সুরের সত্যজিৎ
প্রতিষ্ঠা আচার্য, সৃজিতা সান্যাল
Oct 10, 2020 at 8:04 am
নিবন্ধ
নতুন সংসার পাতার পূর্বলগ্নে লেখা চিঠিতে নায়িকার রবীন্দ্র-অবসেশনকে এমনই কৌতুকস্নিগ্ধ পরিহাসে বিদ্ধ করেছিল ‘নৌকাডুবি’ ছবির নায়ক। রবীন্দ্র-টেক্সটনির্ভর সৃষ্টিতে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথকেই প্লটের অঙ্গ করে নেওয়ার উদাহরণ অবশ্য এটাই প্রথম নয়। প্রৌঢ়ত্বের সীমায় পৌঁছে রবীন্দ্রনাথ যখন প্রায় স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান, তখন নিজেরই লেখা উপন্যাসে উঠতি-কবি নিবারণ চক্রবর্তীকে (যে নাকি নায়কেরই ছদ্ম-পরিচয়) লড়িয়ে দিয়েছিলেন নায়িকার আরাধ্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে। আর মহাজনের সেই পথ ধরেই তৈরি হয়েছে আরও ইতিহাস। সত্যজিৎ রায় নিজেও খানিকটা প্রচ্ছন্নভাবে গ্রহণ করেছিলেন এই টেকনিক। তাঁর ‘চারুলতা’য় অমল তাই কৌতুকের ছলে বৌঠানের সামনে গায় ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে।’ রবীন্দ্রকাহিনি না হলেও, ‘অপুর সংসার’-এর অপু চলমান নৌকায় শুয়ে উদাত্ত গলায় রীতিমতো আবেগ নিয়ে আবৃত্তি করে চলে রবি ঠাকুরের ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’। সুতরাং রবীন্দ্র কাহিনিকেন্দ্রিক ছবি তৈরির সময় সত্যজিৎ যে রবীন্দ্রগানের কথা এবং সুরেরও অভিনব প্রয়োগ ঘটাবেন, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
প্রথমেই আসা যাক ‘ঘরে-বাইরে’তে রবীন্দ্রগান প্রয়োগের প্রসঙ্গে। ১৩১৪-র ১২ অগ্রহায়ণ সাবেকি নিয়ম ভেঙে সুখসায়রের ছোটরানির অন্দর থেকে বাহিরমহলে পা রাখার মুহূর্তটিকে সত্যজিৎ ধরে রাখলেন ‘এ কী লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ’-র সুরে। তবে নিতান্ত প্রথাগত হল না সেই প্রয়োগ। বর্জন করলেন বিস্তারের অংশগুলি। কথা বাদ দিয়ে সাহায্য নিলেন ইন্সট্রুমেন্টালের। গানের চরণগুলির মাঝে সেতারে রাখলেন নিজস্ব কম্পোজিশন।
বিমলার ঘর থেকে বাইরে যাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণটুকু রাবীন্দ্রিক সৌন্দর্য নিয়েই উপস্থিত হল দর্শকের কাছে, যদিও রবীন্দ্রসঙ্গীতে অভ্যস্ত শ্রোতার কাছে লুকোনো রইল না এর অন্যতর চলন।
‘ঘরে বাইরে’-র টেক্সটে সন্দীপ-বিমলার সাক্ষাৎকালে সন্দীপ বিমলাকে শুনিয়েছিল –
আমার নিকড়িয়া রসের রসিক কানন ঘুরে ঘুরে
