বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পাখিদের উড়ানে কম্পাস জোগায় কোয়ান্টাম ফিজিক্স

সায়নদীপ গুপ্ত Nov 30, 2021 at 10:54 am বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

পুরনো দিনের বাড়িতে ঘুলঘুলিতে বাসা বাঁধত চড়াই, পায়রা। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরেও বেলাশেষে ঠিক আস্তানা খুঁজে ফেরা যেন তাদের শিখিয়েই দিয়েছিল কেউ। হাজার হাজার মাইল পার হয়ে সাঁতরাগাছি আসা সাইবেরিয়ান হাঁস – অত দূর থেকেও প্রত্যেকবার ঠিক দিক বুঝে চলে আসে তারা! তবে কি ওরা দুটো বাড়ি, দুটো আলাদা গাছের মধ্যে তফাৎ বুঝতে পারে? নাকি মানুষের মতো ওদেরও আছে কম্পাস? বিজ্ঞানীরা অনেকদিন থেকেই এই প্রশ্নের উত্তরে ভেবে এসেছেন, নিশ্চয়ই কোনও উপায়ে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে শারীরিক ভাবে অনুভব করতে পারে পাখিরা, আর তাকেই ধ্রুবতারা করে সাজিয়ে নেয় রুটম্যাপ। সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে পাখিদের এমন আশ্চর্য ক্ষমতার পিছনে আছে পদার্থবিদ্যার কোয়ান্টাম তত্ত্ব।

প্রাণীজগতের কিছু বাসিন্দাদের মধ্যে যে পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্রকে টের পাওয়ার ক্ষমতা কমবেশি আছে, সেটা এতদিনে স্বীকৃত। পাখিদের দীর্ঘ উড়ান থেকে এটুকু নিশ্চিত বোঝা যায় যে প্রাকৃতিক কোনও কিছুকে তারা অনুসরণ করে চলেছে এবং সেটা কোনোমতেই সূর্য বা শুকতারা নয়, কারণ রাতের অন্ধকারেও তাদের ঘর চেনার দক্ষতা এতটুকুও টসকায় না। অথচ আলোর একটা ভূমিকা যে আছে, সেকথা স্পষ্ট হল যখন দেখা গেল কোনও বদ্ধ জায়গার নিকষ অন্ধকারে পাখিরা দিগভ্রান্তের মতো উড়ে বেড়ায়, আবার সেই ঘরেই একটি অতি মৃদু আলোর উৎস রাখলেই তাদের ওড়ায় আগের ছন্দ ফিরে আসে। কিন্তু আলো আর চুম্বকের টান – এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র ছিল অধরা। কোয়ান্টাম ফিজিক্স সেই মেলবন্ধন স্পষ্ট করেছে। 

অন্যান্য প্রাণীর মতোই পাখিদেরও চোখের রেটিনায় থাকে ‘রড’ ও ‘কোন’ কোশ। এই কোশস্থিত বিভিন্ন রঞ্জককণা আলোর তারতম্য ভেদে উত্তেজিত হয়, সামনে থাকা বস্তুর বৈশিষ্ট্য চিনতে সাহায্য করে। খানিকটা এদেরই সমগোত্রীয় একপ্রকার কণা – ক্রিপ্টোক্রোম। এগুলি একধরনের আলোক-সংবেদী প্রোটিন, শুধু রেটিনাতেই নয়, পেশি, স্নায়ু ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় এদের উপস্থিতি দৃশ্যমান। এমনকি উদ্ভিদের দেহেও এরা মুখ বুজে কাজ করে বেড়ায়! আসলে জীবদেহের নিজস্ব যে জৈবিক ঘড়ি বা ‘সার্কাডিয়ান ছন্দ’, তাকেই নিয়ন্ত্রণ করার কাজে অন্যতম ভূমিকা নেয় এই ক্রিপ্টোক্রোম। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, বিভিন্ন ক্রিপ্টোক্রোমের মধ্যে Cry1 ও Cry2 পক্ষীদেহে তৈরি হয় সার্কাডিয়ান ছন্দ মেনেই, কিন্তু Cry4 এদের মধ্যে দলছুট। এই প্রোটিনটি রেটিনাতে সর্বক্ষণ সমান পরিমাণে তৈরি হয়, দিনরাতের ফারাকেও এর উৎপাদনে বিরতি আসে না। এইটি বিজ্ঞানীদের কাছে একটা বড় পাওনা; সারাদিন ধরে পাখির চোখে সমান ভাবে কাজ করে যায় এমন কোনও আলোক-সংবেদী প্রোটিন শরীরের চৌম্বকীয় কম্পাস হওয়ার চাকরিতে যোগ্যতম প্রার্থী! 

