নিবন্ধ

এক যে আছে কন্যা

চয়ন সমাদ্দার Mar 5, 2021 at 6:41 am নিবন্ধ

অনেক অনেক দিন ধরে, পশ্চিমি রূপকথা জগতে, আছে এক কন্যা। সে যে কত প্রাচীন, তার হিসেব মেলে না। সভ্যতার প্রায় সমান বয়সি মনে হয় তাকে। তবে, তার কথা শুরু করতে গেলে, আমাদের একবার তাকাতে হবে, পাশ্চাত্য রূপকথার পৃথিবীটার দিকে। 

রূপকথা যে ছোটোদের সামাজিক আর সাংস্কৃতিক জীবনের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে, এ বিষয়ে কারও কোনও সংশয় নেই। কিন্তু, একটা সাহিত্যিক জঁর বা ধারা হিসেবে এর ঐতিহাসিক ক্রমবিবর্তনের হদিশ পণ্ডিতরা পাননি। শিশু সাহিত্যের ইতিহাসে রূপকথা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, থান থান পণ্ডিতি বই লেখা হয়েছে তাকে নিয়ে; কিন্তু ছোটোদের জন্য সৃষ্ট রূপকথার কোনও সামাজিক ইতিহাস নেই। কেবল এক হাঁ করা শূন্যতা রয়েছে খালি। হয়তো, মানুষ যবে থেকে কথা বলতে শিখেছে তবে থেকেই সে গল্প শোনাচ্ছে, পরবর্তী প্রজন্মকে, তাদের শান্ত করার জন্যে, ঘুম পাড়ানোর জন্যে। গল্প বলে তাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে কিছু অনুশাসন, হয়তো বা আত্মচেতনা। রূপকথা সর্বকালীন, সর্বজনীন, চিররহস্যময় ও সুন্দর। 

মুখে মুখে ছড়াতে ছড়াতে, একসময় রূপকথা বাঁধা পড়ল অক্ষরশৃঙ্খলে। লিখিত রূপ ধরল সে। হল সাহিত্যের অংশ। আর, অমনি দেখা গেল, সেই চিরকালীন ছোটো/বড়ো ভেদাভেদ নিয়ে সমস্যাটা মাথা চাড়া দিয়েছে। কারণ, ছোটোদের আর বড়োদের রূপকথার মধ্যে ফারাক করা ভারী মুশকিল। যে মুখে মুখে গল্প বলার পরম্পরা থেকে সাহিত্যের এই ধারার জন্ম, সেই গল্পের কথক তো ছিল বড়োরাই। তারাই এর জন্ম দিয়েছে, তারাই একে লালন করেছে। এবং যখন এটি সর্বজনমান্য সাহিত্যের এক রূপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল– সপ্তদশ কি অষ্টাদশ শতকে– তখন এর প্রসার ও প্রচারের দায়িত্ব নিয়েছিল বড়োরাই। শিশু-কিশোর সাহিত্যজগতে এই জটিল প্রক্রিয়া বরাবরই চলে আসছে। ইওরোপে রূপকথা-সাহিত্যের আবির্ভাব নিয়ে যাঁরাই গবেষণা করেছেন, তাঁরাই এক বাক্যে বলেছেন যে, শিক্ষিত,প্রাপ্তবয়স্ক লেখকরা, সচেতনভাবে, মুখে মুখে বলা লোককথাকে, তত্ত্বের ভাষায় যাকে বলে, অ্যাপ্রোপ্রিয়েট করে, মানে, গল্পের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে, নিজেদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য বিস্তার করে, তাকে এক বিশেষ ধরনের বয়ানে বদলে দিয়েছেন। ফলে, গল্পগুলো, তাঁদের আচরণবিধি-মূল্যবোধ-আচরণপ্রণালী– এই সব কিছুর বাহক হয়ে, ছোটো-বড়ো নির্বিশেষে পাঠককে, সেই সময়ের প্রভুত্বকারী ক্ষমতার নির্দেশিত পথে, ‘সুসভ্য নাগরিক’ করে তুলতে চেয়েছে। ষোড়শ শতকের ইটালিতে শুরু হয় এই প্রক্রিয়া, তারপর ফ্রান্সে এসে শিকড় বিস্তার করে। 

