ব্যক্তিত্ব

ঢাকায় নারীমুক্তির অগ্রদূত : বিস্মৃতপ্রায় স্বাধীনতা সংগ্রামী লীলা রায়

মন্দিরা চৌধুরী April 24, 2021 at 5:00 am ব্যক্তিত্ব

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী মহিলাদের সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় বেশ কম। যেসব মহিলারা দেশমাতৃকার টানে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতেন, তাঁদের জীবন আর সরলরেখায় চলত না। এমনই একজন মহিলা লীলা নাগ, যিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম বিনা বিচারে আটক থাকা রাজবন্দী। কেবল স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়; সমাজে অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত নারীদের সার্বিক উন্নতিসাধনেও ব্রতী হয়েছিলেন তিনি। মেয়েদের প্রতি অন্যায় অবিচার, অসম্মানের বিরুদ্ধে তাঁর চিরদ্রোহী মন ধীরে ধীরে অনিবার্যভাবে ধাবিত হয় দেশমাতৃকার পরাধীনতার জ্বালা ঘোচানোর সংকল্পের দিকে।

১৯০০ সালে আসামের গোয়ালপাড়ায় লীলা নাগের জন্ম হয়। তাঁর বাবা গিরিশচন্দ্র নাগ ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি ভারতীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং লবণ করের প্রতিবাদে একবছর পরেই পদত্যাগ করেন। মা কুঞ্জলতা নাগ ছিলেন গৃহবধূ। মাতামহ প্রকাশচন্দ্র দেব ছিলেন আসাম সেক্রেটারিয়েটের প্রথম ভারতীয় রেজিস্ট্রার। লীলার অক্ষরপরিচয়ের পাশাপাশি দেশচেতনার হাতেখড়িও হয় তাঁর মায়ের কাছে। বাবা, দাদু দুজনেই সরকারি চাকরি করা সত্ত্বেও তাঁদের বাড়িতে বিলাতি কাপড় বর্জিত হয়েছিল, পরিবর্তে গৃহীত হয়েছিল বঙ্গলক্ষ্মী মিলের খদ্দরের কাপড়।  ক্ষুদিরামের ফাঁসির দিন বাড়িতে অরন্ধন পালিত হয়েছিল। ছোটোবেলা থেকে বাড়িতে দেখা এসব টুকরো টুকরো ঘটনাই লীলার মধ্যে দেশপ্রেমের বীজ বুনে দিয়েছিল। 

লীলার প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় ঢাকার ইডেন স্কুলে। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে বি.এ. পাশ করেন। এই পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম হয়ে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদ্মাবতী স্বর্ণপদক লাভ করেন।  এরপর লীলা কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. পড়ার পরিকল্পনা করেন, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্র-ছাত্রীদের একত্র শিক্ষা প্রচলিত ছিলো না৷ সেই সময় লীলার মেধা আর পড়ার আগ্রহ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলার ড. হার্টস তাঁকে এম.এ. পড়ার বিশেষ অনুমতি দেন। ১৯২৩ সালে লীলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় বিভাগে ইংরেজিতে এম.এ. পাশ করেন।  

 পড়াশোনা চলাকালীন ১৯২১ সালে লীলা 'নিখিল বঙ্গ নারী ভোটার কমিটি'-এর সহ-সম্পাদিকা হন। বিভিন্ন জায়গায় নারীদের সামাজিক ও আর্থিক অধিকার সম্পর্কিত সভা-সমিতি আয়োজন করেন। গান্ধিজি পরিচালিত অসহযোগ আন্দোলনেও তিনি অংশ নিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি ঢাকাতে বারো জন সদস্য নিয়ে 'দীপালী সংঘ' নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বারোটি অবৈতনিক বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। পরে লীলার উদ্যোগে ঢাকায় 'নারী শিক্ষামন্দির' আর 'শিক্ষাভবন' নামে আরও দুটি উচ্চ বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। শিক্ষাবিস্তারের পাশাপাশি দীপালী সংঘের উদ্যোগে প্রতি বছর ঢাকায় 'দীপালী শিল্প প্রদর্শনী' হত, এখানে মেয়েদের হাতের কাজ, অন্যান্য কারিগরি কাজের প্রদর্শনী হত। এই সবকিছুই ছিল মেয়েদের স্বাবলম্বী করে তোলার একটা প্রয়াস। এছাড়া মহিলা কলেজের আবাসিক ছাত্রীরা যাতে সবার সঙ্গে মেলামেশা করতে পারে এবং রাজনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে 'ছাত্রীভবন' নামে কলেজ ছাত্রীদের জন্য একটি হোস্টেল খোলা হয়েছিল। এর মূল পরিকল্পনা ছিল লীলা নাগেরই। পূর্ববঙ্গে নিগৃহীত নারীদের সুরক্ষা ও শুশ্রূষার জন্য 'নারী আত্মরক্ষা ফান্ড' নামে একটি ফান্ড তৈরি করেন লীলা, এবং মেয়েদের আত্মরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য লাঠিখেলা, জুজুৎসু ইত্যাদি তাদের শেখানোর ব্যবস্থা করেন। ১৯৩০ সাল থেকে লীলা নাগের উদ্যোগে 'জয়শ্রী' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।  এই পত্রিকাটি ছিল বাংলার মেয়েদের মুখপত্র এবং এর লেখকগোষ্ঠীতেও প্রধানত মহিলারাই ছিলেন৷ পত্রিকা প্রকাশের সময় থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার আগে পর্যন্ত লীলা এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই লীলা রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। লবণ সত্যাগ্রহের সময়ে লীলা ঢাকার মহিলাদের নিয়ে 'ঢাকা মহিলা সত্যাগ্রহ সমিতি' স্থাপন করেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে লবণ তৈরি করে ইংরেজের লবণ আইন ভঙ্গ করেন। গান্ধিজীর ডান্ডি অভিযান ও সত্যাগ্রহ আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করেন ঢাকা ও সংলগ্ন অঞ্চলে। ১৯৩০ সালে 'শ্রীসংঘ'-এর নেতা অনিল রায় গ্রেপ্তার হলে দলের নেতৃত্ব এসে পড়ে লীলার হাতে। বেশ কিছুদিন সুষ্ঠুভাবে তিনি দল পরিচালনা করেন। ১৯৩১ সালে সরকারবিরোধী কাজ করার অভিযোগে পুলিশ তাঁকে কয়েকজন সহকর্মীসহ রাজবন্দী হিসেবে কারারুদ্ধ করে।