কিন্তু এতকিছুর মধ্যে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের কী কাজ? আলো হলে তাও না হয় রঞ্জকের সঙ্গে তার খুনসুটি বোঝা যেত, তার উপর পৃথিবীর চুম্বকধর্ম এমন আহামরি কিছু শক্তিশালী নয় যে কেউ চাইলে তা অনুভব করতে পারবে! দেখা গেল, চুম্বকশক্তি নয়, রহস্যের চাবিকাঠি লুকিয়ে আছে তাকে চিনতে পারার যে প্রক্রিয়া তার সংবেদনশীলতার ভিতর। আলোর গঠনগত কণা, ফোটন, পাখির রেটিনায় থাকা ক্রিপ্টোক্রোমকে উত্তেজিত করে। সেই উত্তেজনার চোটে প্রোটিন অণুর মধ্যে থেকে ইলেকট্রন বাবাজি লাফাতে লাফাতে নিজের কক্ষপথ টপকে উপস্থিত হন পাশের আরেকটি ক্রিপ্টোক্রোম অণুর মধ্যে। এবার পাশাপাশি একজোড়া ক্রিপ্টোক্রোম, যাদের নিজস্ব ইলেকট্রন সংখ্যা বেখাপ্পা, বিজোড়; এই অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না, বলাই বাহুল্য। উত্তেজনার আঁচ নিভে এলেই সুড়সুড় করে ঘরের ইলেকট্রন ঘরে ফিরে আসে। কিন্তু ঐ যেটুকু সময় উত্তেজনা থাকে, পাশাপাশি থাকা এমন দুটি প্রোটিন অণু একে-অপরের সঙ্গে কোয়ান্টাম-বিজড়িত অবস্থায় থাকে। 

কোয়ান্টাম-বিজড়িত যুগল এক অদ্ভুত দশা। এইভাবে জড়িয়ে থাকা দুটি অণুর ভৌতধর্মের মধ্যে আসলে কোনোই পার্থক্য নেই, অর্থাৎ একটিকে বাদ দিয়ে অপরটিকে বিবেচনা করা যাবে না। আক্ষরিক অর্থেই তাদের ভাগ্য তখন একসুতোয় গাঁথা – একজনের মধ্যে কোনও বদল এলে, একই বদল অন্যজনের মধ্যেও দেখা যাবে। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলে নিজেকে দোষ দেবেন না, স্বয়ং আইনস্টাইনও এই তত্ত্বকে মোটেই মানতে চাননি। তবে মুশকিল হল, তত্ত্বটা প্রমাণিত তো বটেই, উপরন্তু এর উৎপত্তি আইনস্টাইনের গবেষণার হাত ধরেই! কাজেই এমন ভৌতিক জুটি ক্ষণস্থায়ী হলেও সত্যি। এই জুটির মধ্যে থাকা অণুগুলো, ‘উত্তেজিত’ এবং ‘নির্বিকার’, নিজেদের এই দুই রাসায়নিক অবস্থার মধ্যে ক্রমাগত ওঠানামা করে, এইভাবেই ধীরে ধীরে তাদের শক্তিক্ষয় হয়। তবে মনে করা হয়, যতক্ষণ এই কোয়ান্টাম-বিজড়িত দশা থাকে তার মধ্যেই এরা পাখির ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে পৃথিবীর চৌম্বকীয় টানের সঙ্গে একটা সংযোগ স্থাপন করে। ঠিক কীভাবে এই ব্যাপারটা হয় সেটা এখনও স্পষ্ট ধরা না গেলেও ঘটনার অস্তিত্ব সম্পর্কে নিঃসংশয় হওয়া গেছে আরেকদল বিজ্ঞানীর গবেষণার মাধ্যমে। 

