নিবন্ধ

<b>রায়ের কলকাতা, কলকাতার রায়</b>

রণিতা চট্টোপাধ্যায় Aug 22, 2020 at 11:38 am নিবন্ধ

হিরে মানিক জ্বলেঃ ষষ্ঠ পর্ব

বম্বে শহরটাতে প্রথমবার পা রেখেই তোপসের মনে পড়েছিল যে, ফেলুদা বলে, মানুষের যেমন একটা পরিচয় তার নামে, একটা চেহারায়, একটা চরিত্রে আর একটা তার অতীত ইতিহাসে, ঠিক তেমনই নাকি শহরেরও। ফেলুদার বকলমে আসলে যে এ কথা বলছেন সত্যজিৎ রায় নিজেই, তাঁর গল্পের অলিগলিতে ঘোরা পাঠকের তা বুঝতে বাকি থাকে না। কলকাতার মতো মান্ধাতার আমলের একটা শহরে বেড়ে ওঠার কারণেই কি না কে জানে, শহর তাঁর কাছে একটা জীবন্ত অস্তিত্ব। একটি ভিডিওতে নিজের শহর কলকাতাকে “extremely rich and dense and complex city” আখ্যা দিয়ে সত্যজিৎ জানিয়েছিলেন, যে-কোনো পরিস্থিতিতে কলকাতার ‘constantly reacting’ মনোভাবই এ শহরের প্রতি তাঁকে মুগ্ধ করে রেখেছে।

পাঁচ বছর বয়সে চিরকালের মতো জন্মস্থান গড়পার রোডের বাড়ি ছেড়ে ভবানীপুরে মামার বাড়িতে চলে আসার পর ছোট্ট মানিকের অনেকখানি সঙ্গী হয়ে উঠেছিল এই পুরোনো শহরটা। সকাল দুপুর বিকেলের অনেকখানি কেটে যেত শোবার ঘরের লাগোয়া বারান্দা থেকে রাস্তা দেখে। এমনকি গ্রীষ্মের দুপুরে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ করে দিলেও খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা আলোয় চড়ে রাস্তাটা হাজির হয়ে যেত ঘরের ভেতরেও। বড়ো হতে হতে যখন মনের মধ্যে কুলুপ পড়তে থাকে একের পর এক, তখনও যে সেই নাছোড়বান্দা শহরটা ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকি দেবেই, সে আর আশ্চর্য কী! 

বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে সে শহরের ভাঁড়ার থেকে অবশ্য হারিয়ে গেছে অনেক কিছু। ‘টু লেট’ লেখা বোর্ড, ওয়ালফোর্ড কোম্পানির লাল ডবলডেকার ছাত-খোলা বাস, ঘোড়ার গাড়ি, বাড়িতে আইসক্রিম বানানোর সময় কাঠের বালতির গায়ে লাগানো লোহার হাতলের ঘড়ঘড় শব্দ, এই সব কিছুর সঙ্গে পিছনে পড়ে গেছে সেই পাঁচ বছরের ছেলেবেলাও। কলকাতাকে ফিরে দেখা সেই ফেলে-আসা নিজের কাছে পৌঁছে যাওয়ারও পথ ছিল হয়তো। প্রোফেসর শঙ্কুর মতো ‘টাইম মেশিন’ তাঁর ছিল না, কিন্তু ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ের প্রথমেই ছোটবেলার শহরে একটা টাইম ট্রাভেল সেরে নিয়েছেন সত্যজিৎ। 

