নোবেলের টাকায় ড্রেন তৈরির পরিকল্পনা ছিল রবীন্দ্রনাথের?
কবি মানুষদের মাথায় কতই না খেয়াল চাপে। ফলে এ কথা যদি সত্যি হয় তাতেও খুব আশ্চর্যের কিছু আছে কি?
১৯১৩ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির খবর ঘোষিত হয়। কবি তখন শান্তিনিকেতনে। টেলিগ্রাম মারফৎ সে খবর শান্তিনিকেতনে পৌঁছয়। পৌঁছনোমাত্র আশ্রমে শুরু হয়ে যায় উৎসব। প্রমথনাথ বিশী তাঁর 'রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন' গ্রন্থে দিনটির স্মৃতিচারণা করেছেন - "সহসা অজিতকুমার চক্রবর্তী রান্নাঘরে ঢুকিয়া চিৎকার করিয়া বলিলেন, 'গুরুদেব নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন।' লক্ষ্য করিলাম অজিতবাবুর চলাফেরা প্রায় নৃত্যের তালে পরিণত হইয়াছে। ... তারপর ক্ষিতিমোহনবাবু প্রবেশ করিলেন। স্বভাবত তিনি গম্ভীর প্রকৃতির লোক, চলাফেরায় সংযত, কিন্তু তাঁহাকেও দেখিলাম চঞ্চল...। যখন জগদানন্দবাবু পৌঁছিয়া ঘোষণা করিলেন তিন-চারদিনের ছুটি তখন বুঝিলাম ব্যাপার কিছু গুরুতর।"
সে সময় শান্তিনিকেতনে টাকার প্রবল টানাটানি চলছিল। টাকার অভাবে বেশ কিছু কাজ আটকে ছিল। এমনকি একটি লম্বা নর্দমা কিছুটা কাটা হয়ে তারপর বন্ধ হয়ে পড়ে ছিল।
প্রমথবাবুর বইটি থেকেই জানা যায়, নোবেল প্রাপ্তির খবর যখন আসে, কবি তখন কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে পারুলবনে বেড়াতে বেরিয়েছিলেন। সঙ্গীদের মধ্যে একজন ছিলেন নেপালচন্দ্র রায়। নেপালবাবু ছিলেন ব্রহ্মবিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষাব্রতী। বিশ্বভারতীর পরিকল্পনাতেও রবীন্দ্রনাথের প্রধান একজন সহযোগী ছিলেন তিনি। অসম্পূর্ণ নর্দমা নিয়ে সে সময় নেপালবাবু ও কবি দুজনেই দুশ্চিন্তায় ছিলেন। টেলিগ্রাম হাতে পেয়েই তাই কবি নেপালবাবুকে বলেন, "নিন নেপালবাবু, আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা।"
তবে সে মন্তব্য রবীন্দ্রনাথ নিছক মজার ছলেই করেছিলেন। নোবেলের টাকা ড্রেনের কাজে লাগেনি। সে টাকা, অনেকেই জানেন, রবীন্দ্রনাথ জমা করেছিলেন তাঁর তৈরি পতিসর সমবায় ব্যাঙ্কে। ১ লক্ষ ১৬ হাজার ২৬৯ টাকা তিনি ৭% সুদে সেখানে রেখেছিলেন। স্থির হয়েছিল, বার্ষিক সুদের ৮১৩৮ টাকা বিদ্যালয়ের কাজে বরাদ্দ হবে।
রবীন্দ্রনাথের পক্ষে সে সময় সুইডেন গিয়ে পুরস্কার নেওয়া সম্ভব হয়নি। তাঁর হয়ে ১০ ডিসেম্বর স্টকহোমে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯১৪ সালের জানুয়ারি মাসে কলকাতায় গভর্নর হাউজে রবীন্দ্রনাথের হাতে সেই পুরস্কার তুলে দেন লর্ড কারমাইকেল।
আরও পড়ুন: বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগেও তৈরি হচ্ছে রকেট, ছুটবে মহাকাশে
নোবেল প্রাপ্তির সূত্রেই বিদেশে রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র নিয়ে পাঠকদের মধ্যে উন্মাদনা দেখা দেয় এবং একের পর এক বই অনূদিত হয়। ফলে রয়ালটির বেশ কিছু টাকা রবীন্দ্রনাথ পান। এছাড়া শুভেচ্ছা হিসেবে দেশ-বিদেশ থেকে ব্যক্তিগত কিছু অর্থসাহায্যও আসে। ফলে আশ্রম ও বিদ্যালয়ের অর্থসংকট অনেকটাই দূর হয়। হয়তো সেইসব টাকার কল্যাণেই ড্রেনের অসম্পূর্ণ কাজও শেষ করা গেছিল।
ঋণ : ১) প্রমথনাথ বিশী / রবীন্দ্রনাথ ও শান্তিনিকেতন
২) প্রশান্তকুমার পাল/ রবিজীবনী (ষষ্ঠ খণ্ড)