রায় ও রুশদি: এক ব্যতিক্রমী সমীকরণ
হিরে মানিক জ্বলে : অষ্টম পর্ব
একদিন বিকেলে হঠাৎ সলমন রুশদি এসে হাজির। মানিকের দারুণ ভক্ত, কলকাতায় এসে মানিক নেই শুনেই কোথায় আছেন জেনে খুঁজে খুঁজে এসেছেন। অনেকক্ষণ মানিকের সঙ্গে কথা বললেন। উনি অবশ্য সেদিনই ফিরে গিয়েছিলেন। -বিজয়া রায়, আমাদের কথা
একলব্যকে মনে আছে? অসামান্য প্রতিভাশালী সেই নিষাদ বালক জীবনের প্রথম পর্যায় থেকেই গুরু হিসেবে বরণ করে নিয়েছিল দ্রোণাচার্যকে। নিম্নজাতে জন্মগ্রহণের কারণে দ্রোণাচার্যের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য থেকে বঞ্চিত হলেও তাঁর মূর্তিকে গুরু মেনে সে অভ্যাস করেছিল ধনুর্বাণ চালনা। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সলমান রুশদির সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে গেলে অবধারিতভাবে মনে পড়ে যায় একলব্যের কথা। ইমাজিনারি হোমল্যান্ডস গ্রন্থে ‘সত্যজিৎ রায়’ শীর্ষক নিবন্ধটিতে রুশদি নিজেই জানাচ্ছেন, ছাত্রাবস্থার বেশ খানিকটা পার করে ফেলার পরেও পথের পাঁচালী দেখা হয়নি তাঁর, অবশেষে দেখতে যান এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে, এবং দেখামাত্র তাঁকে গ্রাস করে অপার মুগ্ধতা। সিনেমায় নিওরিয়ালিজম বা নব্যবাস্তবতার উদ্ভবের ইতিহাসে রেনোয়া, ত্রুফো, আন্তোনিওনির পাশাপাশি যে লেখা থাকবে সত্যজিৎ রায় নামে এক ভারতীয়ের নামও, এই ভাবনা বিশেষভাবে পুলকিত করেছিল তাঁকে। অবিলম্বে সত্যজিতের অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়েন রুশদি, পরপর দেখে ফেলেন তাঁর সবকটি ছবি। চিত্রনগরী বম্বেতে জন্মগ্রহণ করবার ফলে হিন্দি ছবির প্রতি রুশদির বিশেষ দুর্বলতা থাকলেও সত্যজিতের প্রতি বম্বের শীতল ও দ্বন্দ্বমূলক মনোভাবের তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি। সবচেয়ে বড় কথা, নিজ উদ্যোগে গিয়ে সামনাসামনি দেখা করেছেন সত্যজিতের সঙ্গে। কলকাতায় এসে সত্যজিতের দেখা তিনি পাননি, কারণ তখন ইউনিটের সঙ্গে চকদিঘিতে ঘরে বাইরে ছবির আউটডোর শুটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন সত্যজিৎ। রুশদি চকদিঘিতে আসেন, এবং প্রাণভরে বাক্যালাপ করেন তাঁর প্রিয় পরিচালকের সঙ্গে। তাঁর নিবন্ধ থেকে জানা যায়, তিনি সত্যজিৎকে বলেন, পথের পাঁচালী দেখে প্রথম আকৃষ্ট হলেও রুশদির অধিকতর পছন্দ গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ প্রভৃতি ছোটদের ছবিগুলি।
নজরে থাকুকঃ হিরে মানিক জ্বলে (সপ্তম পর্ব)