‘ছেলেবেলা’-র পাতা ওলটালে শুরুতেই মনে এসে লাগে সেকেলে কলকাতার দুলকি চাল। যে কলকাতায় ঘোড়ার গাড়ি ছোটে ধুলো উড়িয়ে, না আছে ট্রাম, না আছে বাস, না আছে মোটরগাড়ি। ঠাকুরবাড়ির ছোট ছেলেটি যে কলকাতাকে দেখেছিল, সে কলকাতা ট্র্যাফিক জ্যামের বিভীষিকা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছিল এতগুলো বছর পেরিয়ে এসেও। কিন্তু ‘যখন ছোট ছিলাম’-এরও প্রথমেই ভিড় করে আসে সত্যজিতের ছেলেবেলার কলকাতার গাড়িঘোড়া। বড়বেলার কলকাতা শহরের সঙ্গে সে কলকাতার সবচেয়ে বড়ো তফাত তাঁর কাছে দেখা দেয় মোটরগাড়ির চেহারায়।




















সত্যজিতের মতোই হর্ন শুনে মোটরগাড়ির মডেল বলে দিতে পারত আরও একজন। ফেলুচাঁদের কলকাতা-প্রীতির খবর অবশ্য তার ভক্তদের অজানা নয়। হগ সাহেবের বাজার, থুড়ি নিউ মার্কেট-এর মতো ‘আন্ডার দি সেম রুফ এমন একটা বাজার’ যে আর কোথাও নেই, সে বিষয়ে লালমোহনবাবুর সঙ্গে একমত ছিল ফেলুদা ও তোপসে দুজনেই। এখানকার কলিমুদ্দির ডালমুট ছাড়া ফেলুদার চা-পান জমে না, অন্যদিকে পেনের রিফিল হোক কি গল্পের প্লট, জটায়ু ঢুঁ মারেন নিউ মার্কেটেই। নিউ মার্কেট ভেঙে ফেলে সেখানে বহুতল সুপার মার্কেট গড়ার কানাঘুষো শুনে ফেলুদা খেপে উঠে বলেছিল, “এ কাজটা হলে কলকাতার অর্ধেক কলকাতাত্ব চলে যাবে সেটা কি এরা বুঝতে পারছে না? নগরবাসীদের কর্তব্য প্রয়োজনে অনশন করে এই ধ্বংসের পথ বন্ধ করা।” ‘নেপোলিয়নের চিঠি’ আর ‘নিতাইবাবুর ময়না’, দুই গল্পে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়েছিল নিউ মার্কেটের পাখির বাজার।

‘ছিন্নমস্তার অভিশাপ’-এ বড় ছেলের মহাজাতি ময়দানে নিয়মিত যাতায়াত আছে শুনে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলেন মহেশ চৌধুরী। ‘সীমাবদ্ধ’-র নায়ক শ্যামলেন্দুর মতো ফেলুদাকেও রেসের মাঠে পাঠিয়েছিলেন সত্যজিৎ, অবশ্য তদন্তের প্রয়োজনে। কিন্তু রহস্যের জট ছাড়ানোর পাশাপাশি ফেলুদার এ কথাও মনে হয়েছিল, কোন আদ্যিকাল থেকে প্রতি শনিবার কলকাতার বুকে যে আশ্চর্য ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে, অন্তত একবার তার সাক্ষী হওয়া উচিত। আর তোপসের কাছে সবচেয়ে আকর্ষক লেগেছিল যে রেসের মাঠে মুড়ি মিছরির এক দর। এমন দৃশ্য কলকাতা শহরে আর কোথাও দেখা যায় না, দেখার সম্ভাবনাও নেই, এমনটাই বলেছিল সে। রাস্তার ভিখিরি থেকে রাজা মহারাজা, সবাই যদি একই উদ্দেশ্য নিয়ে একই জায়গায় জমায়েত হয়, সে জায়গা নিঃসন্দেহে এই রেসের মাঠ। সুতরাং সত্যজিতের নিজস্ব লবজে রেসের মাঠ যে ‘মহাজাতি ময়দান’ হয়ে দাঁড়াবে তা আর আশ্চর্য কী!

রেসের মাঠের মতো কলকাতার আরেকটি জায়গাতেও বিভিন্ন শ্রেণির, বিভিন্ন পেশার অসংখ্য মানুষ জমা হয় অর্থসংস্থানের তাগিদে। হলিউডের অনুকরণে সে সিনেমাপাড়ার নাম টলিউড। কলকাতার যে স্থান ঘিরে আবর্তিত হয়েছে তাঁর নিজের কর্মজীবন, সত্যজিৎ রায় তাঁর একটি চরিত্রকেই উল্লেখযোগ্য ভাবে তার মধ্যে এনে ফেলেছিলেন। তেইশ বছর বয়সে প্রোডাকশন ম্যানেজারের চাকরি নিয়ে টলিউডে পা রেখেছিলেন তারিণীখুড়ো। ’৪২-এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে খাকি পরা জি.আই. সেনা আর মার্কিন মিলিটারির টহলে কলকাতা শহরের চেহারা কীভাবে পালটে গিয়েছিল, আর তার পাশাপাশিই কুইক মানি কেমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছিল সিনেমাওয়ালাদের, তার এক ঝলক ধরা পড়েছে ‘টলিউডে তারিণীখুড়ো’ গল্পে।

কলকাতায় মেট্রো রেলের কাজ শুরু হয়েছিল ১৯৭০ সাল নাগাদ। আর ১৯৮৪-তে খুলে দেওয়া হয় প্রথম মেট্রো লাইন, যার দৈর্ঘ্য ছিল ভবানীপুর থেকে এসপ্ল্যানেড পর্যন্ত। সুতরাং বালিগঞ্জ পার্কের সুবীর দত্তের বাড়ির টেলিফোন লাইন ডেড হয়ে যাওয়া আশ্চর্য নয়। আন্দাজ করা যায়, ১৯৮০ সালে লেখা ‘গোলকধাম রহস্য’-তে যে খোঁড়াখুঁড়ির কারণে ফোনের লাইন ডেড হয়ে ছিল, তার কারণ ছিল কলকাতার মেট্রো রেল। এর ঠিক পরের বছর সন্দেশে যে গল্পটা প্রকাশিত হয়, সেখানেও দেখা যায় পাতালরেলের উল্লেখ। ‘ভুতো’ গল্পে মহাজাতি সদনের অনুষ্ঠানে ভেনট্রিলোকুইস্ট নবীন আর তার কথা-বলা পুতুল ভুতোর আলোচনার বিষয় ছিল কলকাতার এই নতুন আকর্ষণ। ভুতো অবশ্য এর নাম দিয়েছিল হাসপাতাল রেল। এহেন নামকরণের কারণ? “একটা বিরাট অপারেশন, সারা শহরের গায়ে ছুরি চলছে, শহরের এখন-তখন অবস্থা। হাসপাতাল ছাড়া আর কী?” 


আরও পড়ুন

হিরে মানিক জ্বলে ( পঞ্চম পর্ব ) - সত্যজিতের জাদু দুনিয়া


“বাংলা এগারো শত বিরাশির সালে

 একুশে শ্রাবণ শনিবারের সকালে

 ব্রহ্মনাশ হয়ে গেল আলিপুরের মাঠে”...

এক অভাবিত হত্যাকাণ্ড বাংলা দেশে এই ছড়ার জন্ম দিয়েছিল। দুশো বছর পর ফেলুদা এই ঘটনাস্থলেই গিয়ে পৌঁছয় একটা খুনের সূত্রে। ফ্যান্সি লেনে তদন্ত করতে গিয়ে ফেলুদা জানতে পারে ‘ফ্যান্সি’ শব্দের উৎপত্তি ‘ফাঁসি’ থেকে, এবং তাও যে-সে লোকের নয়, স্বয়ং মহারাজা নন্দকুমারের ফাঁসির ঘটনাই এ রাস্তার নামকরণের মূলে। সেই থেকে পুরনো কলকাতা হয়ে ওঠে ফেলুদার নেশা। ১৯৩২ সালের কলকাতা-হাওড়ার ম্যাপ জোগাড় করা থেকে তোপসেকে সেন্ট জনস চার্চ চত্বরে কলকাতার প্রথম ইটের বাড়ি জোব চার্নকের সমাধি দেখাতে নিয়ে যাওয়া, সবই কলকাতা নিয়ে ফেলুদার ক্রমবর্ধমান আগ্রহের দিকে ইঙ্গিত করে। “ভেবে দ্যাখ তোপ্‌সে— একটা সাহেব মশা মাছি সাপ ব্যাঙ বন-বাদাড়ে ভরা মাঠের এক প্রান্তে গঙ্গার ধারে বসে ভাবল এখানে সে কুঠির পত্তন করবে, আর দেখতে দেখতে বন-বাদাড় সাফ হয়ে গিয়ে সেখানে দালান উঠল, রাস্তা হল, রাস্তার ধারে লাইন করে গ্যাসের বাতি বসল, সেই রাস্তায় ঘোড়া ছুটল, পাল্কি ছুটল, আর একশো বছর যেতে না যেতে গড়ে উঠল এমন একটা শহর যার নাম হয়ে গেল সিটি অফ প্যালেসেজ”— ফেলুদার এই দীর্ঘ বক্তৃতা তোপসের চোখের সামনে কলকাতার একটা গোপন দরজা খুলে দিয়েছিল। গঙ্গার জলে ভাসমান শবদেহের ওপর চেপে হাড়গিলের নৌসফর, আর হোয়াইট টাউন – ব্ল্যাক টাউনের পাশাপাশি সহাবস্থানের গল্প শুনে লালমোহনবাবুও অবশ্য কম উত্তেজিত হননি। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে দুটো দুপুর কাটিয়ে তোপসেও যখন এই নতুন নেশার সঙ্গী, ঠিক সেই সময়ই ফেলুদার হাতে এসে পড়ে এমন একটি কেস, যার জাল বিছিয়ে আছে পুরনো কলকাতা জুড়ে। হ্যাঁ, গোরস্থানে সাবধান-এর কথাই বলছি। ফেলুদা জানিয়েছিল, পার্ক স্ট্রিট গোরস্থানে সোয়াশো বছর আগে সমাধি দেওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও এখানকার সমাধির সংখ্যা অন্তত দুহাজার, যার মধ্যে কোনো-কোনোটার বয়স ফরাসি বিপ্লবেরও বেশি। 

গোরস্থানে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটির তদন্ত করতে ফেলুদাকে যেতে হয়েছিল এমন একটি প্রতিষ্ঠানে, যা সেকালেও, এবং একালে তো বটেই, বিস্মৃতপ্রায়। এশিয়ার দ্বিতীয় প্রাচীনতম ফটোর দোকান ‘বোর্ন অ্যান্ড শেপার্ড’, যেখানে ১৮৫৪ সাল থেকে সব নেগেটিভ সংরক্ষিত রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন দোকানের কর্মচারী। আর এ কথার প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছিলেন ১৮৮০ সালে মনুমেন্টের ওপর থেকে তোলা সেকালের শহর কলকাতার ছবি। ধর্মতলার এই পুরনো দোকানই এই কাহিনির জট অনেকখানি খুলে দিয়েছিল। 

তবে বইপত্র আর সিধুজ্যাঠার দৌলতে ফেলুদা যে-কোনো তথ্যের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নির্ভুল থাকতে চাইলেও, তার অজান্তেই এ গল্পে একটা ভুল রয়েই গেছে। ফেলুদা জটায়ুকে জানিয়েছিল কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা চার্নক একজনই। কিন্তু সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কলকাতা হাইকোর্টে দায়ের করা জনস্বার্থ মামলার রায়ে ২০০৩ সালের ১৬ মে যে নাকচ হয়ে যাবে জোব চার্নকের কলকাতার পিতৃত্ব, ছাব্বিশ বছর আগে এ কথা আদৌ অনুমান করতে পারেননি সত্যজিৎ রায়।



[ পোস্টারঃ অর্পণ দাস ]
#হিরে মানিক জ্বলে #কলকাতা #সত্যজিত রায় #রণিতা চট্টোপাধ্যায়

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

37

Unique Visitors

219180