ছয় বছর বন্দী থাকার পর ১৯৩৭ সালে লীলা জেল থেকে ছাড়া পান। এরপর ১৯৩৮ সালে লীলা নাগ ও অনিল রায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিয়ের পর লীলা নাগ পরিচিত হন লীলা রায় নামে।  ১৯৩৮ সালে সুভাষচন্দ্র বসু কংগ্রেস সভাপতি থাকাকালীন যে জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠিত হয়, সেই কমিটিতে লীলা রায় বাংলা থেকে মহিলা সাব-কমিটির সদস্য মনোনীত হন। এই দায়িত্ব তিনি যথাযথভাবে পালন করেন, তিনি কমিশনের কাছে দীর্ঘ এবং তথ্যনিষ্ঠ রিপোর্ট পেশ করেন। ১৯৩৯ সালে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠিত হলে লীলা রায় ও অনিল রায় সুভাষচন্দ্রের সহযোগী হিসেবে ফরওয়ার্ড ব্লক-এর সংগঠন ও বিবিধ কর্মসূচীতে যুক্ত হন। পুলিশের চোখ এড়িয়ে পালানোর আগে সুভাষচন্দ্রের নির্দেশ অনুযায়ী লীলা রায় ও অনিল রায় বিহার, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি ও মধ্যপ্রদেশের বিভিন জায়গায় ফরওয়ার্ড ব্লক গঠনের উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বযুদ্ধের পরিস্থিতিতে জাতীয় আন্দোলন সংগঠিত করার জন্য ব্যাপক প্রচার চালান। ১৯৪১ সালে লীলা রায়ের বাংলার বাইরে যাওয়া এবং সভা-সমতিতে বক্তৃতা করায় সরকারের তরফে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। আবার ভারতে 'ক্রিপস মিশন' ব্যর্থ হওয়ার পর ফরওয়ার্ড ব্লককে বেআইনি ঘোষণা করা হয় এবং কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হতে থাকে। ১৯৪২ সালে লীলা রায়কে বন্দী করা হয়। পুলিশ 'জয়শ্রী' পত্রিকার অফিস বন্ধ করে দেয় এবং জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করে দ্বিতীয় দফার জেলবাসের পর ১৯৪৬ সালে লীলা মুক্তি পান। 

কারামুক্ত হওয়ার পর লীলা আবার ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশের কাজে। কলকাতা আর নোয়াখালিতে '৪৬-এর দাঙ্গার পর তিনি নোয়াখালিতে যান দুর্গতদের সেবা করার জন্য। সেখানে তিনি 'ন্যাশানাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট' নামে সেবাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ও সেই প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক নিযুক্ত হন। এরপর ভারত-বিভাজনের সময় লীলা তাঁর আজীবনের কর্মভূমি ঢাকা ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। সেখানেও তিনি আজীবন জনসেবার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন।

আরও পড়ুন : নেতাজিকে বাঁচাতে নিজের স্বামীকে হত্যা করতেও পিছপা হননি নীরা আর্য / টিম সিলি পয়েন্ট

১৯৬৬ সাল থেকে লীলার স্বাস্থ্যহানি হতে থাকে। ১৯৬৮ সালে গুরুতর অসুস্থতার কারণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তিনি বাকশক্তি হারান। শরীরের এক দিক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। প্রায় আড়াই বছর সংজ্ঞাহীন থাকার পর ১৯৭৯ সালে মহীয়সী এই নারীর জীবনাবসান ঘটে।       

................................................ 

তথ্যঋণ : Flaming Leela Roy / Agomoni Lahiri, Bijoy Kumar Nag   

#লীলা নাগ #লীলা রায় #স্বাধীনতা সংগ্রামী #নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু #মহাত্মা গান্ধী #অনিল রায় #গিরিশচন্দ্র নাগ #ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় #ফরওয়ার্ড ব্লক #Freedom Fighter #Leela Nag #Leela Roy #নারীমুক্তি # সিলি পয়েন্ট #মন্দিরা চৌধুরী

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

22

Unique Visitors

219137