পুরোনো কলকাতার পেনাল্টি
শৌভিক মুখোপাধ্যায়
Aug 23, 2020 at 3:05 pm
নিবন্ধ
খুন করলে জেল। ডাকাতি-তে ফ্যান্সি লেন।
কল্লোলিনীর গোড়ার কথা। সেজে উঠছে ব্রিটিশ কলোনি। হোয়াইট টাউনে অট্টালিকার সারি। নেটিভ টাউনে ইতিউতি কুঁড়েঘর। কাঁচা-পাকা সড়ক, পাক্কা জ্বরের ধাক্কা, জুড়ি-পাল্কির দুলুনি, বন-জঙ্গল-জলাভূমি, চোর-ডাকাতের আড্ডা।
এদের মধ্যে শেষটি বড়ই মোক্ষম।
বটতলার বই বেয়ে কলকাতাবাসীদের কাছে যখন সুখী হওয়ার আপ্তবাক্য পৌঁছয়, ‘যদি কেহ সুখী হতে চাও। হিত কথা বলি শুন উপদেশ লও।। পরস্ত্রী পরধন, সদা করিবে হরণ, মিথ্যে কথা প্রতারণ, এই কার্য্যে রও।’১ তখন বজ্র আঁটুনির ব্যবস্থা না করে উপায় কী! কালা আদমিদের থেকে নাহয় দূরে দূরে থাকা গেল, সাদা চামড়ায় বিশ্বাস করারও উপায় নেই। সে স্বজাতিই হোক, কি পড়শি দেশের বাসিন্দা। জাহাজঘাটায় নিত্যনতুন জাহাজ নোঙর ফেলে। সেলার-খালাসিরা ভিড় জমায় পাঞ্চহাউস, ট্যাভার্নে। নেশা জমে উঠলে কথা কাটাকাটি থেকে হাতাহাতি। কখনও বা শহরের নিরীহ বাসিন্দাদের আক্রমণ করে সর্বস্ব লুঠ। উটকো ঝঞ্ঝাট।
১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ই জুলাই সরকারের তরফে বলা হল, “রাইট অনারেবল গবর্ণর জেনারেল বাহাদুরের বরাবরের অভিযোগ আসিয়াছে যে, মালাই ও ম্যানিলা দেশীয় জাহাজের খালাসীরা ও কাফ্রিরা কলিকাতায় চুরি ডাকাতি দাঙ্গা-হাঙ্গামা করিতেছে।…১লা সেপ্টেম্বরের পর এই শ্রেণীর যে সমস্ত লোক জাহাজে চাকরি জোগাড় করিয়া কলিকাতা ছাড়িয়া চলিয়া না যাইবে, তাহাদিগকে ফাটকে আটক করা যাইবে।”২ এর ঠিক তিন বছর আগে এমনিই এক আদেশনামায় বলা হয়েছিল, “…প্রাতঃকালে সাতটার পূর্বে কোন পর্টুগীজ মাঝি মাল্লা সহরে প্রবেশ করিতে পারিবে না। সন্ধ্যা পাঁচটার পর সহর ত্যাগ করিয়া তাহাদিগকে জাহাজে উঠিতে হইবে।”৩ বাইরের লোকদের নাহয় ঠেকানো গেল, কিন্তু ঘরের মানুষদের? ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে মিলিটারি ডাকাতের দাপটে এসপ্ল্যানেড, ময়দান চত্বর, ফোর্ট উইলিয়ামের আশেপাশে সন্ধ্যার পরে পা দেওয়া যেত না।
“তখন লালবাজারে ও বড়বাজারে দুইটি জেলখানা ছিল।... এই সময়েই দশ টাকা বেতনে প্রথম জেল- দারোগা নিযুক্ত হন। দুইটি জেলে আন্দাজ চারিশত কয়েদী ছিল।’ ( Proceedings of the board , dated 21st December 1767)৪
সংখ্যাটা ক্রমশ বাড়তে থাকে। জায়গায় কুলিয়ে উঠতে না পাড়ায় ময়দানের এক কোণে নতুন জেলখানা নির্মাণ করা হয়। হরিণবাড়ি জেল নামে আমরা যাকে চিনি।
আটকের পর বিচার। তারপরে শাস্তি। পুরোনো কলকাতার অবধারিত পেনাল্টি। যেখানে খুনের সাজা জরিমানা, দ্বীপান্তর, হাজতবাস। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানিতে সরাসরি মৃত্যুদণ্ড। “কড়া ফাঁসি। যার বাড়িতে ডাকাতি করেছে,তার বাড়ির আশেপাশে ফাঁসি দিতে হবে। এবং যতক্ষণ একেবারে না মরে যায়, ততক্ষণ ফাঁসিতে ঝুলবে।”৫ “উইলিয়াম ও তার স্ত্রী অ্যান স্মিথের পাঞ্চ হাউসটি অনৈতিক কাজকর্ম ও বিশৃঙ্খলার জন্য বন্ধ করার আদেশ হলে তিনি সে আদেশ অমান্য করেন। তাঁকে দেশত্যাগ করার সাজা দেওয়া হয়। উইলিয়াম উল্টে গুলি করে খতম করে দেন এক সেপাইকে। ১৮০০ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে অকুস্থলে ফাঁসিতে চড়ানো হয়েছিল।”৬
এ তো গেল সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠার পরের কথা। তার আগে ? কেমন ছিল কলকাতার শাস্তি?
