নিবন্ধ

রে কামিংস: পাল্প কল্পবিজ্ঞানের বিস্মৃত নায়ক (প্রথম কিস্তি)

সুদীপ চ্যাটার্জী Nov 13, 2021 at 5:06 am নিবন্ধ

“The only reason for time is so that everything doesn’t happen at once.”


উক্তিটি সর্বজনবিদিত, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রচলিত ধারণা, কথাটা বলেছেন স্বয়ং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। কিন্তু গুগল খুলে ফ্যাক্ট চেক করলেই সেই ধারণা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। শুধু আইনস্টাইন কেন, গত এক শতাব্দীতে এই উক্তির জনক হিসেবে নাম উঠে এসেছে প্রবাদপ্রতিম বৈজ্ঞানিক, জনপ্রিয় শিল্পী ও বিখ্যাত দার্শনিকদের। মার্কিন পদার্থবিদ রিচার্ড ফেইনম্যান ও জন আর্চিবল্ড হুইলারের মতো বৈজ্ঞানিক তো বটেই, আধুনিক রোমান্টিক কমেডির জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক উডি অ্যালেনের সঙ্গেও এই উক্তির যোগস্থাপন করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু আদতে তাঁরা কেউই এই কথাটা বলেছেন বলে প্রমাণ করা যায়নি। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, এই উক্তিটির কাছাকাছি একটি সংলাপ আসলে ব্যবহার করা হয়েছিল সম্ভবত ১৯১৯ সালে প্রকাশিত একটি ছোটগল্পে।


“Time is what keeps everything from happening at once.”


গল্পের নাম— ‘দ্য টাইম প্রোফেসর’ এবং পত্রিকাটি ছিল ‘আরগোসি’ ( Argosy) অল স্টোরি উইকলির জানুয়ারি সংস্করণ। লেখকের নাম সম্ভবত পাঠকরা অনুমান করতে পারছেন। হ্যাঁ, গল্পের লেখক রেমন্ড কিং কামিংস। সংক্ষেপে রে কামিংস। মার্কিন কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রের আড়ালে দাঁড়িয়ে যিনি নীরবে এই জগতের ভিত মজবুত করে গেছেন।



কামিংস-এর লেখক জীবন ও সাহিত্য ধারণা সম্পর্কে আলোচনা করার আগে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কল্পবিজ্ঞান ও পাল্প সাহিত্যের বিবর্তন নিয়ে কিছু কথা বলে নেওয়া দরকার। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে ইউরোপিয়ান ও মার্কিন সাহিত্যে মাঝে মধ্যে বিজ্ঞানের পরোক্ষ প্রভাব দেখা যাচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু সাহিত্যের তাত্ত্বিক আলোচনায় বিজ্ঞানভিত্তিক রচনাকে তেমন আমল দেওয়া হয়নি। এমনিতেও সে যুগে ইউরোপ অথবা বলা ভালো ব্রিটেনের বাইরের ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে সমালোচকরা বিশেষ মাথা ঘামাতেন না, ফলে ব্যতিক্রমী লেখা তেমন পাত্তাও পেত না। অষ্টদশ শতাব্দীর শেষ দিকে প্রবর্তিত ‘ইংলিশ রোমান্টিক মুভমেন্ট’ নিয়ে তখন সাহেবসুবোরা উচ্ছ্বসিত। বৈজ্ঞানিক কর্মকান্ড নিয়ে লেখা অধিকাংশ লেখা ‘ট্র্যাশ’ বলে প্রতিপন্ন করে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেওয়া হত। কিন্তু আচমকা একটা বই এসে সমস্ত কিছু বদলে দিয়ে গেল।