নিকড়িয়া বাঁশের বাঁশি বাজায় মোহন সুরে।
সন্দীপের ‘ভাঙা মোটা’ গলার কথা মাথায় রেখে সত্যজিৎ কিন্তু এ গানের বদলে ব্যবহার করেন ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’-র মতো বলিষ্ঠ গান। স্বদেশি উন্মাদনার প্রচারক সন্দীপের পৌরুষে ইতিমধ্যেই খানিক আকৃষ্ট মক্ষীরানিকে মুগ্ধ করতে ‘নিকড়িয়া বাঁশের বাঁশি’র মোহন সুরের চেয়ে স্বদেশি গানই যে বেশি উপযুক্ত তা সত্যজিৎ বুঝেছিলেন। এ গানের স্বাদেশিকতা-লগ্ন অর্থ ছাড়া অন্যতর একটি অর্থও এ প্রেক্ষিতে খুঁজে নেওয়া যায়। ‘বিবাহ’কে নারী-পুরুষের দৈবনির্দিষ্ট বন্ধন মনে না করে, আপন উদারতা ও চরিত্রবলে বিমলার প্রেম ‘অর্জন’ করতে চেয়েছিল নিখিলেশ। বিমলার প্রশ্নহীন আনুগত্য বা ভক্তি সে চায়নি। আত্মশক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত এই বাঁধন, অর্থহীন সামাজিক বন্ধনকে নস্যাৎ করা এই বাঁধনই তো নিখিলেশের কাছে ‘বিধির বাঁধন’। তা নষ্ট করার সাধ্য সন্দীপের আপাত-শক্তিশালী স্বার্থান্বেষী পৌরুষেরও নেই - এই অর্থ ধরলে সন্দীপের উচ্চারণকে কি তার বিরুদ্ধেই ফিরিয়ে দেওয়া যায় না? এইভাবে গানের মাধ্যমে ড্রামাটিক আয়রনি তৈরিতেও মুনশিয়ানার পরিচয় রেখে যান সত্যজিৎ।
এরপর আমরা দৃষ্টি দেব, সত্যজিতের ছবির আরও তিন নারী চরিত্রের দিকে। প্রথম দুজন রবীন্দ্রনাথেরই টেক্সট থেকে উঠে আসা – ‘মণিহারা’-র মণিমালিকা এবং ‘নষ্টনীড়’-এর চারুলতা। তৃতীয়জন সত্যজিতের নিজস্ব সৃষ্টি – ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’-র লাবণ্য। ‘মণিহারা’ ছবিতে মণিমালিকার লিপে স্থান পেয়েছে একটি রবীন্দ্রগান। ‘বাজে করুণ সুরে হায় দূরে/ তব চরণপথচুম্বিত পন্থবীণা।’ ‘চারুলতা’ ছবির নায়িকা অবসরযাপনের মুহূর্তে গেয়েছে ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে’, যার অন্তিম পঙ্ক্তি ‘কী জানি কীসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়।’ আর লাবণ্য কাঞ্চনজঙ্ঘার অসীম বিস্তৃতি ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে স্বামীর সঙ্গে কথোপকথনের মাঝে গেয়ে উঠেছে ‘এ পরবাসে রবে কে হায়!’
খেয়াল করুন, এই তিন চরিত্রের লিপে গাওয়া তিনটি আলাদা গানে পুনরাবৃত্ত হয়েছে একটি সাধারণ শব্দ। ‘হায়’! এ কি নিছক সমাপতন? নাকি এই প্রয়োগের তলে তলে কোথাও কাজ করেছিল সত্যজিতের সচেতন ভাবনা?