মনোযোগী পাঠকমাত্রই বুঝবেন, রুশদির একাধিক সাহিত্যকর্মে সত্যজিতের প্রভূত প্রভাব আছে। ভাষার সমস্যার কারণে সত্যজিতের কাজকর্মের সীমিত অংশে প্রবেশাধিকার থাকলেও তা গভীর ছাপ ফেলেছে রুশদির মননে। তাঁর মিডনাইট’স চিলড্রেন উপন্যাসের নায়ক সলিম সিনাইয়ের সঙ্গে অপু চরিত্রটির যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে, দু-জনের কাহিনিতেই মানবচেতনার ক্রমবিকাশ তথা বিলডুংসরোমান রচনাধারাটি নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা লক্ষ করা যায়। অপুর মতোই সলিমের জীবনে অনিবার্য হয়ে ওঠে ক্রমাগত স্থান পরিবর্তন, এবং অপু ট্রিলজি ও মিডনাইটস চিলড্রেন - উভয়েই ব্যক্তিজীবনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শেষ অবধি ভারতীয় উপমহাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পট পরিবর্তনের দলিল হয়ে ওঠে। তবে সত্যজিতের সর্বাধিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায় রুশদির কিশোর উপন্যাস হারুন অ্যান্ড দ্য সি অফ স্টোরিজ গ্রন্থে। মজার বিষয় হল, সত্যজিতের ফটিকচাঁদ গল্পেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রের নাম হারুন। যদিও রুশদি ফটিকচাঁদ বইটির কাহিনি জানতেন না। কিশোর হারুনের বাবা পেশায় গল্প-বলিয়ে ও চিকিৎসাবিদ, অপুর পিতা হরিহরের পেশাও কিন্তু ছিল কথকতা ও কবিরাজি। বইতে গুপ ও চুপ রাজ্যের বিরোধের বৃত্তান্তের অনুষঙ্গে গুপী গাইন বাঘা বাইন ছবির শুণ্ডী ও হাল্লার কথা মনে পড়ে যেতে বাধ্য, চুপ রাজ্যের বাসিন্দাদের মতোই গুপী ও বাঘা আসবার আগে শুণ্ডীর নাগরিকরাও ছিল মূক। হারুন অ্যান্ড দ্য সি অফ স্টোরিজ গল্পটি প্রকৃতপক্ষে রূপকথার মোড়কে একনায়কতন্ত্র ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও চিত্তমুক্তির কাহিনি, যার মূল গঠন হীরক রাজার দেশে ছবির কাছে অনেকটাই ঋণী। সর্বোপরি, কিশোর নায়ক হারুনের অভিযানে সঙ্গী হয় গুপী ও বাঘা নামের দুটি শুশুক। তাদের অন্ত্যমিল দিয়ে কথা বলা মনে করিয়ে দেয় হীরক রাজার দেশের চরিত্রগুলির ছন্দে বাক্য সাজানোর অভ্যেসকে।
রুশদির সাম্প্রতিকতম উপন্যাস দ্য গোল্ডেন হাউস গ্রন্থের একটি প্রধান চরিত্রের নাম অ্যাপুলিয়াস, সংক্ষেপে অপু। সত্যজিতের নায়কের মতোই সে সংবেদনশীল মননের অধিকারী। সত্যজিতের তথাকথিত ‘সিরিয়াস’ ছবিগুলিতে নিহিত নাগরিক জীবনের বিশ্লেষণ ও গভীর জীবনবোধ, এবং ছোটদের ছবিগুলির রূপকধর্মী গঠন - উভয়েই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে রুশদির শিল্পে। আধুনিক জীবনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাগুলি অতিক্রম করে যে মানবতার বার্তা সত্যজিৎ দিয়েছেন তাঁর ছবিতে, উত্তরাধুনিক সমাজব্যবস্থা পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সেই একই মানবতার কথা উঠে এসেছে রুশদির সাহিত্যে, তার প্রকাশরীতি আলাদা হলেও প্রকৃতি অভিন্ন। তবে আফসোস একটাই, ভাষার কারণে ও উপযুক্ত অনুবাদের অভাবে শিল্পীজীবনের গড়ে ওঠার কালে রুশদির পক্ষে সত্যজিতের সাহিত্য পড়া সম্ভব হয়নি। তেমনটা হলে সত্যজিতের রচনাশৈলী থেকেও যে শিল্পসৃষ্টির প্রচুর রসদ পেতেন তিনি, একথা হলফ করে বলা যায়।
*[কভারে সত্যজিত রায়ের বিভিন্ন সময়ে আঁকা ছবি ও অলংকরণ ব্যবহৃত হয়েছে। কভার ডিজাইন : অর্পণ দাস]