সত্যি কথা বলতে, রূপকথা বা ফেয়ারি টেল্‌ বা কঁত দে ফি শব্দটা ফ্রান্সেই সৃষ্টি হয়। ব্যারনেস দোলিনোয়া এর জননী। ১৬৯০ সাল থেকেই লোককথাকে বিদগ্ধ রূপ দিয়ে, বিভিন্ন সাঁলোতে শোনাচ্ছিলেন, ব্যারনেস দোলিনোয়া, মেরি ক্যাথরিন বাহানুভিল প্রমুখ। এঁদের কাছে শোনা গল্প আর নিজের সংগ্রহ করা কয়েকটি কাহিনি জুড়ে, ১৬৯৭ সালে শার্ল পেরো প্রকাশ করলেন, ‘ইস্তোয়াস্‌ উ কোঁত ড্যু ত্যঁ পাস্‌’ বা ‘নীতিকথা সহ বিগত দিনের গল্প-কথা’। যে কন্যার কথা বলব বলে, এই লেখা ধরেছি, তার কথা প্রথম পড়ল ইওরোপ। নাম তার সিন্ডারেলা। 

নিশ্চয়ই মনে আছে তাকে? সেই যে সেই মেয়েটি, যে রান্নাঘরে, কালিঝুলি মেখে বিশ্রী হয়ে থাকত, আর পাজি সৎমা আর বদমাশ দুই সৎবোনের অত্যাচার সইত? তারপর, একদিন পরি-ধর্মমায়ের জাদু তাকে রূপসি করল। কুমড়ো থেকে জাদুবলে তৈরি জুড়িগাড়ি টানল ঘোড়া হয়ে যাওয়া ইঁদুর। রাজকুমারের নাচের আসরে সবার নজর কাড়ল সে। তবে, জাদুর মেয়াদ মাঝরাত্তির পর্যন্ত। এক রাতে নাচতে নাচতে দেরি হয়ে গেল। রাজবাড়ির পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটা বাজল। হরিণীর মতো ছুটে পালাতে গিয়ে সিন্ডারেলার এক পাটি কাচের জুতো গেল পা থেকে খসে। তারপর কেমনভাবে রাজ্যসুদ্ধ মেয়েকে  সেই জুতো পরিয়ে, সিন্ডারেলাকে খুঁজে পাওয়া গেল, আর কেমন করে সে রাজকুমারের বউ হল,  সে তো আপনারা জানেনই। 

সিন্ডারেলা মুগ্ধ করে সকলকে। এক সোজা সরল মেয়ের গরিবি থেকে আমিরি-তে যাত্রার সোজা গল্প পড়ে সবাই পুলকিত হয়। আর, তারপরই বাধে গোল। রূপকথা বিশেষজ্ঞরা আবিষ্কার করেন, পশ্চিমি রূপকথাভুবনে, আর অন্য কোনও গল্পের, সিন্ডারেলার মতো এত বেশি, প্রাচীন, স্বাধীন আর অনেকটা জায়গা জুড়ে, ছড়ানো-ছিটোনো ভিন্ন-ভিন্ন রূপ নেই। উনিশ শতকের ইওরোপের তুলনামূলক পুরাণচর্চার ছাত্ররা, সিন্ডারেলার মধ্যে বৈদিক ঊষার ছায়া লক্ষ করল। বোধহয়, নিজের ছাই-কালি মাখা রূপ ছেড়ে, রাজকন্যা বেশে ভাস্বতী হওয়ার জন্যই এই তুলনা। ঋগ্বেদ মণ্ডল ১ সূক্ত ১১৩ বা ঋষি কুত্‌স অঙ্গিরসের ঊষা সূক্তের চতুর্দশতম শ্লোকে পাচ্ছি, 

বি-অঞ্জিভির্‌ দিব আতাসু-অদ্যৌদ্‌

অপ কৃষ্ণাং নির্ণিজং দেবী-আবঃ।

প্রবোধয়ন্তী-অরুণেভির্‌ অশ্বৈর্‌

আ-ঊষা যাতি সু্যুজা রথেন।।


মানে,

কালো আবরণ খুলে ফেলে দিয়ে– আলো

আকাশের বুকে ঝলকে ঝলকে দিকে দিকে ঝল্‌কাল।

অরুণ-কিরণে জগৎ জাগিয়ে আসে

রাঙা ঘোড়া জুতে সুন্দর রথে আসে ঐ ঊষা আসে। (অনুবাদ– গৌরী ধর্মপাল)