১৮১৮ সালে ম্যারি শেলির লেখা ‘ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন’ প্রকাশ পাওয়া মাত্র সাহিত্য জগতে ঝড় তুলে দিল। আলোচনা-সমালোচনার বান বয়ে গেল লন্ডনের কফি হাউসগুলোতে। গোথিক হরর জঁরের কোনো উপন্যাসে যে বিজ্ঞান মূল উপাদান হয়ে উঠতে পারে, সে কথা কেউ ভাবতেও পারেনি। ‘ফ্র্যাঙ্কেস্টাইন’ এসে সে ভাবনায় প্রয়োজনীয় ইন্ধন জোগাল। পরবর্তী কয়েক দশকের মধ্যেই ইউরোপ ও আমেরিকার পাঠকদের আগ্রহ এমন বেড়ে গেল যে সংবাদপত্রে বিজ্ঞান সম্পর্কিত প্রতিবেদন ছাপতে উদ্যোগী হলেন সম্পাদকরা। শিল্প বিপ্লবের ফলে ইতিমধ্যেই অভিজাত বর্গে যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তার উপর উনবিংশ শতাব্দীতে নিত্য নতুন আবিষ্কার হচ্ছে। গ্রামোফোন, টাইপরাইটার, ব্যাটারি, স্টেথোস্কোপ, দেশলাই, স্টিম এঞ্জিন, এয়ারশিপ ইত্যাদি আবিষ্কারের খবর ফলাও করে ছাপা হতে লাগল। 

পাঠকদের তুমুল চাহিদা দেখে সাহিত্য পত্রিকাগুলোও নড়েচড়ে বসল। বিশেষ করে আমেরিকায় কসমোপলিটন, সেঞ্চুরি, হার্পর্স, অ্যাটলান্টিক মান্থলি, স্যাটারডে ইভিনিং পোস্ট-এর মতো জনপ্রিয় পত্রিকাগুলোয় প্রকাশ পেতে লাগল যান্ত্রিক কৌশল ও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের গল্প। ন্যথানিয়াল হথর্ন, এডগার অ্যালান পো, এডওয়ার্ড বেলামি, অ্যামব্রোস বিয়ার্স বা ফিটজ-জেমস ও ব্রায়ানের মতো অনেকেই মার্কিন কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের এই ‘গ্রাউন্ডওয়ার্ক’ করতে এগিয়ে এসেছিলেন। 


কিন্তু বিজ্ঞানভিত্তিক ফ্যান্টাসি নিয়ে প্রথম যে ব্যাক্তি নিবেদিত ভাবে সাহিত্য চর্চা করতে শুরু করলেন, তার নাম জুলে ভার্ন। জাতে ফরাসি। ‘ফাইভ উইকস ইন আ বালুন’, ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’, ‘টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সি’ ও ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ লিখে জুলে ভার্ন অভাবনীয় সাফল্য পেলেন সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হল ‘Voyages Extraordinaires’ ধারার এই লেখাগুলো আগামী কয়েক দশকের কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের মূল রূপরেখা তৈরি করে দিল। 

ইতিমধ্যেই ব্রিটেনের কল্পবিজ্ঞানের জগতে আর এক তারকা আত্মপ্রকাশ করেছেন। প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন এই ব্যাক্তি নিজেই বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন। স্বভাবতই তাঁর লেখায় বৈজ্ঞানিক ভুল বড় একটা থাকত না। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, গল্পের গতির সঙ্গে বিন্দুমাত্র আপস না করেও তিনি মাঝে মধ্যে নিঁখুত ‘সোশাল কমেন্টারি’ করতেন, আবার প্রয়োজনে বিজ্ঞানের অন্ধকার দিকগুলো তুলে ধরতেও পিছপা হতেন না। তাঁর নাম হারবার্ট জর্জ ওয়েলস। মার্কিন পাল্প সাহিত্যের উত্তরসূরিরাও যে এই দুই ধারার সাহিত্য পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন, সে নিয়ে তর্কের অবকাশ বিশেষ নেই। 

সময়টা উনবিংশ শতাব্দীর শেষ। আমেরিকায় শিক্ষার হার উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে জনসংখ্যা। তিরিশ বছরে দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই বিপুল সংখ্যক জনতার অধিকাংশের কাছেই বিনোদনের জন্যে সস্তা সাধন বলতে প্রায় কিছুই ছিল না। সিনেমা আসতে তখনও দেরি আছে। ম্যাকলুয়ার ম্যাগাজিন আর হার্পর মান্থলির মতো ‘স্লিক’ পত্রিকাগুলো সাধারণত সমৃদ্ধ বর্গকে উদ্দেশ্য করেই ছাপানো হত, সাধারণ মানুষের এই চকচকে কাগজের পত্রিকার জন্যে নির্ধারিত দাম দিতে সক্ষম ছিল না। 