আরও পড়ুন
২.
স্রেফ ছ্যাঁকা দিয়ে গঙ্গাপার করিয়ে দেওয়া হত মশায়! ছোটবেলায় দৌরাত্ম্যি থামাতে মায়েরা গরম খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়ার যে ভয় দেখাতেন, স্বভাবচরিত্রে তার থেকে একটু আলাদা, এই যা। Bengal public consultations- এ পাওয়া যায়, “...অনেক চোর আমাদের কোতোয়ালির হেপাজতে আছে ও ভবিষ্যতে আরও আসিবার সম্ভাবনা, এজন্য তাহাদের প্রত্যেককেই গালে লোহা পোড়াইয়া ছাঁকা দিয়া শাস্তি দেওয়া হইবে। তৎপরে তাহাদিগকে কলিকাতা হইতে নদীপার করিয়া অপর পারে তাড়াইয়া দেওয়া হইবে। বিচারকর্তা যেন এ আদেশটি বিশেষভাবে পালন করেন। ( Consultations. 175)”।৭
এর কিছু পরে খুনের অপরাধে নয়ন ছুতারকে তোপের মুখে বেঁধে উড়িয়ে দেওয়া হয়। শাসনকর্তাদের মনে হয়েছিল, “হত্যা প্রভৃতি চরম অপরাধে আগে চাবুকের আঘাতে অপরাধীর প্রাণদণ্ড করা হইত। কিন্তু এরূপ আঘাত জেলের মধ্যে করা হয় বলিয়া বাহিরের দুষ্ট লোকের মনে তাহাতে ভয়ের উদ্রেক হয় না। সুতরাং চাবুক আঘাতে মৃত্যু সঙ্ঘটন ব্যবস্থা পরিত্যক্ত হইল। এইবার হইতে কোম্পানির জমিদারির মধ্যে চরম অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিকে তোপের মধ্যে উড়াইয়া দেওয়া হইবে।”৮ ( Proceedings dated 17th November 1760)
মানুষের মনে ভয় চারিয়ে দিতে গঙ্গার বুকে ফাঁসির আয়োজন করা হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘এসিয়া’ জাহাজের ক্যাপ্টেনকে নাবিকরা সবাই মিলে হত্যা করলে , গঙ্গাবক্ষেই দণ্ডিত আসামিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়। শুধু তাই নয়, হুগলী নদীতে নোঙর করা বাকিসব জাহাজের কর্মচারীরাও যাতে এই শাস্তি চাক্ষুষ করে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা এরপরেও আকছার ঘটে। ১৮০৭ সালের জুন মাসে ম্যানিলা দেশীয় একজন লোক, এক বাঙালি স্ত্রীলোককে ছুরি মেরে হত্যা করলে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। সেখানে লেখা ছিল, “ To be executed on Saturday the 13th. At the four roads, which meet at the head of Lallbazar.”৯
চাবকে পিঠের চামড়া তুলে দেওয়া, কলকাতার শাস্তির ঐতিহ্যবাহী পরম্পরা বেয়েই এসেছে, ইতিহাসে তার সাক্ষ্য মেলে। হিন্দুস্থান ব্যাঙ্ক থেকে মোহর চুরির অপরাধে জনৈক কানাই দে-র শাস্তি ছিল, “১০ই তারিখ পর্যন্ত জেলে থাকিবে। ইহার পর বড়বাজারের দক্ষিণদিকে লইয়া গিয়া, চাবুক মারিতে মারিতে উত্তরদিক পর্যন্ত লইয়া যাওয়া হইবে তার পর ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের জুলাই পর্যন্ত সশ্রম কারাবাস।”১০ ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে জাল টাকা চালানের অপরাধে , স্বরূপ পোদ্দার, মোহন সিং, গঙ্গারাম ও রামজয়ের শাস্তি হয়, “৪ঠা জানুয়ারি পর্যন্ত অপরাধীগণ জেলে থাকিবে। তৎপরে লালবাজারে লইয়া গিয়া দুই ঘন্টাকাল দণ্ডকাষ্ঠতে (Pillory) আবদ্ধ রাখা হইবে। তারপর ১৮ই জানুয়ারি পর্যন্ত তাহাদিগকে পুনরায় জেলে আটক রাখিয়া বড়বাজারের দক্ষিণদিকে লইয়া গিয়া বেত্রাঘাত করা হইবে। ইহাদের মধ্যে যাহাদের দীর্ঘ মেয়াদের হুকুম হয় নাই --- তাহাদের এক সিক্কা টাকা জরিমানা ও পাঁচ হাজার টাকার মুচলেকা লইয়া ছাড়িয়া দেওয়া হইবে।”১১ এই দণ্ডকাষ্ঠের আরেক রকমফের ছিল ‘তুড়ুম’। “এই দণ্ডকাষ্ঠ বা pillory-র মধ্যে অপরাধীর মাথা গলাইয়া ও তাহার হাত দুখানিকে আবদ্ধ করিয়া সাধারণের সম্মুখে অপমানিত করা হইত।”১২ পরে ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দে আইন করে এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়। শাস্তির মাত্রাভেদে দোষীর হাত পুড়িয়েও দেওয়া হত। ১৭৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই আগস্টের গেজেটে পাই, “টুলক্ কোম্পানির দোকান হইতে যে ফিরিঙ্গিটা ঘড়ি চুরি করিয়াছিল,তাহার হাত পোড়াইয়া দেওয়া হইয়াছে।”১৩ আর ছিল দ্বীপান্তর। “দ্বীপান্তর মানে, সাহেব হলে সেই ভ্যান ডায়মন্ডসল্যান্ড বা ট্যাসমানিয়া, এতদ্দেশীয় হলে আকিয়াব, মৌলমিন কিংবা প্রিন্স অব ওয়েলস দ্বীপ।”১৪
লাট-বেলাটের একুশে আইনে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় ছিল, এখানে জালিয়াতির সাজা মৃত্যুদণ্ড। খুনের সাজা নয়। নরহত্যার জন্যে জন ম্যাকলচিন , মহম্মদ টিন্ডাল প্রভৃতিদের একমাস জেল ও একটাকা জরিমানা হয়। অথচ চুরির করার জন্যে মীর গোলাম আলি, ব্রজমোহন দত্ত, বৈজু মশালচি প্রভৃতিদের শোনানো হয় মৃত্যুদণ্ড। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে রাহাজানির অপরাধে ফাঁসির শাস্তি পায় ব্যারী ও বয়েল নামের দুই গোরা।
৩.