১৮৮৩ সালে লোককথার ইতিহাস নামে এক বইতে এঞ্জেলো দা গুবেরনেতিস নামে এক পশ্চিমি পণ্ডিত এই আলোর রথের কথা লেখেন। লিখুন। ক্ষতি নেই। কিন্তু, ঊষা-সূক্ত দিয়ে সিন্ডারেলার ব্যাখ্যা, আমার অনেকটা ‘সব কিসু ব্যাদে আসে’ গোত্রের মনে হয়! তার চেয়ে বরং খ্রিস্টীয় নবম শতকের চৈনিক গল্পটি বেশি বিশ্বাসযোগ্য ঠেকে, সিন্ডারেলার আদিরূপ হিসেবে। তাও পুরোপুরি নয়।

চীন দেশে ‘ইয়ে হ্‌সিইয়েন্‌’ নামে পরিচিত গল্পটি। গল্পটা উ নামে এক গুহাবাসীর। তার ছিল দুই বউ। উ মারা গেলে, তার ছোটো বউ, সতিনঝি ইয়ে হ্‌সিইয়েনের ওপর অত্যাচার শুরু করল। সে ছিল ভারী লক্ষ্মী মেয়ে। মুখ বুজে সইত সব। রোজ তাকে নদী থেকে জল আনতে হত। একদিন, ইয়ে হ্‌সিইয়েন, নদী থেকে একটা দু-ইঞ্চি মতো লম্বা মাছ পেল। সেটাকে সে বাটিতে রাখল, কিন্তু সে মাছ, দেখতে দেখতে এত বড়ো হয়ে গেল যে, তাকে পুকুরে রেখে আসতে হল। ইয়ে হ্‌সিইয়েন রোজ মাছটাকে খেতে দিত। একদিন, তার পোশাক পরে ইয়ে হ্‌সিইয়েনের সৎমা, পুকুরের ধারে গেল, মাছটা মুখ বাড়াতেই, ছুরি দিয়ে কুপিয়ে মারল তাকে। তারপর, রেঁধে খেয়ে ফেলল। ইয়ে হ্‌সিইয়েনের কান্নায়, সৃষ্টি কাঁদতে লাগল। তখন, আকাশ থেকে নেমে এলেন এক পুরুষ। বললেন, মাছের কাঁটা, সৎমা লুকিয়েছে গোবরগাদায়। যদি, সে কাঁটাগুলো নিজের ঘরে এনে, তাদের কাছে প্রার্থনা করে, তার  সব মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হবে। এইভাবে, ইয়ে হ্‌সিইয়েন পেল মুক্তো, সুখাদ্য, সুন্দর পোশাক। এটা যে সময়ের কথা, চিন বা হান রাজবংশের রাজত্বকালেরও আগে– তখন চিনে গুহা উৎসব বলে একটা উৎসব হত। সৎমা আর তার মেয়ে সেখানে গিয়ে, বাড়ি ফেরার উপক্রম করছে যখন, সবাই দেখল, পানকৌড়ির পালকে বোনা পোশাক আর সোনার জুতো পরা এক কন্যেকে। কিন্তু, ইয়ে হ্‌সিইয়েনের নতুন রূপ ধরা পড়ে গেল তার সৎবোনের কাছে। ভয়ে ছুটে পালানোর সময়, এক পাটি সোনার জুতো খুলে গেল তার। একটা লোক সেটা কুড়িয়ে নিয়ে, বেচতে গেল, পাশের রাজ্য তো-হান দ্বীপে। সে রাজ্যের রাজা, সেই জুতো কিনলেন, এর মালকিনকে বিয়ে করবেন বলে ঠিক করলেন, ইয়ে হ্‌সিইয়েনের দেশে সব মেয়ের পায়ে জুতোটা হয় বড়ো, নয় ছোটো হল; একমাত্র ইয়ে হ্‌সিইয়েনের পায়েই ঠিক হল; রাজার সঙ্গে  বিয়ে হল তার। শিগগিরই উড়ন্ত পাথর নেমে এল আকাশ থেকে। তার ঘায়ে মরল ইয়ে হ্‌সিইয়েনের সৎমা আর বোন। কিন্তু, সেই জাদু মাছের কাঁটার কাছ থেকে মনের মতো জিনিস পেয়ে পেয়ে ইয়ে হ্‌সিইয়েনের বর রাজার লোভ গেল বেড়ে। পরের বছর, কাঁটা মনোবাসনা পূর্ণ করা বন্ধ করে দিল। তখন রাজা সেগুলো বেলাভূমিতে পুঁতে, জায়গাটা সোনা দিয়ে ঘিরে দিলেন। আর, তারপরই ঘটল সেনাবিদ্রোহ। বিদ্রোহীরা সোনা ঘেরা জায়গাটা খুঁড়তেই, এক বিশাল ঢেউ এসে কাঁটাগুলো ভাসিয়ে নিয়ে গেল। 