এবার ভেবে দেখুন, একেবারে ভিন্ন প্রেক্ষাপটের, ভিন্ন মানসিকতার, ভিন্ন রুচির এই তিন নারীচরিত্রের মিল কোনখানে? উত্তর একটাই। স্বামীর সঙ্গে অপরিসীম এবং অনতিক্রম্য মানসিক দূরত্বের সূত্রেই গেঁথে নেওয়া যায় এই তিন আপাত-পৃথক চরিত্রকে। মণিমালিকা এবং চারুলতার বেলায় আমরা সাক্ষী মানতে পারি স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের টেক্সটকেই।মণিমালিকার হৃদয়কে রবীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন ‘ভালোবাসার জ্বালাযন্ত্রণা’হীন ‘বরফের’ ‘হৃৎপিণ্ড’-রূপে।তার বিষয়ে আরও বলেছেন –‘সে কাহারও জন্য চিন্তা করিত না, কাহাকেও ভালোবাসিত না, কেবল কাজ করিত এবং জমা করিত।’ ‘অত্যন্ত নব্যপুরুষ’ ফণিভূষণের সংবেদনশীল ‘সুকুমার চিত্তবৃত্তি’ সে যে ঠিক বুঝতে পারত না – এই তথ্যের উল্লেখ করতেও ভোলেননি লেখক। অন্যদিকে সম্পাদকীয় নেশায় মেতে থাকা ভূপতির কাছে অজ্ঞাত রয়ে গিয়েছিল স্ত্রী চারুলতার যৌবনে পদার্পণের সংবাদ। চারুর অবস্থা স্পষ্ট করতে গল্পকার বলেন – ‘ফলপরিণামহীন ফুলের মতো পরিপূর্ণ অনাবশ্যকতার মধ্যে পরিস্ফুট হইয়া উঠাই তাহার চেষ্টাশূন্য দীর্ঘ দিনরাত্রির একমাত্র কাজ ছিল।’ লাবণ্যর বেলায় উৎস হিসেবে কোনও টেক্সট না থাকায় আমাদের চিত্রনাট্যের শরণাপন্ন হতে হবে। গত কিস্তির পর আমরা আরও একবার চোখ রাখব ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য়। মনীষার মন ঠিক কি চায় – এই প্রসঙ্গে তার বাবা-মায়ের অর্থাৎ ছবি বিশ্বাস করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা কথোপকথন দৃশ্য আমরা মনে করে নেব।
মনীষার বাবা: আমার পিতৃদেব যখন আমার বিবাহ স্থির করেছিলেন, তখন তো কই আমি কোনো আপত্তি করিনি। এমনকি কোনও রিগ্রেটও করিনি, তুমি করেছিলে নাকি?
লাবণ্য: ঠিক আছে।
একটা ছোট্ট ‘ঠিক আছে’ই যেন তার নিচে চাপা পড়া সমস্ত না-পাওয়া, সমস্ত অভিমান, ভালো থাকতে চাওয়া আর ভালো থাকতে না পারার সমীকরণকে তুলে ধরে। তারপরেই লাবণ্যের গেয়ে ওঠা – ‘এ পরবাসে রবে কে?’। ঠিক যে মুহূর্তে ‘এমন আপন কেহ নাই’ উচ্চারিত হয়, মুখ ঢেকে যায় গাঢ় কুয়াশায়। না, লাবণ্য চরিত্রের সংলাপ বেশি নেই। অভিব্যক্তিও চাপতে চাপতে একরকম নিস্তরঙ্গ মুখচ্ছবিই সমস্তটা জুড়ে। শুধু একটা ‘ঠিক আছে’ আর একটা গান তার সারাজীবনের জার্নির বিষণ্ণতাটুকুর খবর আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। একইরকমভাবে, ‘চারুলতা’র ‘কী জানি কিসের লাগি প্রাণ করে হায় হায়’ উচ্চারণে চাপা থাকেনি চারুর দীর্ঘশ্বাস। এই হাহাকারের সূত্রেই এক হয়ে যায় লাবণ্য ও চারুলতা। চিনে নেওয়া যায় চারু-ভূপতির সম্পর্কের মাঝে ‘কিছু না-থাকা’র সেই ঊষর জমিকে, যে মাটিতে খুব ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে অঙ্কুরিত হবে অমল-চারুর সম্পর্ক-আখ্যান। আর একদিকে, ‘বাজে করুণ সুরে’র দীর্ঘ ‘হায়’ মণিমালিকার অতৃপ্ত হৃদয়কে ব্যঞ্জিত করবে, যে অতৃপ্তি তাকে বস্তুগত ভোগবাসনায় ক্রমেই আষ্টেপৃষ্টে জড়ায়। আবার এই মণিমালিকাই যখন কঙ্কালরূপিণী হয়ে দেখা দেবে, তখন অস্থিময় হাতের অতিলৌকিক দৃশ্যে জাইলোফোন আর ভাইব্রোফোনের ব্যবহার করবেন সত্যজিৎ।
রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর সুরকে যদি আমরা সত্যজিতের ছবির একটি রেকারেন্ট মোটিফ হিসেবে ধরি তবে, সে মোটিফ ফিরে এসেছে গুপীর গানেও। তবে সরাসরি নয়। খুব প্রচ্ছন্নভাবে। সত্যজিতের তৈরি প্রথম স্বাধীন গান ‘চিড়িয়াখানা’য় - ‘ভালোবাসার তুমি কী জান?’। কথা এবং সুর দুইই তাঁর স্বরচিত। বনলক্ষ্মী চরিত্রের পূর্বজীবনকে জীবন্ত করে তুলতে ‘চিড়িয়াখানা’য় তার অভিনীত বিষবৃক্ষ ছবির একটি ক্লিপিং রাখা হয়েছিল। সেখানেই বনলক্ষ্মী ওরফে মিস সুনয়না দেবীর লিপে ছিল এই গানটি। পুরনো দিনের বাংলা ছবিতে এই গানের প্রয়োগকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক আর বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পুরাতনী বাংলা গানের ধাঁচটিকে সচেতনভাবে মাথায় রেখে গানটি তৈরি করেছিলেন পরিচালক।
ফিরে পড়ূন
আর এই গানই হয়তো সত্যজিৎকে সাহস জুগিয়েছিল গুপীর গান লেখার সময়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সত্যজিৎ প্রথমে গুপীর গানগুলো তৈরি করেন। সেই গানগুলো পছন্দমতো তৈরি হলে তারপর তিনি সিনেমা তৈরির কথা ভাবেন। গুপী-বাঘা সিরিজের তিনটি ছবিরই সুরকাঠামো লক্ষ করলে দেখা যাবে, বাংলার লৌকিক গায়ন রীতি, দেশি বিদেশি মার্গ সংগীত, কর্ণাটিক ধ্রুপদী সুরচলনের ছোঁয়াচ ছাড়াও টিপিক্যাল রাবীন্দ্রিক স্পর্শস্বর, মীড় কিংবা গমকের ব্যবহার খুব স্পষ্ট। এমনকি বিথোফেনের নাইন্থ সিম্ফনির প্রেরণায় তৈরি ‘কেমন বাঁশি বাজায় শোনো’ শুনে কিংবা ‘ওই যে দ্যাখো দিনের আলো ফোটে’ শুনে কোনও দর্শক চকিতে রবীন্দ্রসুরের অনুষঙ্গ খুঁজে পেতে পারেন। অথচ সেই প্রাথমিক বিস্ময়টুকু কাটিয়ে এ সব গানে সত্যজিতের ভরপুর স্বকীয়তার বিস্ময়টুকুও আবিষ্কার করা খুব কঠিন হয় না। ছোটো থেকেই যে সত্যজিৎ পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সংগীত শুনতে অভ্যস্ত, বাখ-বিথোফেন-মোৎজার্ট থেকে রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মসংগীত যাঁর অনায়াস যাতায়াত, তাঁর পক্ষেই সম্ভব ছিল এমন সুরব্যবহার। “I have definitely set a style of singing which does not come from Tagore, does not come from western music, but which is essentially me.” সত্যজিতের নিজের এই উক্তির যাথার্থ্য বুঝে নেওয়া কঠিন হয় না গুপী-বাঘার গান শোনার পর। এই ‘Essentially সত্যজিৎ’-সংগীতের আড়ম্বরহীন কথার বাহন হিসেবে যে সুর তিনি তৈরি করেছেন তাঁর মধ্যে এক আশ্চর্য স্বাভাবিকতা রয়েছে। রয়েছে সাবলীল চলন। কিছু জায়গায় খানিক অপেরাধর্মী। একধরনের টাটকা সবুজতা। যা গুপী বাঘার প্রাণখোলা চরিত্রকেই ফুটিয়ে তোলে।