শেষ করার আগে কলকাতার বাইরে একবার নজর বুলিয়ে নেওয়া যাক। যদিও বেশিরভাগ মামলাই কোর্টের দোর অবধি পৌঁছত না, থানাতেই মিটমাট হয়ে যেত। উকিলের ফি দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না অনেকেরই। কিন্তু থানায় জেরায় সাক্ষ্যকবুলের নামে যা হত, তার চেয়ে দশ ঘা চাবুক বরং অনেক স্বস্তির। জোর করে সাক্ষ্য আদায়ের জন্যে প্রায় প্রতি থানায় একজন দক্ষ ব্যক্তি নিযুক্ত হতেন। যাকে সঙ্গে পেলে থানাদার পর্যন্ত স্বস্তিবোধ করতেন। দারোগা মিয়াজান তাঁর সঙ্গী ছকু জমাদারকে উদার সার্টিফিকেট দিয়েছেন। “…ছকু হল কোনো ভালো ফৌজদারের এক নম্বর দোসর। সবচেয়ে কড়া জুলুম চালানোর সময়ও ওর মুখের হাবভাবে কোনো বদল হত না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে যেতে পারত কিংবা সেখানে শুয়েই ঘুমিয়ে নিতে পারত।”১৫ প্রখ্যাত সমালোচক সুমন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানিতে, প্রায় শাস্তির মতোই সেইসব জেরার উপায়ের কথা শুনবেন নাকি?
“We hear of the following practices used in the police thanas of Bengal, described in their respective police slang; (i) sarbat khaoano, meaning thrusting urine down the throat; (ii) rule deoa, forcing a rod into the rectum; (iii) shilpakarjya, literally suggesting a work of art, but actually meaning the insertion of needles into the nails; (iv) dalan, meaning pressing on a person’s body with a bamboo log; (v) dolon, in which a person is hung, with his head usually downwards, from a horizontal pole suspended from ceiling; and (vi)krishnachura, (the red-coloured shrub of bougainvillea), the name of a punishment where the hands of the accused are tied behind him, and he is forced to raise them upwards in an extremely painful exercise.”১৬
এখানেই থামা যাক। কী বলেন!
আর শাস্তির সামনে ফেলে দিনটা মাটি করে লাভ নেই।
তথ্যসূত্র:
১.প্যারিমোহন সেন। “রাঁড় ভাঁড় মিথ্যা কথা তিন লয়ে কলিকাতা”। অদ্রীশ বিশ্বাস ( সম্পা.)। বটতলার বই, ১ম।কলকাতাঃ গাঙচিল। জানুয়ারি,২০১১।পৃষ্ঠা ২৬৯
২. হরিসাধন মুখোপাধ্যায়। কলিকাতা সেকালের ও একালের। নিশীথরঞ্জন রায় (সম্পা.), অরবিন্দ ভট্টাচার্য ( সহ. সম্পা.)। কলিকাতাঃ পি এম বাকচি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড। জানুয়ারি ২০০২। পৃ.৪১৪
৩.তদেব। পৃঃ৪০০
৪. তদেব। পৃঃ৩৯২
৫.শ্রীপান্থ। “অথ উত্তমর্ণ অধমর্ণ কথা”।কলকাতা। কলকাতাঃ আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃলিঃ। পৃঃ১৫৬
৬. পিনাকী বিশ্বাস। কলিকাতার মদ্যপানঃ সেকাল ও একাল। কলকাতাঃ খড়ি প্রকাশনী। ২০১৯। পৃঃ ২৯
৭. হরিসাধন মুখোপাধ্যায়। কলিকাতা সেকালের ও একালের। নিশীথরঞ্জন রায় (সম্পা.), অরবিন্দ ভট্টাচার্য ( সহ. সম্পা.)। কলিকাতাঃ পি এম বাকচি অ্যান্ড কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড।জানুয়ারি ২০০২। পৃঃ ১৭৫
৮. তদেব। পৃঃ৩৮৪
৯. তদেব। পৃঃ৪৫৯
১০. তদেব। পৃঃ ৪৫৬
১১. তদেব। পৃঃ৪৫৭
১২. পাদটীকা। তদেব। পৃঃ৪৫৬
১৩.তদেব। পৃঃ৪৫৬
১৪. শ্রীপান্থ। “অথ উত্তমর্ণ অধমর্ণ কথা”।কলকাতা। কলকাতাঃ আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃলিঃ। আগস্টঃ ২০০৭। পৃঃ১৫৬
১৫.মিয়াজান দারোগার একরারনামা। অনুঃ অরিন্দম দাশগুপ্ত। কলকাতাঃ চর্চাপদ। জুন ২০০৯। পৃঃ২৮
১৬.Banerjee, Sumanta. The Wicked City: Crime and Punishment in Colonial Calcutta. New Delhi: Orient Blackswan.2009. Page: 452
[ পোস্টার ঃ অর্পণ দাস ]