গল্পটায় সিন্ডারেলার জুতোর ব্যাপারটা থাকলেও, মূল কাহিনি আবর্তিত হয়েছে জাদু মাছকে ঘিরে। এর সঙ্গে সেই জেলে আর তার লোভী বউয়ের গল্পেরও বেশ মিল আছে। গল্পের শেষটাও ঠিক ‘সুখে শান্তিতে থাকতে লাগল’ ধরনের নয়। বরং, প্রকৃতির জাদুর প্রকৃতির বুকে মেশার, আর লোভের শাস্তি পাওয়ারও বটে। 

তবে, এটা ঠিক, সিন্ডারেলার গল্পের সঙ্গে যে পবিত্র আবহ জড়িয়ে আছে, তার খানিকটা আভাস, এই গল্পে পাওয়া যায়। 

সিন্ডারেলা গল্পের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইওরোপীয় রূপ পাওয়া যায় ইটালিতে। আগেই বলেছি, রূপকথা-সাহিত্য ওই দেশ হয়ে ফ্রান্সে এসেছিল। ১৬৩৪-৩৬ সালে প্রকাশিত হয় জামবাতীস্তা বাসিলেহ্‌-এর ‘লো কুন্তো দেহ্‌ লি কুন্তি’ বা ‘গল্পকথার গল্প’। নেপলিটান ডায়লেক্টে রচিত, বোকাচ্চোর ‘ডেকামেরন’ প্রভাবিত এই বই ছোট্ট মানুষদের মনোরঞ্জনকল্পে লেখা হয়েছিল। বইটাতে পাঁচদিনে, দিনে দশটা করে, মোট পঞ্চাশটা গল্প বলেছে কথক-কণ্ঠ। প্রথম দিনের ষষ্ঠ গল্পের নাম ‘সিন্ডারেলা বিল্লি’। এ গল্প এক বিপত্নীক রাজকুমারের, যার দ্বিতীয় বউ, প্রথম বউয়ের মেয়ের ওপর অত্যাচার করে। সেই মেয়ে, যার নাম ৎসিজোল্লাহ্‌, তার সেলাই দিদিমণির কাছে সৎমার নামে অভিযোগ করে। দিদিমণি, তাঁর ছাত্রীকে ভালোবাসেন; এতটাই যে, ৎসিজোল্লাহ্‌ ক্রমাগত বলে, ‘তুমি আমায় এত আদর করো। তুমি আমার মা হবে না কেন?’ একদিন দিদিমণি বললেন, তাঁর সব কথা যদি ৎসিজোল্লাহ্‌ শোনে, তবে তিনি তার মা হবেন। দুজনে মিলে একটা প্ল্যান করা হল। সৎমা যেহেতু ৎসিজোল্লাহ্‌ ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক পরলে খুশি থাকতেন; পুরোনো পোশাক রাখার ঘর থেকে একটা শতচ্ছিন্ন জামা নেওয়ার অছিলায়, ৎসিজোল্লাহ্‌ সৎমাকে সেই ঘরে নিয়ে এল। সে বলল, জামাটা আছে ওই কাঠের বাক্সে। ডালা তুলে যখন সৎমা জামা খুঁজছে, ৎসিজোল্লাহ্‌ সেই ডালা দমাস করে ফেলল মহিলার মাথার ওপর। ঘাড় মটকে অক্কা পেল সে। দিদিমণির পরামর্শে খুন করার পর, ৎসিজোল্লাহ্‌ বাবাকে রাজি করাল দিদিমণিকে বিয়ে করতে। কিন্তু, হায়! এই দ্বিতীয় সৎমা যে প্রথমজনের চেয়েও পাজি! 

