বিস্মৃতিই নিয়তি : সাহিত্যিক মানকুমারী বসু
‘সাগরদাঁড়ি’ নামটা শুনলেই সকলে ধরে নেবেন, মাইকেল মধুসূদন দত্ত বিষয়ে কথা শুরু হতে যাচ্ছে। কিন্তু প্রায় কারোরই মনে পড়বে না, একই গ্রাম বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছিল আরও এক শক্তিশালী সাহিত্যিক। ধারে-ভারে মধুসূদনের সমকক্ষ না হলেও, নিজের সময়ে যথেষ্ট পরিচিত নাম ছিলেন। তাছাড়া তিনি মধুসূদনের দত্তের বংশেরই মেয়ে ছিলেন। তিনি কবি ও গল্পকার মানকুমারী বসু - সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদন দত্তের পিতৃব্য রাধামোহন দত্তের নাতনি।
১৮৬৩ সালের ২৩ জানুয়ারি যশোরের কেশবপুর থানার শ্রীধরপুর গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন মানকুমারী। তাঁর পিতা ছিলেন আনন্দমোহন দত্ত। সাগরদাঁড়ির পৈতৃক ভিটেতে পিতার কাছেই মানকুমারী প্রাথমিক শিক্ষালাভ করেন। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থগুলি আয়ত্ত করেছিলেন। অল্প বয়সেই লেখালিখিতে তাঁর হাতপাকানো শুরু হয়। এছাড়া সঙ্গীতের প্রতিও তাঁর প্রবল আকর্ষণ ছিল। নিতান্ত ছোটোবেলাতেই কীর্তনের অংশবিশেষ মুখস্থ করে প্রায় নির্ভুলভাবে গাইতেন।
মাত্র দশ বছর বয়সে কেশবপুর থানার বিদ্যাবনকাটি গ্রামের রাসবিহারী বসুর পুত্র বিধুবশঙ্কর বসুর সঙ্গে মানকুমারী বসু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিধুবশঙ্কর ছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র। তাঁর উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় মানকুমারী বসুর কাব্যরচনার নতুন দিক উন্মোচিত হয়। বিধুবশঙ্কর বসু কলকাতায় থাকার সময় তাঁকে উৎসর্গ করে মানকুমারী অমিত্রাক্ষর ছন্দে 'পুরন্দরের প্রতি ইন্দুবালা' কবিতাটি লেখেন, যা পরে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সম্পাদিত মাসিক 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা। মাত্র উনিশ বছর বয়সে একটি কন্যাসন্তানকে নিয়ে মানকুমারী বসুর বৈধব্যজীবন শুরু হয়।
সেই সময়ে আরেক মহিলা কবি গিরীন্দ্রমোহিনী দাসীর সঙ্গে মানকুমারী বসুর কবিতার কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া তাঁর কবিতায় মাইকেল মধুসূদন দত্তেরও প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মানকুমারী বসুর কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার সারল্য। হিন্দুগৃহের কুলবধূর যন্ত্রণা, বৈধব্য-যন্ত্রণা, স্বামীভক্তি, পারিবারিক জীবন এ-সবই ছিল তৎকালীন সময়ের মহিলা কবিদের কাব্যের প্রধান উপাদান। মানকুমারীর কবিতাও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তিনি উমেশচন্দ্র দত্ত সম্পাদিত 'বামাবোধিনী' পত্রিকার নিয়মিত লেখিকা ছিলেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হলো 'প্রিয় প্রসঙ্গ' (১৮৮৪ খ্রী:), 'কাব্যকুসুমাঞ্জলি' (১৮৯৩ খ্রী:), 'কনকাঞ্জলি' (১৮৯৬ খ্রী:), 'বীরকুমার বধ' (১৯০৪ খ্রী:), 'বিভূতি' (১৯২৩ খ্রী:) প্রভৃতি। বীররস ও করুণরসের সমন্বয়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত 'বীরকুমার বধ' আখ্যানকাব্যে মহাভারতের অভিমন্যু বধের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। কবিতা ছাড়াও মানকুমারী বসু ছোটোগল্প রচনাতেও পারদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। 'রাজলক্ষী', 'অদৃষ্টচক্র' এবং 'শোভা'-র জন্য তিনি কুন্তলীন পুরস্কার পেয়েছিলেন। এছাড়া তাঁর 'পুরাতন ছবি' গল্পটিও পাঠকসমাজে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল।
অন্তঃপুরের শিক্ষার জন্য শিক্ষয়িত্রী, পল্লীগ্রামে স্ত্রী-চিকিৎসক ও ধাত্রীর আবশ্যকতা এবং সমাজে দুর্নীতি নিবারণের বিষয়ে মানুকমারী বসুর কয়েকটি প্রবন্ধ তৎকালীন সময়ের বুদ্ধিজীবী মহলে সমাদৃত হয়। 'বাঙালি রমণীদের গৃহধর্ম' ও 'বিবাহিত স্ত্রীলোকের কর্তব্য' তাঁর রচিত প্রবন্ধ পুস্তক।
সাহিত্য-প্রতিভার জন্য মানকুমারী বসু ১৯১৯ সালে আমৃত্যু ব্রিটিশ ভারত সরকারের বৃত্তি লাভ করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৩৯ সালে তাঁকে 'ভুবনমোহিনী স্বর্ণপদক' এবং ১৯৪১ সালে 'জগত্তারিণী স্বর্ণপদক' দিয়ে সম্মানিত করে। ১৯৩৭ সালে চন্দননগরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনে মানকুমারী বসু 'কাব্য সাহিত্য' শাখার সভানেত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর ১৯৪৩ সালে কন্যা পিয়বালার খুলনাস্থ গৃহে মানকুমারী বসু দেহত্যাগ করেন। ভৈরব নদীতে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নিজের একটি এপিটাফ রচনা করেছিলেন। কবিতাটির নাম ‘অন্তিম’।
তার কয়েকটি লাইন পাঠকের জন্য — "যে কুলে জন্মিলে কবি মধুসূদন সে কুলে জন্ম মম বিধির আদেশ, মাতা শান্তমণি পিতা আনন্দমোহন বিধুব শঙ্কর বসু পতিদেব মম। প্রিয় বঙ্গবাসী যদি ভালোবাসো মোরে ক্ষণেক দাঁড়ায়ে দেখ তটিনীর তীরে, স্নেহমতি মা জননী বসুমতী কোলে বঙ্গের মহিলা কবি রয়েছে ঘুমায়ে।"
ছবি : Wikimedia Commons
#ফিচার #মানকুমারী বসু #সাহিত্যিক #বাংলা #bengali #mankumari basu #feature #প্রগত #writer #Bengali Writer