এই অন্য দলের ক্ষ্যাপারা করেছেন কী, কতগুলো জেব্রা-ফিঞ্চ পাখিকে বদ্ধ জায়গায় পৃথিবীর চৌম্বকীয় অক্ষরেখা বরাবর ওড়াউড়ির প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। জেব্রা-ফিঞ্চ বুঝতে অসুবিধা হলে আমাদের মুনিয়া পাখি ভেবে নিন, ওরা একে অন্যের মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন। যাই হোক, বিজ্ঞানীরা এই ফিঞ্চদের আলাদা আলাদা আলোক-পরিস্থিতিতে রেখেছেন – এক দলকে সাদা আলোয়, অন্যান্য দলকে সবুজ, লাল বা নীল আলোয়। তারপর তাদেরকে মনের সুখে উড়তে দিয়ে দেখেছেন, তারা ভদ্র ছাত্রের মতো প্রশিক্ষণ মেনে একটা নির্দিষ্ট উড়ানপথ ধরে উড়ে চলেছে। এরপর তাদের ঘরে ১.৪ মেগাহার্ট্‌জ রেডিও-ফ্রিকুয়েন্সি যুক্ত তড়িৎ-চুম্বকীয় আবেশ সৃষ্টি করেছেন। এই ধরনের আবেশের শক্তি প্রাকৃতিক চৌম্বকীয় শক্তির তিনহাজার ভাগের এক ভাগ। এত মৃদু শক্তিসম্পন্ন হলেও, এই কৃত্রিম চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাব হল চমকে দেওয়ার মতো। যেখানে যেখানে এই চুম্বকক্ষেত্র ছিল, সেখানেই ফিঞ্চদের উড়ানপথ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে গেল। নির্দিষ্ট অক্ষ থেকে বেরিয়ে একেবারে দিগভ্রান্তের মতো তারা উড়তে থাকল।  এমন ঘটনা একমাত্র তখনই ঘটা সম্ভব যখন এই রেডিও-ফ্রিকুয়েন্সি প্রাকৃতিক চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের সঙ্গে কোয়ান্টাম-বিজড়িত যুগলের সংযোগে বাধা দেয়। 

দুইয়ে-দুইয়ে চার করতে এরপর বিজ্ঞানীদের কোনোই অসুবিধা রইল না। এখন শুধু হাতেকলমে এইটুকু দেখানো বাকি যে Cry4-এর কোয়ান্টাম দশার মাধ্যমেই পাখিরা পৃথিবীর চৌম্বকীয় অক্ষ চিনে নেয়। সেকাজেও এগোনো গেছে অনেকটাই। সম্প্রতি ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, ঠিক কীভাবে Cry4-এর মধ্যে কোয়ান্টাম-বিজড়িত দশা তৈরি হয়। Cry4 বা অন্যান্য ক্রিপ্টোক্রোমের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে রকমারি সহযোগী অণু, এদের বলে কো-ফ্যাক্টর। Cry4-এর মধ্যে থাকা ট্রিপ্টোফ্যান অ্যামিনো অ্যাসিড আর পাশে থাকা কো-ফ্যাক্টরের মধ্যে নিরন্তর ইলেকট্রনের আদান-প্রদানের ফলে তারা দুটিতে জুটি বেঁধে নিরুত্তাপ থেকে উত্তেজিত – এই দুই দশায় ঘোরাফেরা করতে থাকে। শুধুমাত্র একটি Cry4-এর মধ্যেই তৈরি হয়ে যায় কোয়ান্টাম-বিজড়িত যুগল! হাতেকলমে পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন, পৃথিবীর চুম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এই যুগল অবস্থা ব্যাহত হয়; তার ফলেই পাখি চিনে নেয় তার পথ। প্রমাণিত হয়, পাখিদের দেহে ‘কোয়ান্টাম কম্পাস’-এর এযাবৎ লালিত ধারণা কতটা সত্যি। মজার ব্যাপার, ১৯৭০ সালে এই ধারণার কথা প্রথম যিনি বলেছিলেন, সেই ক্লাউস শুলটেন (Klaus Schulten) কিন্তু Cry4-এর অস্তিত্ব সম্পর্কে কিছুই জানতেন না! এই পঞ্চাশ বছরে, ঘুলঘুলির পায়রা হোক কিংবা অন্য গোলার্ধের পরিযায়ী, সব পাখিদের ঘরে ফেরার গান যে আসলে একই তন্ত্রীতে ঝংকৃত তা চিনতে পারার দিকে আরও কয়েক পা এগোলাম আমরা।  

তথ্যসূত্র:

১) Zebra finches have a light-dependent magnetic compass similar to migratory birds, 2017, Journal of experimental Biology

২) Expression patterns of cryptochrome genes in avian retina suggest involvement of Cry4 in light-dependent magnetoreception, 2018, Journal of Royal Society Interface 

৩) Magnetic sensitivity of cryptochrome 4 from a migratory songbird, 2021, Nature


*********
#বিজ্ঞান #কোয়ান্টাম ফিজিক্স #প্রোটিন #ক্রোমাটোফোর #বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি #সায়নদীপ গুপ্ত #সিলি পয়েন্ট #ওয়েব পোর্টাল #বাংলা পোর্টাল #ওয়েবজিন #silly point

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

29

Unique Visitors

219143