দিদিমণি-সৎমাও খারাপ হওয়াটা সম্ভবত খুনের শাস্তি। আবার নাও হতে পারে। সে সময়ের নেপলিটান বাস্তবতাবোধ অন্যরকম ছিল। যেটা আসল কথা, সেটা হল, যে শান্ত নরমসরম লক্ষ্মী মেয়ে সিন্ডারেলাকে সারা দুনিয়া চেনে, তার প্রথম ইওরোপীয় অবতার, একেবারেই সেরকম নয়। সে শুধু যে প্যাসিভ রোলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাই নয়, খুনও করে বসে। আমি এইমাত্র বললাম, দিদিমণির খারাপ সৎমা হওয়া ৎসিজোল্লাহ্‌-এর খুন করার শাস্তি হতেও পারে, নাও হতে পারে, তার কারণ, ‘গল্পকথার-গল্প’-র নৈতিক মহাবিশ্ব একেবারে আলাদারকম। যতই প্রাচীনপন্থী গবেষকরা ভাবুন যে রূপকথা নীতিশিক্ষা দেবেই, আধুনিক গবেষণা দেখায় শঠতা, প্রবঞ্চনা, অসততা, এমনকি নরহত্যা রূপকথায় ফিরে ফিরে আসে। আসল কথা, যাঁরা এই গল্পগুলো বলতেন, তাঁরা জীবনের সবরকম রূপের সঙ্গে পরিচিত করাতে চাইতেন ছোটোদের। এইসব গল্পের লিখিত রূপেও তাই আদিম হিংস্রতা মাঝে মাঝেই উঁকি মারে। শার্ল পেরোর গল্পগুলোর শেষে পদ্যে লেখা নীতিকথা অনেক সময়ই গল্পের নৈতিকতাবর্জিত প্রকৃতির সঙ্গে খাপ খায় না। 

বাসিলেহ্‌-এর ‘সিন্ডারেলা বিল্লি’-র সমস্যাসংকুল প্রকৃতির সঙ্গে গ্রিম ভাইরা পরিচিত ছিলেন। ১৮২২ সালে গ্রিমরা বাসিলেহ্‌-এর পঞ্চাশটা গল্পই, সংক্ষেপে, তাঁদের ‘কিন্ডার উন্ঠ্‌ হাউস্মারখেন্‌’ বা ‘শিশু এবং গৃহস্থালির গল্প’-এর দ্বিতীয় সংস্করণের তৃতীয় খণ্ডে, পরিশিষ্টের অন্তর্ভুক্ত করেন। এবং ‘সিন্ডারেলা বিল্লি’ গল্পটা পুরো বদলে যায়। ৎসিজোল্লাহ্‌ হয়ে ওঠে এক ভালোমানুষ খুকি, ভারী ছেলেমানুষ। সে বেচারিকে সেলাই দিদিমণি ব্যবহার করে আসলে। এবং খুনটা দিদিমণিই করে, ৎসিজোল্লাহ্‌ নয়। বাসিলেহ্‌-এর লেখায় ছিল, খুনের পরিকল্পনা থেকে তাকে বাস্তবায়িত করা, সবটাই ৎসিজোল্লাহ্‌-এর কীর্তি। নতুন নীতিবোধের দুনিয়ায় নবজন্ম ঘটল, শান্ত-লক্ষ্মী মেয়ে সিন্ডারেলার। 

গ্রিমদের অনেক আগে, ১৬৯৭ সালে, তাঁর ‘ইস্তোয়াস্‌ উ কোঁত ড্যু ত্যঁ পাস্‌’ বইতে, শার্ল পেরো, গল্প আরম্ভ করেছেন, এক ভদ্রলোকের, একজন দাম্ভিক মহিলাকে দ্বিতীয়া স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা দিয়ে। পেরোর গল্পটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এই কারণে, উনিশ শতকে যখন সিন্ডারেলার বিভিন্ন রূপ জার্মানিতে সংগ্রহ করা শুরু হয়, তখন, প্রথম দুই দশকে, বহু জার্মান রচনা, ফরাসি রূপটিকেই একটু অদলবদল করে লেখা হয়েছিল। তবে, গ্রিমদের সিন্ডারেলা আর পেরোর সিন্ডারেলার মধ্যে প্রচুর পার্থক্য আছে।

পেরো নিজের গল্পে, বিপত্নীক ভদ্রলোকটির পরলোকগতা স্ত্রীকে নিয়ে মাথা ঘামাননি। বদ সৎমাই তাঁর গল্পের কেন্দ্রবিন্দু। ওদিকে, গ্রিম ভাইরা মৃত্যুপথযাত্রিণী এক ধর্মিষ্ঠা প্রথমা স্ত্রীর, আবেগবহুল অন্তিম সম্ভাষণ দিয়ে গল্প আরম্ভ করেছেন। আসলে, পেরো একেবারে ছাপমারা ফরাসি ধরনে, দুরকম নারী প্রকৃতির সংঘাত এঁকেছেন : নীতিনিষ্ঠ, যা সরলা, অবলা প্রকৃতির মধ্যে কায়া পায়; এবং নীতিহীন, যা সমাজের কাছ থেকে, যা চায়, তাকে ছলে-বলে-কৌশলে অধিকার করতে চায়। এই দ্বিতীয় ধরনের মেয়েরা হাত-পা গুটিয়ে ‘ভালো’ হয়ে থাকে না। তারা ছক কষে, হাতে কলমে কাজ করে, সমাজে সক্রিয় ভূমিকা নেয়। যেহেতু, এই জাতীয় মেয়েদের কনট্রোল করা মুশকিল, তাই তারা বাজে মেয়ে! 

অন্যদিকে, গ্রিমদের প্রোটেস্টান্ট জগৎচিন্তা, প্রকৃতির মধ্যে মূর্ত হতে দেখে, কঠোর হাতে বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণকারী এক ঐশী বিচারকে। তাই গল্পের শেষে দুটো সাদা পায়রা, ঠুকরে, দুই বদমাইশ সৎ বোনকে অন্ধ করে দেয়। 

পেরোর গল্পের শেষটা কিন্তু অন্যরকম। সৎবোনরা সিন্ডারেলার পায়ে ধরে মাফ চায়। এবং, নিরীহ মেয়েটি তাদের ক্ষমা না করে থাকতে পারে না।

জাদুর ভূমিকাও পেরো আর গ্রিমে দুরকম। পেরোর গল্পে পরি-ধর্মমা, সাদা জাদুর প্রতীক, যা প্রকৃতিকে উলটেপালটে রূপকথার জগতের মতো করে গড়ে নেয়। গ্রিমদের কাহিনিতে, সিন্ডারেলার মা মারা যাওয়ার পর একদিন তার বাবা মেলা থেকে তাঁর তিন মেয়ের  জন্যই কিছু না কিছু আনতে চান। সৎবোনেরা দামি দামি জিনিস চায়। সিন্ডারেলা চায়, সেই গাছের ডাল, যা প্রথম তার বাবার টুপি ছোঁবে। বাবা তাকে এনে দেন এক হেজেল গাছের ডাল। মায়ের কবরের পাশে সেই ডাল পুঁতে, চোখের জলে মাটি ভেজায় সিন্ডারেলা। দেখতে দেখতে সেই ডাল বদলে যায় এক পাতাছাওয়া গাছে, যার ডালে এসে বসে সাদা পায়রার দল। এই গাছ আর পায়রারাই জাদুর রঙে রাঙায় সিন্ডারেলার জীবন।  

জার্মান আর ফরাসি গল্পের মধ্যে এই যে ফারাক, তার মধ্যে ধর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। গ্রিমরা যখন লিখছেন, তখন জার্মানি একদিকে খ্রিস্টধর্মের প্রোটেস্টান্ট রূপটিকে আপন করছে, অন্যদিকে তখন জার্মান রোমান্টিসিজম্‌ তুঙ্গে। ফলে, মৃতা মায়ের আত্মা মিশে যাচ্ছে হেজেল গাছের সঙ্গে, সিন্ডারেলাকে খ্রিস্টীয় রীতিনীতি মেনে, মায়ের আত্মার সুরক্ষা পেতে হচ্ছে। মায়ের কবর কথাটা বারবার ফিরে আসছে গল্প জুড়ে। বাসিলেহ্‌ বা পেরো প্রকৃতিকে এক অন্ধ এবং নির্মম শক্তি দ্বারা শাসিত হতে দেখেছেন; মানুষের মনের আঁধারকে শক্তিশালী নির্ধারক হিসেবে দেখেছেন; কিন্তু, গ্রিমরা মৃতা মা-কেই মূল চরিত্র করে তুলেছেন, যেহেতু তিনি ক্রিশ্চান সোল। সিন্ডারেলার মা ছিলেন ধনবতী ও ধর্মপ্রাণা। গ্রিমদের গল্প বলছে, মায়ের কথামতো চললে, সিন্ডারেলাও ঠিক তাই হবে। এটাই সভ্য হওয়ার দস্তুর। আর সভ্যতা মানে বাইরের দুনিয়ার স্বীকৃতি। 

