে মাসে চল্লিশ টাকা। এই চাকরিই প্রথম কিছুটা স্থিতি আনল তাঁর সদা অনিশ্চিত জীবনে।
কথায় বলে, “Every cloud has a silver lining”। সজনীকান্তের প্রথম জীবনে বহু প্রতিকূলতা ছিল ঠিকই, তবে একঘেয়ে জীবনচক্রে বাঁধা না পড়া তাঁকে সৃষ্টির পথে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল নিশ্চিতভাবে। চাইলেই শ্বশুরমশাইয়ের বিরাট সম্পত্তির দখলদারি নিতে পারতেন। কিন্তু সে কাজ তাঁর মতো প্রখর আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষে একেবারেই অসম্ভব ছিল। খুব টানাটানির সময়ে অশোক চট্টোপাধ্যায়ের কথামতো তিনি রোজগারের এক অভিনব পন্থা নিয়েছিলেন। একবার ‘শনিবারের চিঠি’-র ত্রয়োদশ সংখ্যায় দেখা গেল এই বিজ্ঞাপন -
টাকার বিনিময়ে ফরমায়েশি কবিতা লিখে দেওয়ার কথা জানিয়ে এ বিজ্ঞাপন একেবারে নজিরবিহীন! পরে অবশ্য গ্রাহকের চেয়ে লেখক হওয়ার আবেদনই এত বেশি পরিমাণে আসতে থাকে যে তিনি ব্যবসা গোটাতে বাধ্য হন। আত্মজীবনী ‘আত্মস্মৃতি’-তে রসিকতার স্বরেই তার বিবরণ দিয়েছেন সজনীকান্ত। পরবর্তীকালে যে সম্পাদকের নাম কিংবদন্তি হয়ে যাবে ব্যঙ্গ, পরিহাস আর তীক্ষ্ণ বিদ্রুপবাণের জন্য, তিনি যে নিজের কর্মজীবন নিয়েও রীতিমতো মশকরায় মাতবেন, এতে আর আশ্চর্য কী!
আরও পড়ুন : গোপাল হালদারকে ‘রকের ছেলে’ বলেছিলেন শম্ভু মিত্র / অর্পণ দাস
***********************************************