এমন সময় ফ্র্যাঙ্ক এ মান্সি এসে এক যুগান্তকারী কান্ড ঘটিয়ে ফেললেন। সস্তা ‘উডপাল্প’-এর কাগজে আত্মপ্রকাশ করল ‘আরগোসি’ পত্রিকা, দাম মাত্র পাঁচ সেন্ট। কিন্তু এই পত্রিকা যে ‘পাল্প’ সাহিত্য বিপ্লবের সূচনা করবে, সে কথা সম্ভবত ফ্র্যাঙ্ক মান্সি নিজেও ভাবেননি। মান্সি সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত ছিলেন, ‘স্লিক’ পত্রিকার লেখকদের সঙ্গেও তার পরিচিতি বড় কম ছিল না। নীরবে তিনি এই সস্তা পত্রিকাটি চালিয়ে যেতে লাগলেন। প্রথমে আট পাতা, তারপর ষোল পাতা, ‘আরগোসি’-র আয়তন ক্রমে বাড়তে শুরু করল। 

মান্সি আন্দাজ করেছিলেন, সাধারণ মানুষের জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব বাড়তে থাকলে সাইন্স ফ্যান্টাসির ঘরানা ক্রমে আরো জনপ্রিয় হবে, সুতরাং তিনি প্রথম থেকেই কল্পবিজ্ঞানের লেখা ছাপানোর দিকে জোর দিয়েছিলেন। প্রাপ্তবয়স্কদের পাশাপাশি অল্পবয়সীদের জন্যেও গল্প লিখতেন লেখকরা। ততদিনে প্রকাশনা জগতে প্রযুক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে, পাশাপাশি বিজ্ঞাপনের ব্যবহারও শুরু হয়েছে। দাম কম হওয়ায় পাল্প পত্রিকার চাহিদা বেড়েছে, অন্যদিকে ‘মাস ডিস্ট্রিবিউশন’- এর নিত্যনতুন কৌশল এসে লগ্নির খরচ কমিয়ে দিয়েছে। দশ বারো বছরের মধ্যেই দেখা গেল, পাল্প ম্যাগাজিনের জনপ্রিয়তা চিরাচরিত ‘স্লিক’ পত্রিকাকে টক্কর দিতে শুরু করেছে।

১৯০৪ সালে আরগোসি-র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে মাঠে নেমে পড়ল স্ট্রিট অ্যান্ড স্মিথ। জবাব দিতে মান্সি ‘আরগোসি অল স্টোরি এডিশন’ বলে আরেকটি পত্রিকা শুরু করে দিলেন। এর পর পাল্প ম্যাগাজিনের বন্যা বয়ে গেল। বিষয়ভিত্তিক পত্রিকাও প্রকাশ হতে লাগল, পাল্প সাহিত্যের জোয়ার গিয়ে লাগল ব্রিটেনেও। আমেরিকাতে সে সময় সীমাহীন উন্মাদনা চলছে পাল্প ম্যাগাজিন নিয়ে, সার্কুলেশনও বাড়ছে চড়চড় করে। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই পাল্প সাহিত্য সে যুগের ‘পপ কালচার’-এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠল। 

এমন সময়, ১৯১২ সালে অল স্টোরি ম্যাগাজিনের পাতায় ধারাবাহিক রচনা হিসেবে প্রকাশিত হতে শুরু করল একটি কল্পবিজ্ঞান ফ্যান্টাসি উপন্যাস, নাম ‘আ প্রিন্সেস অফ মার্স’। এই লেখা দিয়েই আত্মপ্রকাশ করলেন এডগার রাইস বারোস, যিনি এর পর ‘টারজন’ আর ‘বারসুম’ সিরিজ লিখে পাঠকদের মন জয় করে নেবেন। ঘটনাটা জরুরি, কারণ বারোস যদি কল্পবিজ্ঞান লিখতে না আসতেন, সম্ভবত রে কামিংসের লেখার সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হত না।