সত্যজিতের ছবিতে আরও একধরনের গান ফিরে ফিরে আসে। তা হল পুরাতনী বাংলা সংগীত। কখনও কখনও লোকসংগীত। কোনও গানই সত্যজিতের ছবিতে নিছক বিনোদন হিসেবে আসেনি। তিনি বরাবর সুরকে অন্যতম সিনেম্যাটিক টুলে পরিণত করেছেন। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর এবং গান সিনেমাগুলির একটি বিকল্প ভাষ্য তৈরি করে দিয়েছে। দৃশ্যাতীত বা শব্দাতীত কোনো বিকল্প পাঠ রচনা করেছে বারবার। এই পুরাতনী গানগুলোয় মূলত ধরা পড়েছে এক একটা বিশেষ সময়ের চারিত্র্য, যা পিরিয়ড-পিস হিসেবে ছবিগুলিকে সাফল্যের দিকে নিয়ে গেছে। ‘দেবী’ সিনেমায় প্রচলিত রামপ্রসাদী সুরে কথা বসান সত্যজিৎ। ‘এবার তোরে চিনেছি মা’-ই সত্যজিতের লেখা প্রথম লিরিক। সন্দীপের বক্তৃতা শোনার পর মিস গিলবির কাছে গান-শেখা বিমলার গলায় শোনা যায় বৈষ্ণব পদ ‘ঢল ঢল কাঁচা অঙ্গের লাবনি’। ‘চারুলতা’য় সত্যজিৎ ব্যবহার করেন রামমোহনের লেখা ‘মনে করো, শেষের সে দিন ভয়ংকর’। তাঁর অনুরোধেই অনভিনেতা গ্রাম্য বৃদ্ধ আশাবরি রাগে বাঁধা স্বরচিত গানকে পেশাদার গায়কসুলভ স্বতঃস্ফূর্ততায় পূরবীর ঠাটে গেয়ে ফেলেন। আর সেই দৃশ্যকেই শ্রেষ্ঠ পরিচালকের দক্ষতায় ‘পোস্টমাস্টার’ ছবির জন্য ক্যামেরাবন্দি করেন সত্যজিৎ। ‘সমাপ্তি’তে অমূল্যর ঘরে গ্রামাফোন রেকর্ডে বাজতে শোনা যায় নজরুলগীতি – ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মনে, পানিয়া ভরনে চল লো গোরী’, যে সুর অমূল্য নিজেও পরে আপনমনে গুনগুন করেছে। ‘চিড়িয়াখানা’র অন্তর্গত ‘বিষবৃক্ষ’ ছবির ক্লিপিংয়ে কমলমণির পূর্বোল্লিখিত গানটিও যে পুরনোদিনের বাংলা ছবির স্বাদ সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছে, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।
সবশেষে ‘অপু ট্রিলজি’র একটি গানের ব্যবহার নিয়ে কথা বলে আমরা ইতি টানব ‘সুরের সত্যজিৎ’-এর এই যাত্রায়। ‘পথের পাঁচালী’তে দুর্গার মৃত্যু-সংবাদের সাইলেন্স তো বহুচর্চিত। আমরা বরং চোখ রাখব ‘অপুর সংসার’-এ। অপু-অপর্ণার ফুলশয্যার দৃশ্য। অদেখা অপরিচিত আপনজনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়। এই মধুর মুহূর্তে বাইরে থেকে কিন্তু ভেসে আসে ভাটিয়ালির বেদনামথিত সুর ‘আগে যদি জানতাম রে বন্ধু যাবে রে ছাড়িয়া, ও বন্ধু রে’। এ যেন অপুর পরিণতির নাটকীয় পূর্বাভাস। আবার পাঁচবছর পর অপু ঢুকছে সেই একই ঘরে, সেই একই পালঙ্ক। আবারও, খাটের কোণায় শুয়ে কোনোদিন না-দেখা এক আপনজন। এবং আবারও ধুয়োর মতো সেই একই গানের পুনরাবৃত্তি। হয়তো বা স্মৃতিরই অনুরণন। যে তিনটে মানুষের, সবচেয়ে আপন যে তিনটি মানুষের একসঙ্গে দেখা হল না… হবেও না কোনওদিন… ‘ও বন্ধু রে’ গানের হাহাকার তাদের যেন এক অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে দেয়।
[ সমস্ত ছবি অন্তর্জাল থেকে প্রাপ্ত ]
[ কভারে সত্যজিৎ রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস ]