ফিচার

জাপানে রাসবিহারী বসুর রেস্তোরাঁ : সামুরাইয়ের দেশে ভারতীয় খানার বাহারি স্বাদ

মন্দিরা চৌধুরী May 28, 2021 at 6:32 am ফিচার

বাঙালি যে মৎস্যবিলাসী তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। তবে জাপানিদের মৎস্যপ্রীতিও কিছু কম নয়। জাপানের রাস্তায় আকছার দেখা যায় মাছ-ভাতের হোটেল, যার আঞ্চলিক প্রসিদ্ধি 'রাইসু-কারি' নামে। তবে স্বাদে এই পদ বাঙালি মাছের ঝোলের ধারেকাছে আসে না। জাপানিদের এই রান্নায় বিভিন্ন ফলের সাথে মধু আর অ্যারারুট মেশানো থাকে, যা সহ্য করা বাঙালি জিভের সাধ্য নয়। কিন্তু টোকিওর শিনঝাকু এলাকায় যদি কেউ যান, দেখবেন একটি রেস্তোরাঁর বিজ্ঞাপনে লেখা - 'Authentic Indian Curry'। দোকানের নাম 'নাকামুরা কাফে'। অল্প-বিস্তর ইতিহাসচর্চা যাঁরা করেন, ‘নাকামুরা’ নামটা তাঁদের কাছে অচেনা ঠেকবে না। বিপ্লবী রাসবিহারী বসু জাপানে আত্মগোপন করে থাকাকালীন 'নাকামুরা বেকারি'তে বেশ কয়েক মাস লুকিয়ে ছিলেন। শুনতে অবাক লাগলেও, এই ‘নাকামুরা কাফে'-র পরিকল্পনাটিও ছিল রাসবিহারী বসুর।

১৯১৫ সালে রাসবিহারী দিল্লিতে লর্ড হার্ডিঞ্জের ওপর বোমা নিক্ষেপ করেন এবং এই ঘটনার মূল চক্রী হিসাবে অচিরেই ইংরেজ পুলিশ তাঁকে চিহ্নিত করে ফেলে। এই সময়েই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপান গিয়েছিলেন। রাসবিহারী তখন নিজেকে রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় এবং জাপানযাত্রার সঙ্গী পি.এন. ঠাকুর পরিচয় দিয়ে জাপানে পালিয়ে যান। তিনি জাহাজে করে প্রথমে পৌঁছন জাপানের কোবে শহরে। সেখানে জাপানের বিখ্যাত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও প্যান এশিয়ান আন্দোলনের নেতা মিৎসু তোয়ামার সাহায্যে কোবেতেই কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকেন। তারপর তোয়ামা সাহেবের সাহায্যেই চলে আসেন টোকিওতে। সেখানে মিৎসু তোয়ামার বাড়িতেই লুকিয়ে রইলেন কিছুদিন। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের নজর পৌঁছল সেখানেও। টোকিওতে রাসবিহারীকে হত্যার জন্য ব্রিটিশ পুলিশের উদ্যোগে পেশাদার খুনিও নিযুক্ত হয়। তাছাড়া অনির্দিষ্টকাল পরাশ্রয়ী হয়ে আত্মগোপন করে থাকাও রাসবিহারীর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। তখন তোয়ামা সাহেবের উদ্যোগে তাঁর পরিচিত সোমা নামক এক ভদ্রলোকের পাঁউরুটি, বিস্কুট তৈরির বেকারির বেসমেন্ট হল রাসবিহারীর আস্তানা।

এই আত্মগোপনকালে ইংল্যান্ড আর জাপানের কূটনৈতিক সম্পর্কে বদল আসে। ব্রিটিশ রণতরী জাপানের এক বাণিজ্যতরীকে আক্রমণ করলে দুই দেশের সম্পর্কের অবনতি হয়। সেই সঙ্গে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তিও বাতিল হয়ে যায়। এর কিছুদিন পরে তোয়ামা সাহেবের উদ্যোগে সোমা সাহেবের বড়ো মেয়ে তোশিকোর সাথে বিয়ে হয় রাসবিহারী বসুর৷ এই বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে রাসবিহারী জাপানি নাগরিকত্ব পান। তবে এরপরেও দুর্ভাগ্য পিছু ছাড়েনি তাঁর৷ বিয়ের পর নয় বছর সুখী দাম্পত্যজীবন কাটিয়ে, দুটি সন্তানের জন্ম দিয়ে যক্ষ্মা রোগে মৃত্যু হয় রাসবিহারীর স্ত্রী তোশিকোর। দীর্ঘকাল বিদেশে বসবাস এবং সংসারধর্ম পালন করেও রাসবিহারী দেশকে স্বাধীন করার ব্রত থেকে বিচ্যুত হননি একদিনের জন্যও। দেশের বিপ্লবী সতীর্থদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন সবসময়ে। জাপানে থেকেই চেষ্টা করে গেছেন দেশে বিপ্লবী আন্দোলন সংগঠিত করতে, বিপ্লবীদের রসদ জোগাতে। জাপানে বসেই তৈরি করেছেন 'ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স লীগ', বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে বক্তৃতা করে মানুষের সমর্থন, সাহায্য আদায় করেছেন, বিশ্বের তাবড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের সাথে পত্রালাপ চালিয়ে গেছেন।

এমন হাজারো ব্যস্ততার মধ্যে হঠাৎই তিনি একেবারে অন্যরকম একটা কাজের উদ্যোগ নিয়ে ফেললেন। বিদেশি কর্মক্ষেত্র, বিদেশি স্ত্রী নিয়ে দিন অতিবাহিত করলেও আজীবনের বাঙালি রসনা আর কতদিন বিদেশি স্বাদে তৃপ্ত থাকতে পারে! জাপানিদের মৎস্যপ্রেমের কথা আগেই বলা হয়েছে। সেই সুবাদে রাসবিহারী মাছে-ভাতেই ছিলেন। কিন্তু জাপানিদের মাছের ঝোল রান্নার পদ্ধতির সঙ্গে বাঙালি মাছের ঝোলের দূরতম সম্পর্কও নেই, বরং সেই রান্নায় ইউরোপীয় প্রভাব আছে। রাসবিহারীর ছোটোবেলা থেকেই রান্নার শখ ছিল, সেই শখই এবার কাজে দিলো। রান্না করে ফেললেন নির্ভেজাল বাঙালি মাছের ঝোল। সেই ঝোল খেয়ে তাঁর আত্মীয় বন্ধুরাও মুগ্ধ! সকলের সাহায্য আর রাসবিহারীর উদ্যোগে সোমা সাহেবের বেকারির ছাদে ১৯২৮ সালে খোলা হল সেই রেস্তোরাঁ- নাকামুরা কাফে। বিপ্লবী রাসবিহারীর তত্ত্বাবধানে এবং তাঁর দেওয়া প্রণালী মেনে সেখানে রান্না হত বাঙালি মাছের ঝোল এবং ভারতের অন্যান্য প্রদেশের বিভিন্ন পদ, বিশেষত মাছ-মাংসের পদ। এভাবেই ভারতীয় স্বাদের সঙ্গে জাপানিদের পরিচয় করিয়েছিলেন রাসবিহারী। তাঁর এই রেস্তোরাঁ অল্পদিনের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে ওঠে।

১৯৪৫ সালে রাসবিহারী বসুর মৃত্যুর পর সোমা সাহেবের ‘নাকামুরা বেকারি’ থেকে টোকিওর অফিসপাড়া শিনঝাকু অঞ্চলে স্থানান্তরিত হয় এই ‘নাকামুরা কাফে’। অন্যান্য রেস্তোরাঁর থেকে দাম বেশি হওয়া সত্ত্বেও এখানকার ভিড়ে কখনও ঘাটতি পড়ে না। আজও রেস্তোরাঁর প্রবেশপথে শোভা পায় ধুতি ও কোট পরিহিত সেই বঙ্গসন্তানের প্রতিকৃতি, যিনি জাপানবাসীকে উপহার দিয়েছিলেন বাঙালির নিজস্ব স্বাদ, আপন ঐতিহ্য। সম্প্রতি ২০১৫ সালেই এই রেস্তোরাঁকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। এখন এখানে একসঙ্গে ১০০ জনের বসে খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।

আরও পড়ুন : ঢাকায় নারীমুক্তির অগ্রদূত : বিস্মৃতপ্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী লীলা রায় / মন্দিরা চৌধুরী 

........................ 

তথ্যসূত্র : 1) Bose of Nakamuraya / Pallavi Aiyar / The Hindu / Febuary 6, 2018, 2) www.banglaamarpran.in  

ছবি : www.thebetterindia.com

#Rash Behari Bose #Indian revolutionary leader #Resturant #রাসবিহারী বসু #জাপান #রেস্তোরাঁ #নাকামুরা বেকারি #মন্দিরা চৌধুরী #সিলি পয়েন্ট #Web Portal

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219125