ফিচার

রান্না নয়, 'ভোজপণ্ডে'দের গালি দিতেই ভোজবাড়িতে রাঁধুনির চল

তোড়ি সেন Mar 29, 2024 at 6:55 pm ফিচার

খোকার অন্নপ্রাশন। গ্রামসুদ্ধু লোকের নেমন্তন্ন। কিন্তু রান্না করবে কে? কেন, খোকার তিন মা তো আছেই, সঙ্গে হাজির পাড়ার সব মেয়ে-বউরা। সকলে মিলে হাত লাগিয়ে আনন্দনাড়ু তৈরি হল পুরো পাঁচ ঝুড়ি। আগের দিন পাড়ার মেয়েরা এসে পর্বতপ্রমাণ তরকারি কুটতে বসল। সারারাত জেগে সবাই মাছ কাটলে ও ভাজলে। গ্রামের কুসী ঠাকরুন ওস্তাদ রাঁধুনী, শেষরাতে এসে তিনি রান্না চাপালেন, মুখুয্যেদের বিধবা বউ ও ন'ঠাকরুন তাঁকে সাহায্য করতে লাগলেন।

এ ছবি আঁকছেন বিভূতিভূষণ, তাঁর 'ইছামতী' উপন্যাসে। আসলে সেকালের বাংলার ছবিটা এমনই। একালের ভোজের খাদ্যতালিকা বা ভোজের কায়দাকানুন, সবের থেকেই অনেক আলাদা সে সময়। নানারকম নিরামিষ রান্না আর মাছের তরকারি, এই ছিল ভোজের মূল খাবার। ডালের চল পর্যন্ত বিশেষ ছিল না। দোকানের শৌখিন মিষ্টিও তখনও ওঠেনি। তা এইসব খাবার রান্না করতেন বাড়ির মহিলারাই। সাহায্য করতেন পড়শি নারীরাও। তবে ভোজবাড়ির রান্না করতে হাতাবেড়ি ধরবেন কোনও পেশাদার পাচক, এমনটাও ভাবাই যেত না সেকালে। নেহাত ভোজপণ্ডেদের দৌরাত্ম্যেই একসময় আসর জাঁকিয়ে বসেন এই ভাড়াটে পাচকেরা।

ভাবছেন, ব্যাপারটা ঠিক কী? 'ভোজপণ্ডে'-ই বা কারা? তাহলে খুলেই বলা যাক। 

আসলে সেকালের কলকাতা, বা বলা ভালো সেকালের বাংলা জুড়েই জাতপাতের ভাগ ছিল ষোল আনা। বিশেষ করে নিমন্ত্রণের ক্ষেত্রে কে কার বাড়িতে পাত পাড়বে, তা নিয়ে সেই বিধিনিষেধ চূড়ান্ত রূপ নিত। সেই নিষেধ মেনেই খাবারের ক্ষেত্রেও ছিল একাধিক রীতিনীতি। অব্রাহ্মণের বাড়িতে ব্রাহ্মণ ভাত খাবেন না, খাবেন না নুন দেওয়া খাবারও। ছাঁদা বেঁধে খাবার দিলে সেখানেও নুন দেওয়া খাবার চলবে না, কেন-না তা এঁটো। এইসব নিয়মের পান থেকে নুন খসলেই বেধে যেত ঝামেলা। পণ্ড হত খাওয়াদাওয়াও। আর সেইখানেই হাজির হয়েছিল এক শ্রেণির মুরুব্বি, যাদের নাম হয়ে গিয়েছিল 'ভোজপণ্ডে'। 

কী করত এরা? এদের কাজই ছিল ভোজন পণ্ড করা। কোনও নিমন্ত্রণবাড়িতে গিয়ে সেই বংশের কোনও কুৎসা রটনা করত তারা। সে কথা সত্যি না মিথ্যে, তা কেউ খতিয়েও দেখত না। বরং নিমেষেই সেই জল্পনা ছড়িয়ে পড়ত দাবানলের মতো। আর তাতে বিশ্বাস করেই খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়তেন অন্যান্য আমন্ত্রিতেরাও। সমাজের গণ্ডি তখন এতই কড়া যে সে নিয়ম না মানলেই একঘরে হতে হবে। সব খাবার, ভোজের আয়োজন তো নষ্ট হতই, একইসঙ্গে বরাবরের মতো সেই কুৎসা লেগে থাকত ওই পরিবারের গায়েও। বঙ্কিমচন্দ্রের 'দেবী চৌধুরাণী' উপন্যাসেই যেমন প্রফুল্লের বিয়ের দিনে এমন গোলমাল দেখা দিয়েছিল, যার ফলে শ্বশুরবাড়িতেই আর ঠাঁই হয়নি তার। 

বিবেকানন্দ-ভ্রাতা মহেন্দ্রনাথ দত্ত জানাচ্ছেন, এমন কিছু ঘটনার পরেই পাচক ব্রাহ্মণের প্রথা চালু হয়। তারা রান্না তেমন করতে পারুক বা না পারুক, ভোজপণ্ডেদের পালটা গালি দিতে পটু ছিল। বারকয়েক অপমানিত হওয়ার পর ভোজপণ্ডেদেরও প্রভাব কমে যায়। কিন্তু রাঁধুনিদের চল থেকেই যায়। আর তার ফলেই বিপুল ভোজ রান্নার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান গিন্নিরা। 

...............

#ভোজপণ্ডে #bengali cuisin #cook #silly পয়েন্ট

Leave a comment

All fields are required. Comment will appear after it is approved.

trending posts

newsletter

Connect With Us

today's visitors

76

Unique Visitors

183291