এইবার রে কামিংস-এর প্রাথমিক জীবন নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। অবশ্য বলার মতো বিশেষ কিছু নেই, কারণ কামিংস নিজেকে সর্বদা রহস্যের আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করতেন। কল্পবিজ্ঞান পাল্প সাহিত্যের কথা বলতে হলে, তাঁর সমসাময়িক দুই বেস্টসেলিং লেখক ছিলেন অ্যাব্রাহাম গ্রেস মেরিট ও এডগার রাইস বারোস। তারা মাসে মাসে সাক্ষাৎকার দিতেন, লেখক জীবনের অনুপ্রেরণা অথবা মজার অভিজ্ঞতার কথা ফলাও করে বর্ণনা করতেন, ইন্টারনেট ঘাঁটলে রাশি রাশি তথ্য দেখতে পাওয়া যায়। তুলনায় কামিংসের সঙ্গে পাঠকদের পরিচয় ছিল তাঁর লেখার সূত্রে। ব্যাক্তি জীবনে রে কামিংস কী ধরনের মানুষ ছিলেন, সেই সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না।

বিস্তর খোঁজাখুজির পর কামিংসের একটা সাক্ষাৎকারের খবর পাওয়া গেল। ১৯৪৮ এই সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন থাইরিল এল ল্যাড নামে এক সাংবাদিক। সেই ‘ইন্টারভিউ স্ক্রিপ্ট’-এর উপর নির্ভর করে এরিক এস রুপরেক্ট ‘ডিকশনারি অফ লিটারারি বায়োগ্রাফি’-তে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখান থেকে জানা যায় কে কামিংস কোনোদিনই সামান্য লেখকদের মতো জীবনযাপন করেননি। জীবনের প্রতি তাঁর মনোভাব অন্যরকম ছিল। 

১৮৯৭ সালে নিউয়র্কের এক বিত্তশালী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন রে কামিংস। ছাত্র হিসেবে মেধাবী ছিলেন, কিন্তু তাঁকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করত অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি। ষোল বছর বয়সে তিনি মাস দুইয়ের জন্যে প্রিন্সটন উইনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলেন, কিন্তু পড়া শেষ করার আগেই তিনি পরিবারের সঙ্গে পুয়ের্তো রিকো চলে যান। 

রে কামিংসের বাবার কমলালেবুর বাগান ছিল সেখানে, পুয়ের্তো রিকো থেকে জাহাজে করে নিউ ইয়র্কে কমলালেবু রপ্তানি করা হত। কিশোর রেমন্ড ভাইয়ের সঙ্গে সে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, সারা দিন পাল্প ম্যাগাজিন হাতে কমলালেবুর ফার্মে কাটিয়ে দিতেন তিনি। বলা বাহুল্য, এডগার রাইস বারোসের লেখা তাঁর সবচেয়ে বেশি প্রিয় ছিল। 

পুয়ের্তো রিকো থেকে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকার ওয়াওমিং রাজ্যে চলে আসেন তিনি। ‘অয়েল এক্সপ্লোরেশন’-এর কাজ শুরু করেছিলেন তাঁর বাবা, কাঁচা তেল তুলে রপ্তানি করার কাজে লেগে পড়লেন কামিংসও। ওয়াওমিং রাজ্যের সমস্তটাই জঙ্গল আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা, লোকজন বিশেষ নেই। ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্কে ঘুরে বেড়াতেন রে কামিংস, প্রয়োজনে তেলের খোঁজে নদীখাতে ক্যাম্প করেও থাকতে হত। আজও ওয়াওমিং রাজ্যের নির্জন, জনশুন্য অঞ্চল দেখে মনে হয়, পৃথিবীর সঙ্গে এখানকার ভুদৃশ্যের কোনো সাদৃশ্য নেই। ভিন্নগ্রহের প্রাকৃতিক দৃশ্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে ওয়াওমিং রাজ্যের স্মৃতি কামিংসের মাথায় ছিল কি না জানা নেই, কিন্তু এখানকার বিস্তীর্ণ ঊষর প্রান্তর আর প্রাকৃতিক বৈচিত্র যে তাঁর মনে বরাবরের মতো গাঁথা হয়ে গিয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

ওয়াওমিং থেকে ফিরে কামিংস বৈজ্ঞানিক থমাস আলভা এডিসনের সহকারী হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। সেটা ১৯১৫ সাল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকার সামরিক বাহিনীকে পরামর্শ দেওয়ার জন্যে এডিসন একটা ‘সাইন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি কমেটি’ গড়ে তুলেছেন, হাতে একগাদা গুরুদায়িত্ব। নানা বিষয়ে বৈজ্ঞানিক আলোচনা হয়, সে সমস্ত প্রত্যক্ষ করেন কামিংস। পরবর্তী পাঁচ বছর সেখানেই একটানা কাজ করলেন তিনি। এর মধ্যে বিজ্ঞান সম্পর্কে তাঁর একটা সম্যক ধারণা গড়ে উঠেছে। 

১৯১৯ সালে অল স্টোরি উইকলি পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয় রে কামিংসের প্রথম উপন্যাস— ‘দ্য গার্ল ইন দ্য গোল্ডেন অ্যাটম’। এর আগেও দু’ একটা গল্প লিখেছেন কিন্তু এই উপন্যাস লেখার পর থেকেই রে কামিংস নিয়মিত ভাবে পাল্প পত্রিকায় লেখালিখি শুরু করে দেন। ‘দ্য গার্ল ইন দ্য গোল্ডেন অ্যাটম’ যে পাঠক মহলে খুব একটা সাড়া ফেলেছিল তা নয়, কিন্তু এই নবীন লেখকের কলম চিনতে অভিজ্ঞ সম্পাদকরা ভুল করেননি। কয়েকদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হয় এই উপন্যাসের সিকোয়েল, কামিংস সেই উপন্যাসের নাম দিলেন ‘পিপল অফ দ্য গোল্ডেন অ্যাটম।’ 

এইবার অনেকেই নড়েচড়ে বসল। প্রথম দু’টো উপন্যাসের প্লট অসাধারণ কিছু নয়, ‘মিনিয়েচারাইজেশন’ নিয়ে লেখা ‘ক্লাব স্টোরি’ বলাই যুক্তিসঙ্গত। এক যুবক অত্যাধুনিক মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে আংটির ভিতর এক সূক্ষ্ম জগতের সন্ধান পায়। তারপর যথারীতি সে নিজের তৈরি ‘মিনিয়েচারাইজেশন ড্রাগ’ তৈরি করে সেই জগতে ঢুকে পড়ে। এই নতুন দুনিয়ায় সেই যুবকের অ্যাডভেঞ্চার কাহিনী নিয়ে লেখা হয়েছে প্রথম বইটি। যতটা না বিজ্ঞান, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘অ্যাকশন’! কিন্তু কামিংস যে দক্ষতায় এই সাধারণ গল্পকে অসাধারণ করে তুলেছেন, তার কোনো জবাব নেই। লেখা শেষ না করে ওঠা প্রায় অসম্ভব! পাল্প ফিকশনের জগতে তখন ভয়ানক প্রতিযোগিতা, ‘পেজটার্নার’ না হলে পাঠককে ধরে রাখা অসম্ভব। সুতরাং এই নবীন লেখকের কাছ থেকে নতুন লেখা পেতে একাধিক পাল্প পত্রিকার সম্পাদকরা এগিয়ে এলেন।