সিন্ডারেলা একলা ঘরের কোণে বসে থাকে যখন, তখন সে নোংরা, কালিঝুলি মাখা, খানিক বিশ্রীও। সেই একই মেয়ে অপরূপা হয়ে ওঠে, ভালো ঘর-বর পায়, যখন বাইরের পৃথিবী তার অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়। এবং, রূপকথা বলে, এই স্বীকৃতি তখনই আসে, যখন জাদু বদলে দেয় জীবন। আর, যতক্ষণ পর্যন্ত, সঠিক পথে না থাকবে, জাদুর সাহায্য পাবে না। সমস্যা হল সঠিক পথটা যুগের সঙ্গে বদলে যায়। সিন্ডারেলার ইটালিয়ান, ফরাসি আর জার্মান অবতারের ভিন্নতাই তার প্রমাণ। 

সিন্ডারেলার গল্প এখনও শেষ হয়নি। বলকান, আইরিশ, স্ক্যান্ডেনেভিয়ান– বিভিন্ন কালচারে সে নানা রূপে দেখা দিচ্ছে; এমা ডনাহিউ-র (১৯৯৭) শক্তিশালী লেখনী তাকে নিজের অস্তিত্বের আঁধারে বন্দি হিসেবে উপস্থাপিত করছে; রোবের্তো ডে সিমিওনের (১৯৭৬) নাটক ‘লা গিয়াত্তা সিনেরেইন্তোলা’(সিন্ডারেলা বিল্লি) সপ্তদশ শতকের নেপলিটান সমাজ-সংস্কৃতিকে একটা বিরাট তামাশা হিসেবে হাজির করছে;’ফেবলস্‌’ গ্রাফিক নভেলে, সিন্ডারেলা নাম ভাঁড়িয়ে বাস করছে নিউইয়র্ক-এর কাছে ফেবলটাউনে, লুকিয়ে আছে, মানুষের হাত থেকে বাঁচবে বলে; ওয়ানস্‌ আপঅন আ টাইম টেলিভিশন সিরিজেও সে ছোটো শহরের বাসিন্দা, ছোটোখাটো একঘেয়েমি নিয়ে। সিন্ডারেলার গল্প বলা হয়েই চলেছে। 

আরও পড়ুন : রূপকথার গল্প : নারীর কণ্ঠ পুরুষের স্বর / ঈশা দেব পাল

ছোটোদের জন্য লেখা রূপকথা-সাহিত্য প্রায় শুরু থেকেই সকলের পাঠ্য। তবে, এখন তার উদ্দেশ্য বদলেছে। সিন্ডারেলাই তার প্রমাণ। আগে, সভ্যতার হিংস্রতাকে কাটিয়ে, মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার সংস্কৃতির মুখপাত্র হিসেবে সে পাঠক-পাঠিকাকে সভ্য করার দায়িত্ব নিয়েছিল। তবে, তার মধ্যেও ছিল প্রচুর কোনা আর খাঁজ। এখন, সে চাপিয়ে দেওয়ার ধরনধারণকেই প্রশ্ন করছে। তবু, গল্পটা থামেনি। 

আর, খুব শিগগিরই থামবেও না। 


ঋণস্বীকার- ১) গৌরী ধর্মপাল।     

          ২) আরমান্দো মাজ্জি।

          ৩) জ্যাক জাইপস্‌।

...............................................................

[অলংকরণ : ঐন্দ্রিলা চন্দ্র] 

#রূপকথা #গল্প #লোককথা #Fairy Tale #সিন্ডারেলা #ঊষা-সূক্ত #ইয়ে হ্‌সিইয়েন্ #ডেকামেরন #শার্ল পেরো #গ্রিম ভাইদের রূপকথা #Grim Brothers #এমা ডনাহিউ #গৌরী ধর্মপাল #চয়ন সমাদ্দার #ঐন্দ্রিলা চন্দ্র #সিলি পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

18

Unique Visitors

219123