রে কামিংস পরবর্তী চল্লিশ বছর ধরে ক্রমাগত লিখে গেছেন, যদিও চারের দশকের পর তিনি লেখা অনেক কমিয়ে দিয়েছিলেন। ‘ম্যাটার, স্পেস অ্যান্ড টাইম’ সিরিজ নিয়ে প্রায় সাতটি বই লিখেছেন, উচ্ছ্বসিত প্রশংসা না কুড়োলেও প্রতিটা বইই ভালো সাফল্য পেয়েছে। ‘টাবি’কে নিয়ে লেখা তাঁর ক্লাব স্টোরিগুলোও যথেষ্ট জনপ্রিয়। টাবির সঙ্গে খানিকটা ঘনাদা বা তারিণীখুড়োর তুলনা করা যায়, কারণ তার বিবৃত বৈজ্ঞানিক অ্যাডভেঞ্চারের ঘটনাগুলো আসলে স্বপ্ন না সত্যি, সেটা আর শেষ পর্যন্ত জানা যায় না। টাবিকে নিয়ে লেখা সবচেয়ে ভালো গল্প সম্ভবত ‘অ্যারাউন্ড দ্য ইউনিভার্স’, সে যুগে এই গল্প পড়ে পাঠকরা পত্রিকার অফিসে রাশি রাশি ফ্যান মেইল পাঠিয়েছিল। তুলনায় ‘টামা সিরিজ’-এর দু’টো লেখা নিয়ে বিশেষ কথা হয়নি। স্বাধীন ভাবেও বহু গল্প লিখেছেন কামিংস, সবগুলো গ্রন্থকারে প্রকাশও পায়নি।   

একটা একটা করে লেখা নিয়ে আলোচনা করা অসম্ভব, কারণ কামিংস তাঁর লেখক জীবনে সাড়ে সাতশটা গল্প এবং উপন্যাস (কারো কারো মতে সংখ্যাটা হাজারেরও বেশি) লিখেছেন। এই বিপুল সংখ্যক পাল্প সাহিত্যের বারো আনা আসলে কল্পবিজ্ঞান বিষয়ক ফ্যান্টাসি, যদিও ক্রাইম থ্রিলার ও গোয়েন্দা গল্পও আছে বেশ কিছু। 

১৯২৬ সালের আগে কল্পবিজ্ঞান ভিত্তিক পত্রিকা আলাদা করে প্রকাশিত হত না, যদিও ১৯২৩ সাল থেকে প্রকাশিত ‘উইয়ার্ড টেলস’-এ হরর ঘরানার পাশাপাশি সাই ফাই গল্পও প্রকাশিত করা হত। এমন সময় হিউগো গার্নসব্যাক এসে ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’-এর পত্তন করেন, সেখানে সাইন্স ফিকশন ( হিউগো নাম দিয়েছিলেন ‘সায়েন্টিফিকশন’) লিখতে এগিয়ে আসেন তাবড় তাবড় লেখকরা। কে ছিল না এই দলে? বারোস, মেরিট আর কামিংস তো ছিলেনই, সঙ্গে ছিলেন জর্জ অ্যালেন ইংল্যান্ড, রালফ মিলনে ফার্লে, উইলিয়াম হোপ হজসন, স্যাক্স রোমার, গ্যারেট পি সার্বিস, এইচ রাইডার হ্যাগার্ডের মতো অনেকেই নিয়মিত গল্প লিখে গেছেন অ্যামেজিং স্টোরিজ-এ। 

কিন্তু ‘অ্যামেজিং স্টোরিজ’ ঠিক পাল্প পত্রিকা ছিল না। হিউগো গার্নসব্যাক একসময় টেকনিকাল সাইন্স ম্যাগাজিন বের করতেন বুক পেপারের লেটার ফরম্যাটে, অ্যামেজিং স্টোরিজ-এ সেই শৈলীই ব্যবহার করা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে এই পত্রিকা আসার পর থেকে পাঠকদের মধ্যে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ ক্রমাগত বাড়ছিল। গার্নসব্যাক যুগের লেখকদের মধ্যে নিশ্চিত ভাবে সর্বাধিক জনপ্রিয় ছিলেন এডওয়ার্ড ই ‘ডক’ স্মিথ, তাঁর লেখা ‘স্কাইলার্ক সিরিজ’ থেকেই যে ‘স্পেস অপেরা’ শব্দটি জনপ্রিয় হয়, সে কথা অনেকে জানে। গার্নসব্যাক নিজেও কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন, ফলে প্রচারে কোনো খামতি থাকত না। কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। আজও প্রতি বছর সেরা কল্পবিজ্ঞান লেখার জন্যে ‘হিউগো অ্যাওয়ার্ড’ দেওয়া হয়ে থাকে।

অ্যামেজিং স্টোরিজ-এর সাফল্য দেখেই সম্ভবত ১৯৩০ সালে উইলিয়াম ক্লেটন ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ নামে এক ‘পাল্প’ সাইন্স ফিকশন পত্রিকা শুরু করেন। কিন্তু এই পত্রিকার হাত ধরেই যে মার্কিন কল্পবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের সূচনা হবে, সে কথা হয়তো ক্লেটন নিজেও জানতেন না। সে যাই হোক, রে কামিংস এই দুই পত্রিকাতেই পর পর লিখে চললেন। সম্পাদকররা ততদিনে খেয়াল করেছেন, এই নীরব সাহিত্যিকের লেখার জন্যে এক উৎসাহী পাঠকবর্গ তৈরি হয়েছে। আক্ষরিক অর্থে কামিংস ‘বেস্টসেলিং রাইটার’-এর তকমা পাননি ঠিকই, কিন্তু তাঁর গল্প না থাকলে পাঠকদের হা হুতাশ শুনতে হয়। ১৯২২ সালে লন্ডনের বিশিষ্ট প্রকাশক ‘Methuen’ ‘দ্য গার্ল ইন দ্য গোল্ডেন অ্যাটম’ বই হিসেবে প্রকাশিত করেছে, ১৯২৩ সালে ‘Harper’-এর হাত ধরে আমেরিকার বাজারে এসেছে সে বই। কয়েকটা সংস্করণ ইতিমধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, ‘দ্য মুন পুল’ বইটা নিয়েও মাতামাতি বড় কম হয়নি। কেউ কেউ এই মুখচোরা লেখককে ‘আমেরিকান এইচ জি ওয়ালস’ বলে ভূষিত করেছেন। সমালোচকরা অবশ্য বিশেষ উৎসাহ দেখাননি রে কামিংসের রচনা নিয়ে।

সমালোচকরা উৎসাহ না দেখালেও পাঠকপ্রিয়তা কম হয়নি কামিংসের লেখার। ১৯২৬ সালের পর পাল্প সাইন্স ফিকশনে তার লেখার চাহিদা এতটাই বেড়ে গেল যে বাধ্য হয়ে পরিচিত প্লটের পুনরাবৃত্তি করতে বাধ্য হলেন কামিংস। একাধিক ছদ্মনামও নিতে হল। তাঁর স্ত্রী গ্যাব্রিয়েল উইলসনও লিখতেন, শোনা যায় কাজের চাপ বেশি থাকলে স্বামী-স্ত্রী নিউইয়র্কের এক হোটেলে এসে উঠতেন। সারা রাত লিখে দুপুরের দিকে ব্রেকফাস্ট করতে যেতেন তাঁরা। 


মোটের উপর দেখতে গেলে কামিংসের রচনা কালকে দু’ভাগে বিভক্ত করা যায়। ১৯২২-১৯৩১ আর ১৯৪৮ থেকে ১৯৬০। 

১৯২২-১৯৩১-এর মাঝে কামিংস অবিরাম লিখে গেছেন সমস্ত পত্রপত্রিকায়। এই সময় ধারাবাহিক ভাবে তাঁর পাঁচটা উপন্যাস ছাপা হয়, তার প্রত্যেকটাই বই হিসেবে প্রকাশিত হয় এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য পায়। ১৯৩১

সালের পরবর্তী সময়ে কামিংস লিখেছেন ঠিকই, কিন্তু সেই লেখাগুলোকে বই করতে সম্মত হয়নি। কামিংস সম্ভবত জানতেন, পাঠকদের পড়ার খোরাক জোগানো আর বই প্রকাশ করা এক কথা নয়! 

১৯৩৭ সালের পর কল্পবিজ্ঞানের জগতে বিপুল পরিবর্তন আসে। জন ক্যাম্পবেল ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ পত্রিকার দায়িত্ব নেওয়ার পর নিঁখুত বৈজ্ঞানিক তথ্য আর বাস্তবভিত্তিক লেখা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে যায়। রাজনীতি, দর্শন, মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক ও মনস্তত্ব নির্ভর কল্পবিজ্ঞান পাঠকদের মনে জায়গা করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন পাঠকদের জীবন দর্শন উল্লেখযোগ্য ভাবে বদলেছিল, ফলে ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ ছাড়া অন্য কোনো পাল্প পত্রিকাই অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি। আইজাক আসিমভ, রবার্ট এ হেইনলেন, লেস্টার ডেল রে, ক্লিফর্ড ডি সিমোক, রে ব্র্যাডবেরির মতো প্রবাদপ্রতিম লেখকরা এই পত্রিকা থেকেই উঠে এসেছেন।

কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ১৯৪৮ সালের পর, মনস্তত্ব ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞানের প্রতি খানিকটা মোহ কমে আসে পাঠকের একাংশের। যুদ্ধ ততদিনে শেষ হয়েছে, নির্ভেজাল বিনোদনের জন্যে পাঠকরা আবার কামিংসের লেখা খুঁজতে শুরু করে। ততদিনে কামিংস লেখা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, মেয়ে বেটি কামিংসের আগ্রহে টাইমলি কমিক্সে (বর্তমানে মার্ভেল কমিক্স) লিখেছেন বছর কয়েক আগে। সেটাই একমাত্র উল্লেখযোগ্য কাজ। ক্যাপ্টেন আমেরিকার দু’একটা গল্প লিখেছেন, ‘সাবম্যারিনার’ আর ‘হিউমান টর্চ’-এর কয়েকটা গল্পের স্টোরি লাইনে কিছুটা পরামর্শ দিয়েছেন, কিন্তু সেই পর্যন্তই।    

আরও পড়ুন : বঙ্গভূমে রক্ততৃষা / চয়ন সমাদ্দার

কিন্তু সম্পাদকরা ছাড়ার পাত্র নয়। তারা খুঁজে খুঁজে তাঁর পুরোনো লেখাগুলো পেপারব্যাক হিসেবে প্রকাশ করতে শুরু করে। সেই বইগুলো বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করে। নতুন যুগের পাঠকদের কাছে কামিংস ‘ব্রেথ অফ ফ্রেশ এয়ার’ হয়ে প্রত্যাবর্তন করলেন। 

পাঠকদের উৎসাহ দেখে সমালোচকরাও আগ্রহী হয়ে ওঠে। যে ব্যক্তিকে তিন দশক ধরে ক্রিটিকরা স্রেফ উপেক্ষা করে গেছেন, তাঁর লেখা নিয়ে বিশ্লেষণ শুরু হয়। তাই বলে যে কামিংস খুব তারিফ কুড়িয়েছেন তা নয়। বেশিরভাগ সমালোচক তাঁর লেখাকে ‘সস্তা মন ভোলানোর কাহিনি’ বলে খারিজ করে দেন, অন্যরা তাঁর লেখা বিপুল সাহিত্যভান্ডারের কথা ভেবে তাঁকে ‘গ্রেস মার্ক’ দিতে সম্মত হয়। ১৯৫৭ সালে যখন কামিংস সেরিব্রাল হেমারেজ হয়ে মারা যান, তখনও তাঁর লেখা উপন্যাস পুনঃপ্রকাশ হয়ে চলেছে। ১৯৬০ সালে জর্জ পলের পরিচালনায় তৈরি ‘দ্য টাইম মেশিন’-এর অনেকটাই ‘দ্য গার্ল ইন দ্য গোল্ডেন অ্যাটম’-এর গল্পের উপর নির্ভর।

(দ্বিতীয় কিস্তিতে সমাপ্য) 

........................ 


#Ray Cummings #science fiction #The Girl in the Golden Atom #কল্পবিজ্ঞান #রে কামিংস #সুদীপ চ্যাটার্জী #সিলি পয়েন্ট #ওয়েবজিন #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

20

Unique Visitors

219131